পরকীয়া থেকে ত্রিকোণ! হরিদেবপুর কাণ্ড মনে করাচ্ছে প্রেমের জন্য হত্যার কালো অতীত
Haridevpur murder case: কলকাতার হরিদেবপুর হত্যাকাণ্ড মনে করাচ্ছে প্রেমের জন্য হত্যার ইতিহাস।
তোমার জন্য সব পারি! দিতে পারি প্রাণ! যদি সেই তুমি-র হাতেই খোয়া যায় তাঁর প্রাণ! গল্পের মজনুর প্রেম-শোকে কেঁদেছিল বিশ্ব। আবার রোমিও-জুলিয়েট, শাহজান-মুমতাজ, ওথেলো-ডেসডিমোনা কাহিনির বেদনায় জর্জরিত হয়েছি প্রায় সকলেই। প্রেমের ব্যথা আর মৃত্যুর দোরগোড়ায় যেন দাঁড়িয়ে গিয়েছে সবটা। কিন্তু ওঁরা? এই যুগের ওঁরা?
রিজওয়ানুর-জুনিয়র-সুতপা-অয়ন-রোহিত! ঘটনার প্রেক্ষিত ভিন্ন। চিরবিদায়ের কারণও হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা, কিন্তু সূত্র সেই এক, গণ্ডি সেই এক কেন্দ্রেই। প্রেম। ভালবাসা। আর ফল মৃত্যু! একে অপরের জন্য বাঁচার ইচ্ছা, একসঙ্গে থাকার তাগিদ! কিন্তু পরিণতি সেই মৃত্যুই!
অনুষ্কা শর্মা অভিনীত 'এনএইচ টেন'। ছাপোষা এক যুগলকে টেনে নিয়ে গিয়ে নৃশংস হত্যা করেছিল তাদের আত্মীয়রা। আর 'দৃশ্যম' সিনেমায় মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করা যুবকের অসংযত আচরণের প্রতিবাদে খুন করেছিল প্রেমিকার মা! একটি নিরীহ পরিবারের অপরাধে ফেঁসে যাওয়া হাড় হিম করেছিল বারবার। সিনেমা ছাড়িয়ে বাস্তবেই যেন সেই ছবিই উঠে আসে বারবার। কোথাও বাঁচতে, আবার কোথাও বাঁচাতে খুন করতে বা হতে হয় কখনও। কিন্তু কারণ সেই প্রেম!
আরও পড়ুন: আনিস কাণ্ড মনে করাচ্ছে রিজওয়ান স্মৃতি, সুবিচার পেয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কার স্বামী?
ক্রমান্বয়ে কিছু ঘটনা। যুগ-যুগান্তর ধরে একের পর এক প্রেমের জন্য মৃত্যু যেন প্রকাশ করে এমন কিছুরই। যেখানে কারণ, পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন হলেও সেতুবন্ধন করে, উপজীব্য হিসেবে কাজ করে সেই প্রেমই। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, কলকাতার হরিদেবপুর হত্যাকাণ্ড। প্রেমিকার বাড়িতে যাওয়া। প্রেমিকার মায়ের সঙ্গে বচসা। অভিযোগ, এর ফলেই প্রিয় মানুষ, প্রেমিকার সামনে তার পরিবারের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে অয়ন মণ্ডলকে। বিতর্ক-আলোচনা, সমালোচনা-গাফিলতি, রাজনীতি; একাধিক শব্দবন্ধ সমগ্র ঘটনাকে বর্তমানে বেঁধে দিলেও একটি পরিবার হারিয়েছেন তাঁদের সন্তান। অকালে চলে যেতে হয়েছে অয়নকে। একইভাবে বহরমপুরে হারিয়ে গিয়েছিল সুতপা। আবার কারণ আলাদা হলেও সেই প্রেমের জন্যই রেললাইনে উদ্ধার হয়েছিল রিজওয়ানুর রহমানের দেহ। আধুনিক সমাজ আর উদার মানসিকতা, শিক্ষিত সত্তার ভিড় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়লেও ক্রমশ প্রেমের জন্য মৃত্যু, প্রেমিকার জন্য, প্রেমিকার পরিবারের জন্য মৃত্যু, প্রিয়জনের কারণে খুন হওয়ার বহর কমার তুলনায় যেন বেড়েছে আরও।
২০০৭ সাল। সেপ্টেম্বর। রাজ্য উত্তাল হয়েছিল রিজওয়ানুর রহমানকে নিয়ে। প্রেমের জন্য, প্রেমিকার প্রভাবশালী বাবা, পরিবারের ইন্ধনে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। খুন হননি ঠিকই কিন্তু অচিরেই সেই প্রেমই, প্রেমিকার পরিবারই মানসিকভাবে গলা টিপে মেরেছিল রিজওয়ানূরকে। শুধু তিনিই নন, সমগ্র বিশ্বজুড়ে এর উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। যদি শুধুমাত্র এই রাজ্য বা গোটা দেশের দিকে সামগ্রিকভাবে আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে যা দাঁড়ায়;
৮ অক্টোবর, ২০২২। হরিদেবপুরের অয়ন হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে হুগলির চুঁচুড়ার ঝিঙেপাড়া এলাকার একটি ঘটনা। অভিযোগ, মেয়ের সঙ্গে তিন বার পালিয়ে যাওয়া মেয়ের প্রেমিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করেছে মৃত যুবকের প্রেমিকার বাবা।
২০১১ সাল। জুলাই মাস। রাতে বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়েতে খুন হয়েছিলেন জুনিয়র মৃধা। বেসরকারি সংস্থার কর্মী ছিলেন তিনি। ২০২১ সাল, প্রায় ৯ বছর পরে এই খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়, জুনিয়রের প্রেমিকা প্রিয়াঙ্কা চৌধুরীকে।
সেপ্টেম্বর, ২০২১। বারুইপুরে স্বামীর সঙ্গে মিলে প্রেমিকার হাতে খুন হলেন প্রেমিক। অভিযোগ ওঠে, প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া আলফিকারকে নৃশংসভাবে খুন করে ওই দম্পতি।
সেপ্টেম্বর, ২০২১। উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের মল্লিকপাড়া এলাকায় প্রেমিকার একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় এক যুবকের ঝুলন্ত দেহ। অভিযোগ ওঠে, প্রেমিকার বাড়ির লোক খুন করেছে মকিনুর হক নামে ওই যুবককে।
ডিসেম্বর, ২০২১। এই রাজ্যেরই শক্তিগড়েচাঞ্চল্য ছড়ায়। উদ্ধার হয়, শেখ রফিক নামে এক যুবকের মৃতদেহ। অভিযোগ ওঠে, পাশের এলাকায় থাকা তাঁর প্রেমিকার বাবা-সহ একাধিক জন মিলে খুন করেছে ওই যুবককে। কারণ, সেই প্রেম।
জুন, ২০২২। প্রেমিককে বাড়িতে ডেকে মারধর। বাঁচাতে গেলেন তাঁর বাবা। তাঁকেও মার। আহত ছেলেকে উদ্ধারে গিয়ে ছেলের প্রেমিকার পরিবারের মারে খুন হলেন তিনি। এখানে প্রেমিক নন, কিন্তু তাঁর বাবা খুন হয়েছেন একইভাবে! কারণ একই।
সেপ্টেম্বর, ২০২২। নেটমাধ্যমে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসক প্রেমিককে খুন করে প্রেমিকা। ঘটনাটি বেঙ্গালুরুর।
অগাস্ট, ২০২২। রায়নায় অভিযোগ ওঠে মেয়ের প্রেমিককে খুন করেছে প্রেমিকার বাবা! সুরজ মণ্ডল নামে এক যুবককে বাড়িতে ডেকে 'খুন' করে ওই যুবতীর বাবা।
অগাস্ট, ২০২২। পরকীয়ায় বাধা স্ত্রী-কে। পরিকল্পনা করে, প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে আর এক ভালোবাসার মানুষকে শেষ করা। স্বামীকে খুন। প্রায় ১ মাস পর গ্রেফতার মূল অভিযুক্তরা। ঘটনাটি হিমাচল প্রদেশের কাংড়ায়।
সেপ্টেম্বর, ২০২২। সমস্যা সেই প্রেমই। স্ত্রী-র প্রেমিককে নিছক সন্দেহের বশে খুন করে স্বামী। এই ঘটনাটি ঘটে, নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের পীরপুর এলাকায়।
সেপ্টেম্বর, ২০২২। স্বামীকে বিদ্যুতের শক দিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে স্ত্রী-র বিরূদ্ধে। সৌজন্যে সেই প্রেম।
অঙ্কিত সক্সেনা। দিল্লির রঘুবর নগরে এই যুবককে প্রেমিকার পরিবারের হাতে খুন হতে হয়। দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে এই ঘটিবার পরেই। একটি মেট্রো স্টেশনের কাছেই পিটিয়ে খুন করা হয় অঙ্কিতকে।
সেপ্টেম্বর, ২০২১। বিহারের জামুইয়ে ৬ মাসের মধ্যে দুটি প্রেমিক যুগলের দেহ উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় দেহ। অভিযোগ ওঠে প্রেমের অপরাধে প্রেমিককে খুন করেছে প্রেমিকার পরিবারের সদস্যরা।
মে, ২০২২। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর। ২১ বছরের যুবককে পিটিয়ে খুন করে তাঁর প্রেমিকার পরিবারের সদস্যরা। অকালে মৃত্যু হয় সেই প্রেমের জন্য!
জুলাই, ২০২২। বিহারের সীতামূঢ়ি জেলায় খুন হন এক যুবক। অপরাধ প্রেম। প্রেমিকার সাহায্যে, তার পরিবারের সদস্যরা জঙ্গলে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করে ওই যুবককে।
জুলাই, ২০২২। মায়ের প্রেমিককে খুন করে ছেলে। রাজস্থানের রাজকোটে ঘটে এই ঘটনা।
২০০৭ সাল। উত্তরপ্রদেশে মেয়ের প্রেমিককে পিটিয়ে মারে প্রেমিকার বাবা।
এ তো গেল এই দেশের কোণায় কোণায় ঘটা কয়েকটি ঘটনার কথা। একই অবস্থার শিকার পাশের দেশেও হয়েছেন একাধিক।
২০২২ এর সেপ্টেম্বরেই প্রেমিকার হাতে শিমুলিয়ায় খুন হন এক যুবক। অপরাধ সেই প্রেম।
ফেব্রুয়ারি, ২০২২। নরসিংদীর পলাশে খুন হন এক যুবক। তাঁকে খুন করেন তাঁরই প্রেমিকা।
অগাস্ট, ২০২২। গলা কেটে প্রেমিককে খুন করেন তারই প্রেমিকা এবং তার পরিচিতরা। ঢাকার আশুলিয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়।
এছাড়াও বিশ্বেও রয়েছে এই অপরাধের বহু উদাহরণ। কানাডার রিচার্ডসন পরিবারের হত্যা কাহিনি থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়া।
বারবার ঘটেছে একই ঘটনা। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই প্রেমের জন্য প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটেছে নিরন্তর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুন হয়েছেন প্রেমিক। বিপরীতভাবে, প্রেমের জন্যই মরতে হয়েছে প্রেমিকাকে। আবার দু'জনকেই জীবন দিয়ে হিসেব চোকাতে হয়েছে বারবার। কখনও জাতপাত, কখনও ধর্ম, কখনও ব্যাক্তিগত অপছন্দের দোলাচলে মরতে হয়েছে কাউকে কাউকে। যেখানে শুধুমাত্র প্রেমের কারণে প্রেমিকার পরিবারের জন্য অথবা স্বয়ং প্রেমিকার হাতেই জীবন দিতে হয়েছে প্রেমিকদের।
যেখানে মজনুর মতো বিবাগী হয়ে প্রাণ নয়, ওথেলোর মতো পরিণতি নয়, অযাচিত সময়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন অয়ন-জুনিয়ররা। অথবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন রিজওয়ানুররা। প্রত্যেক মুহূর্তে উঠেছে প্রশ্ন। শুরু হয়েছে বিতর্ক। দায় কার, এই ময়নাতদন্ত চলেছে মুহুর্মুহু। কিন্তু অচিরেই প্রাণ গিয়েছে সুতপা, অয়নের। কেউ প্রত্যাখ্যানে হারিয়েছেন জীবন। কেউ অধিকার বুঝতে গিয়ে চলে গিয়েছেন অতলে। অর্থাৎ প্রেক্ষাপট আর মঞ্চ খানিকটা আলাদা হলেও প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই কাহিনি, আর তার প্লট নির্মিত হয়েছে একইভাবে। যেখানে অয়ন মণ্ডল বা রোহিত রামদের মরতে হয়েছে প্রেমের অপরাধে। যেখানে অকালে সরে যেতে হয়েছে সুতপাদেরও। কেউ কেউ বলবেন, যাদের হাতে খুন হচ্ছেন এঁরা, তাদের দিকটাও ভাবা উচিত, কোন পরিস্থিতি তাদের একাজে বাধ্য করছে! যুক্তির মায়াজাল এই প্রসঙ্গে উঠলেও 'দৃশ্যম' ছবির প্রেক্ষাপট, বাধ্য হওয়া আর প্রভাবিত না করতে পেরে, অপছন্দের বশে মেরে ফেলার 'এনএইচ টেন'-এর মতো দু'টো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা বা চিত্রের সৃষ্টি হলেও ফল কিন্তু সেই একই। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে মেরে ফেলাই। অর্থাৎ প্রেমের টানে, প্রেমের জন্য মরে যাওয়াই।
অধিকাংশ ঘটনায় অভিযোগ প্রমাণিত হবে কি হবে না, তা আদলতের বিচারাধীন হলেও প্রেমের জন্য পাগলি অথবা একাধিক পাগলের জীবনত্যাগ, আলোচনার সৃষ্টি করবেই। যেখানে প্রশ্ন উঠবে, তোমার জন্য লড়েছি আমি, করেছি বিশ্বজয়, আমার প্রাণ তোমার তরে, কেন এমন হয়!