চারাগাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে ভিক্ষুক, ছোটো স্টেশনে গমগম করে ওঠে দেশগাঁয়ের ছবি

Village Small Stations: ইস্টিশনের নাম বেহুলা। সকালবেলার রেলগাড়ি। নতুন ধান মেলা আছে।

জগদানন্দপুরে নবান খেতে গেছিলাম। এখন বাড়ি এলাম। শীতের রাত। চারিদিক ছমছমে নিঝুম। কুয়াশার ধোঁয়া চারিদিকে। শৃগাল ঘুরছে। অন্নপূর্ণা দেখতে দেখতে, ঝোলা কাঁধের ভিক্ষাহাত মেলা মহাদেব দেখতে দেখতে কত কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, মাটিতে হাঁটু পেতে দিন ও রাতের কাছে ক্ষমা চাই অপারাধহীন স্বচ্ছ ক্ষমা। ভুলে যাওয়া দিনরাত আমায় মাটি থেকে তুলে বুকে নিক।

আমার চোখ সারাক্ষণ পুরনো মানুষদের খুঁজে মরে। কারও থুতনির সঙ্গে সামান্য মিল পেয়ে, চুলের ঢালের একাকার দেখে চমকে ওঠে প্রাণ। পাঁজরের কাছে পেতে ইচ্ছে করে খুব। হাতের ভিতর খুঁজে নিতে চায় হাত। ওগো, নিঠুর দরদি, নতুন চালের গন্ধে, ফল-সবজি খেতে খেতে গতকথা মনে আসে। বুক ফুঁপিয়ে ওঠে। দৃশ্যের পাপড়ি থরে থরে খুলে যায়। এক অলীক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডুবিয়ে মারে। এমনি এমনিই গানের দেবীর কাছে মাটির হারমোনিয়াম মানত করে এলাম।

তারপর ট্রেনে ধরে আবার অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। ইস্টিশনের নাম বেহুলা। সকালবেলার রেলগাড়ি। নতুন ধান মেলা আছে। চিঁড়ে ভাজা,গরম ছোলা, কান খোঁচানোর পিতলকাঠি, কাঁঠালিকলা, ঘুগনি গরম, ডিমসেদ্ধ, লাল চা, হিজড়ের হাততালি আর লবানের গাঁ গেরাম পার করা পুঁচকে ভিক্ষের হাত ছাপিয়ে গান আসছে। কে গাইছে অমন করে। একখানা লাইন ধরে খেলিয়ে খেলিয়ে গাইছে। উঁচু গলা। ঈষৎ সর্দি মেশানো। কত্তালের মৃদু টুং টুং।

সাদা ধুতি ফতুয়া পরা। হাওয়াই চটি। আপনমনে গাইতে গাইতে এগোচ্ছে। কামরা গমগম করছে। কেউ ভিক্ষা দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না। লোকটি হাতে একটা কলাগাছ আঁকড়ে আছে। ছোট চারা। নতুন গন্ধ গাছে। ভিক্ষা সামলে গাছ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে

জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাবে চরাচর। ছাতিমের গন্ধ। বাবা কলাবউ তৈরি করত, নৌকা, তাতে গোলা,পঞ্চশস্য রাখার জন্য। মৃত্যুর আগে ঠাকুমা গড়ত। পুববাঙলার ফরিদপুরে নদীর ধারে নারকেলগাছ ছাওয়া বাড়িতে পুজো হত রাত জেগে। ঘোমটা টানা মেয়ের দল উনুনের পাড়ে বসে খইয়ে পাক দিচ্ছে, নারকেল নাড়ু, তিলনাড়ু তালুতে ঘুরছে। শিয়ালদা স্টেশনে শরণার্থী হয়ে থাকার সময় আর রিফিউজি ক্যাম্পে বোধ করি বন্ধ ছিল কিছু বৎসর। তখন কোথায় গাছ! কোথায় বাসা!

নিলীয়মান সে ত্রস্ত বাংলা অনেক মুছে গেলেও দুব্বোঘাসে শিশির, রাত হিম পড়ে গেল, মশারির বাইরে সুপুরিবাগান, বন্ধু বাসরাস্তা ছেড়ে ট্রেনে উঠতেই চোখে টলোমলো জল।

যে বুড়োবুড়ি শেষদিন অবধি, নাভিশ্বাস ওঠার ক্ষণ অবধি মনে করেছে নিজের দেশগাঁয়ে ফেরার কথা, লক্ষ্মীপ্রতিমার রূপ দেখেছিল কোজাগরীর কীর্তিনাশাজলে; এই কলাগাছের নৌকা মনে মনে ভাসিয়ে দেওয়া হল ওঁদের জন্যেই, পঞ্চশস্য নৌকা চলেছে ভেসে, শোলার মকুট আকাশে, হাল ধরে বসে আছে আমাদের ভবা, ঋত্বিক ঘটক... এই যে কলাগাছ দেখতে দেখতে বহুদূর পিছিয়ে গেলাম এটি অবিরত চলে। চাল ধুতে ধুতে মনে পড়ল ভুখা মিছিল।তালুতে লেগে থাকা চালে ভিজে শীত হাতখান।

আমি ঝোলা কাঁধে মেলায় বেরলাম। বেরনোর এই হল প্রাক ভূমিকা।

More Articles