ট্রাম্পের ভিসা নীতি, কতটা দুর্বল হবে মার্কিন গবেষণাক্ষেত্র?

H-1B Visa Fee Hike: ভারত, চিন ও ইউরোপ ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এইসব দেশের মেধা ও মানবসম্পদের একটা বড় অংশ এতদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছিল।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন এইচ-১বি ভিসার ক্ষেত্রে এক লক্ষ মার্কিন ডলার ফি ধার্য করা হবে। এতদিন পর্যন্ত নিয়োগকর্তাদের ১,৭০০ থেকে  ৪,৫০০ ডলার ফি দিতে হত, মানে এবার সেই খরচ বাড়বে প্রায় বাইশ থেকে তিরিশ গুণ। ট্রাম্পের দাবি, এই পদক্ষেপ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’-এর পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তব বিশ্লেষণ বলছে, এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও গবেষণার মান কমিয়ে দেবে, প্রযুক্তি ও আর্থিক পরিষেবা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকে দুর্বল করবে।

প্রথমেই দেখা যাক, এই এইচ-১বি ভিসা ঠিক কী? ১৯৯০ সালে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ একটি বিশেষ কর্মসংস্থান ভিসা প্রোগ্রাম হিসেবে এইচ-১বি চালু করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ বিদেশি কর্মীদের দেশটিতে নিয়ে আসা, কারণ তখন মার্কিন দেশীয় কর্মীবাহিনীতে এই ধরনের উচ্চ দক্ষতার অভাব ছিল। এই ভিসাটি কেবল স্নাতক বা তার বেশি ডিগ্রিধারী অত্যন্ত দক্ষ বিদেশি পেশাদারদের জন্য প্রযোজ্য। তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, এবং আর্থিক পরিষেবা- এই সব খাতে বিগত কয়েক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, তার পেছনে বিদেশি মেধার অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিবছর প্রায় ৮৫,০০০ জন কর্মী এই ভিসার মাধ্যমে আমেরিকায় প্রবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় ও চিনের প্রযুক্তিবিদ, গবেষক ও অর্থনীতিবিদ। গুগলের সুন্দর পিচাই, মাইক্রোসফটের সত্য নাদেলা, কিংবা অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়- সবাই এই এইচ-১বি ভিসার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। অতএব, এই ভিসাকে শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের সুযোগ হিসেবে নয়, বরং জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব রক্ষার অন্যতম ভিত্তি হিসেবেই দেখা উচিত।

আরও পড়ুন- ১ কোটি মানুষকে তাড়াতে চান ট্রাম্প! পুশব্যাকই বিশ্ব জুড়ে ট্রেন্ড?

এই নতুন ভিসা ফি নীতি প্রয়োগ হলে সবচেয়ে গুরুতর আঘাত আসবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে। আজও বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। এমআইটি, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির সাফল্যের মূল কারণ হল তাদের পরিকাঠামো এবং সারা পৃথিবী থেকে আসা শ্রেষ্ঠ গবেষকেরা, যা বিশ্বের সেরা নতুন প্রতিভাদের আকৃষ্ট করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই বিদেশি- বিশেষত ভারত, চিন ও কোরিয়া এবং অন্যান্য এশিয়ার ও ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা। এঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে অধ্যাপক, গবেষক বা বিজ্ঞানী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই আন্তর্জাতিক মেধার প্রবাহই গত কয়েক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অসংখ্য নোবেলজয়ী গবেষক উপহার দিয়েছে, যাঁরা বিদেশি বংশোদ্ভূত হয়েও আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

কিন্তু প্রতিটি বিদেশি গবেষক বা অধ্যাপকের নিয়োগের জন্য যদি প্রায় এক লক্ষ ডলার অতিরিক্ত ফি দিতে হয়, তবে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, অপেক্ষাকৃত ছোট বা মাঝারি মানের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারবে না। ফলস্বরূপ, তারা কম যোগ্যতাসম্পন্ন দেশীয় নাগরিকদের নিয়োগ করতে বাধ্য হবে, যা শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান কমিয়ে দেবে। অন্যদিকে, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হয়ত বিদেশি অধ্যাপক নিয়োগ করবে, কিন্তু এই বিশাল খরচ শেষ পর্যন্ত চাপানো হবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর। ইতিমধ্যেই আমেরিকার উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা শিক্ষার্থীদের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। নতুন নীতি সেই ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলবে, যা দেশীয় শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করবে এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ আরও কমিয়ে দেবে। এর ফলে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আন্তর্জাতিক সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে, আর ভারত, চিন কিংবা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গবেষণার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আসবে। অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী ও গবেষক তখন এমন দেশের দিকে ঝুঁকবেন, যেখানে শিক্ষার খরচ কম এবং সুযোগ-সুবিধা উন্নত।

এরপর আসি তথ্যপ্রযুক্তি ও আর্থিক খাতে। এই খাতগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক শক্তির প্রধান স্তম্ভ। সিলিকন ভ্যালির সাফল্য প্রমাণ করে, বৈচিত্র্যময় আন্তর্জাতিক মেধাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই অবস্থানে এনেছে। যখন গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট-এর মতো সংস্থাগুলো বিশ্বমানের প্রতিভা খুঁজছে, তখন তারা শুধু দেশীয় মেধার ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না। কিন্তু যদি সংস্থাগুলিকে এইচ-১বি ভিসার জন্য এক লক্ষ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়, তবে তাদের সামনে দু'টি পথ থাকবে। প্রথমত, তারা তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মার্কিন নাগরিকদের নিয়োগ করতে পারে, যা পরবর্তীকালে সংস্থাগুলির উদ্ভাবনী শক্তি ও গুণমান দু'ইই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দ্বিতীয়ত, তারা বিদেশিদের নিয়োগ করলেও সেই খরচ তুলতে পরিষেবার দাম বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে সফটওয়্যার, ক্লাউড সেবা, বা আর্থিক প্রযুক্তির খরচ বেড়ে যাবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকই নয়, সারা বিশ্বের ভোক্তারা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক পরিষেবা বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ভারত, চিন ও ইউরোপ ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এইসব দেশের মেধা ও মানবসম্পদের একটা বড় অংশ এতদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছিল। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়, তবে এই দেশগুলোই সেই মেধাকে কাজে লাগিয়ে তুলনামূলক সস্তা ও উন্নত পরিষেবা দিতে শুরু করবে। কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খারাপ হবে। অন্যদিকে, ভারত বা চিন তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তি শিল্পকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবে।

আরও পড়ুন- ট্রাম্প–পুতিন–আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?

এই ফি বাড়ানোর জন্য ট্রাম্পের আরেকটি যুক্তি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। পণ্য আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে এবং ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কনীতি তাতে এখনও অবধি বিশেষ কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। কিন্তু পরিষেবা বাণিজ্যে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও আর্থিক খাতে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাটতি তো নেইই, বরং প্রচুর উদ্বৃত্ব রয়েছে। এর কারণ, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সস্তা পরিষেবার উপর নির্ভরশীল, তাই তারা পরিষেবায় শুল্ক আরোপের চেষ্টা সাধারণত করে না। এর ফলে পরিষেবা ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলক সুবিধে পায়। কিন্তু নতুন ভিসা ফি নীতির ফলে পরিষেবার মান কমে গেলে ও খরচ বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের এই সুবিধা ক্রমশ কমে আসবে। ফলস্বরূপ বিশ্ববাজারে মার্কিন পরিষেবার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং উদ্বৃত্ত কমে গিয়ে তারা আরও ঘাটতির দিকে অগ্রসর হবে। অর্থাৎ ট্রাম্পের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করার উদ্দেশ্য ভিসা ফি বাড়িয়ে কোনোভাবেই পূরণ হবে না।

ইতিহাসের শিক্ষা হলো, কোনো সাম্রাজ্যই চিরস্থায়ী নয়। রোমান, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য- সবকিছুই সময়ের নিয়মে তাদের গৌরব হারিয়েছে, আর আমেরিকাও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে নামা শুরু হলে প্রায়ই সাম্রাজ্যগুলি অযৌক্তিক নীতি গ্রহণ করে শক্তি ধরে রাখার চেষ্টা করে, যা উল্টে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি ঠিক সেই পথেরই আভাস দিচ্ছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবনী শক্তি এবং আন্তর্জাতিক মেধাকে আকর্ষণ করার ক্ষমতার ওপর এক সরাসরি আঘাত।

অন্যদিকে, ভারত ও চিনের মতো দেশগুলির জন্য এ এক সুবর্ণ সুযোগ। যদি তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসা বা সেখানে যেতে অনিচ্ছুক প্রতিভাবান গবেষক ও প্রযুক্তিবিদদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বা ধরে রাখতে পারে, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই তারা আন্তর্জাতিক পরিষেবা বাজারে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারবে। এর জন্য দরকার সঠিক নীতি, বিনিয়োগ, এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণার পরিকাঠামো। চিন ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিভাবানদের জন্য তাদের নিজস্ব H1B ধরণের ভিসা প্রোগ্রাম শুরু করেছে। অন্যান্য উদীয়মান দেশগুলিও এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে, আগামী দশকে বিশ্ব পরিষেবা খাতের মানচিত্র আমূল বদলে যেতে পারে। তাই অল্প কথায়, এই এক লক্ষ ডলারের এইচ-১বি ভিসা ফি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরোপুরিই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি তাদের দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি ও অর্থনীতি- সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। যে তুলনামূলক অর্থনৈতিক সুবিধার ওপর ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতদিন বিশ্বনেতৃত্ব বজায় রেখেছে, সেটিই অবক্ষয়ের মুখে পড়বে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য যখন তখন তাঁর সিদ্ধান্ত বদলান, আর এই ভিসা ফি বৃদ্ধি হয়ত শুধুই বিশ্ববিদ্যালয় আর সিলিকন ভ্যালির উদারপন্থী মহলের বিরুদ্ধে ওনার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ। ট্রাম্পের মনের অন্দরমহলে কী চলে, তা কেউই জানে না, তবু একথা নিশ্চিত- শেষ পর্যন্ত এই ভুল নীতির বোঝা বইবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই। সে ‘গ্রেট’ তো হবেই না, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে যাবে। আর এই শূন্যস্থান পূরণ করবে ভারত, চিন ও ইউরোপের উদীয়মান শক্তিগুলি।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত) 

লেখক ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক

More Articles