ইউনিট টেস্ট আর শুকতারা! পাড়াগাঁয়ের টিউশনই ছিল না-জানা গল্পের ক্লাস
Village Tuition Classes: বুড়ো সাইকেল, কাগজের ডাঁই, চশমা, কলম, চায়ের কাপ পড়ে রইল যে। আপনি কেমন হাসতে হাসতে চলে গেলেন। মাস্টারমশাই মারা গেলেন।
চন্দ্রিমা হাজরা আমার ছোটবেলার দিদিমণি। অক্ষর চেনানো, উলের আসনে বসে হাতের লেখা সব শিখিয়েছিলেন ধৈর্য ধরে। চন্দ্রিমা নামটি বড় হয়ে জেনেছি, আমি সবসময় ডাকতাম চণ্ডী মা নামে। চণ্ডী মা দিদিমণি। দিদিমণিকে ডাকতে গিয়ে অজান্তে কেমন 'মা' শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলতাম। দিদিমণির পড়ানো সেই নীলচে নীলচে কুয়াশাঘেরা কবরখানার পাশের ছোট্ট ইস্কুলবাড়ির পুঁচকে দিনগুলি থেকেই যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসিখুসি' বইখানা আমার সঙ্গী ছিল, বন্ধু ছিল। তারপর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর পরই বইটি হারিয়ে যায়। দিদিমণির দেওয়া উপহার ছিল।
ইস্কুলে ক্লাসের পরে আমরা দিদিমণির বাড়িতে গিয়ে দেখতাম, সারি সারি বই রাখা। প্রতি বই যত্ন করে সাজিয়ে রাখা। পড়া হলে হেলাফেলা করে নয়, কত নিপুণ যত্নে যেখানকার বই সেখানেই সাজিয়ে রাখতেন। এখনও ওই ছবিটা চোখে ভাসে, মাথার চুলগুলো বিকেলের হাওয়ায় উড়ছে, দিদিমণি বিকেলের আলোর নিচে বসে বই পড়ছেন। মলাট করছেন বাঁশপাতা কাগজে।
অনেকদিন পর অঘ্রাণ মাসের দুপুরে প্রাইমারি ইস্কুল, হাইস্কুল, কলেজ ফুরানো আমাকে হাসিখুশি বই উপহার দিল কাটোয়া কোর্টের পুরনো বই বিক্রি করা সেই জেঠু। লালচে লালচে পাতা, ঝুরো ঝুরো হয়ে গেছে। বহু পুরনো সংস্করণ। পাতায় পাতায় ছবি। বইটির জন্য একটি পয়সাও নিল না জেঠু। এমনি বিনিপয়সায় কত পুরনো পুরনো বই যে সে আমায় দিয়েছে! বইখানা কোলে নিতেই চোখে জল এল।দিদিমণির কথা মনে এল। কত ভালোবেসে একদিন 'হাসিখুশি' বই দিয়েছিল।
এক মুহূর্তে দিদিমণি আর এই বই বিক্রেতা জেঠু এক হয়ে গেল। জীবনের অধিকাংশই কাটল এদের বইয়ের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে বইটিতে হাত বোলাচ্ছি যেন পুরনো বন্ধুর গায়ে হাত রাখছি। মা'কে পড়ে শোনাচ্ছি একটু। বাবা নিজে পড়ছে একটু। কতদিন পর যেন ছোটবেলার অতিথি এসেছে, হাত পা ধুয়ে আমাদের মাঝে গোল হয়ে চাটাইয়ে বসে কত কত ভুলে যাওয়া গল্প করছে...
আরও পড়ুন- কামসূত্রেও যা নেই! পাড়াগাঁয়ের লুকোচুরি যেভাবে শেখায় শিরশিরে যৌনতার সহজপাঠ
২
একটু বড় হয়ে যার কাছে টিউশনি পড়েছি তিনি খসখসে সস্তা কাপড়জামা পরতেন, সাইকেল থেকে নেমে বাজারের থলে বারান্দায় রেখে,পাকশালায় রান্না চড়িয়ে আমাদের পড়াতেন। আন্তরিকতায় টলটল করতেন। কতবার পড়াতে পড়াতে মুড়ি, নিমকি, নাড়ুর বাটি এগিয়ে দিয়েছেন সস্নেহে।
বড় জামগাছ ছাওয়া শ্যাওলাধরা বাড়িটায় কেটে গেছে কত কত বছর। দলবেঁধে পড়তে যেতাম।
বিয়ে-থা করেননি। বইয়ের সঙ্গে ঘর-বসতি, সংসার।
সারা বাড়ি ছোট ছোট ফুলগাছে ভরা। টবে নয়, মাটির ভাঁড়ে, বাতিল পাত্রে। আর একটা নোনাধরা প্রাচীন পাতকুয়ো জবাগাছের ধারে।
মোটা ফ্রেমের চশমা, রোগা সাইকেলে হলুদ থলে ঝুলিয়ে মাস্টার চলেছে ভোরের ইষ্টিশনে কাগজ আনতে। বিজয়াভোরে কানের কাছে রেডিও এনে খবর শুনছেন। হাতে ঘড়ি বাঁধা একটু ঝুঁকে শব্দছক করছেন। বৃষ্টিতে সাদা দুপুরবেলা আমাদের পড়াচ্ছেন- পতিত হেরিয়া কাঁদে।
- স্যার, আমাকে দুটো শুকতারা দিন। পুজোসংখ্যা না হলেও হবে। কালকেই ফেরত দিয়ে যাব।
- নাইনে উঠবি, পরশু থেকে ইউনিট টেস্ট, এমন করলে চলবে?
- ও কিছু হবে না স্যার, সব হয়ে যাবে, বস্তায় বাঁধা পুরনো শুকতারা আমি দু'খানা নিলাম...
কবেকার জলে ডোবা কথা এইসব। সেলাইমেশিন চলে কিরকির। মাধ্যমিক হল উচ্চমাধ্যমিক হল কলেজ হল। দেখাসাক্ষাৎ কম হয়, একেবারে হয় না তা নয়। সকালের বাজারে ভোরের ইস্টিশনে কাগজ আনতে গিয়ে দেখা হয়ে যায়। কথা হয় অল্পস্বল্প। দেখা হলেই মাস্টারমশাই বলবে, কী পড়ছিস এখন?
বাবা, মানুষ দেখে বেড়াবি, আমি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ছি, অসম্ভব ভাল।
একদিন মাস্টারমশাই জানতেও পারবে না, কত কত সংসারী ছাত্রছাত্রীরাও জানতে পারবে না এ খবর। বুড়ো সাইকেল, কাগজের ডাঁই, চশমা, কলম, চায়ের কাপ পড়ে রইল যে। আপনি কেমন হাসতে হাসতে চলে গেলেন। মাস্টারমশাই মারা গেলেন।
আমি চুপ করে দেখছি ঝিঙেফুলের ফুটে ওঠা সাঁঝে। এমন নিঝুম শান্ত ছিলেন আপনি।
শুধু বইকে ভালোবেসে বেঁচে থাকা মানুষজনের সংখ্যা দ্রুত বিলীয়মান।