দশেরা হয় বাংলাতেও! এই জেলার 'রাবণ কাটা উৎসব' সম্পর্কে আজও জানেন না অনেকেই
সপ্তমী থেকে নবমী পুজোর আনন্দ কাটিয়ে উঠে দশমী থেকে দ্বাদশী অর্থাৎ এই তিনদিন বিষ্ণুপুরের মানুষ মেতে থাকেন প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরার এই নৃত্য উৎসবে।
রাবণ রাখব, না, রাবণ কাটব
শরতের শিউলি আর কাশফুল আগমন বার্তা এনে দেয় যে মা আসছেন। মহালয়া থেকে শুরু করে দশমীর প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্যে দিয়ে পুজোর সমাপ্তি ঘটে। তখন বাঙালির মন খারাপ। কিন্তু মায়ের বিসর্জনের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় অশুভ শক্তির বিনাশ অর্থাৎ রাবন বধ যাকে আমরা ‘দশেরা’ বলে থাকি। আমাদের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে প্রায় ৪০০ বছর ধরে মল্লরাজাদের ঐতিহ্যবাহী এক লোকনৃত্য অনুষ্ঠিত হয় যা ‘রাবন কাটা’ নাচ বলে পরিচিত। অনেকেই হয়তো এই ব্যাপারে অতটা অবহিত নন। সপ্তমী থেকে নবমী পুজোর আনন্দ কাটিয়ে উঠে দশমী থেকে দ্বাদশী অর্থাৎ এই তিনদিন বিষ্ণুপুরের মানুষ মেতে থাকেন প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরার এই নৃত্য উৎসবে।
‘রাবণ কাটা’ আসলে এক রকমের রাবণ বধ। ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যায়, নাচের অনুষ্ঠান শুরু হয় দুর্গা পুজোর শেষ দিন থেকে। এইদিন শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে অভিষেকের মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হয়। পুজোর শিল্পীরা আসেন এবং এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাচ করেন, এরপর তারা রাবনের ভাই কুম্ভকর্ণকে বধের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের নাচ শেষ হয়। বলা হয়, প্রাচীন এই উৎসব শুরু করেন রামায়েৎ বৈষ্ণব গোষ্ঠী অর্থাৎ রামভক্ত বৈষ্ণবেরা। তখন বিষ্ণুপুরের রাজা ছিলেন মল্লরাজা রঘুনাথ সিং। কাটানধার হল বাঁকুড়ার অতি প্রাচীন এক শহর।
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, রাম রাবনের যুদ্ধে কুম্ভকর্ণ ও ইন্দ্রজিতকে আগে বধ করা হয়েছিল। এরপর দ্বাদশীর রাতে রাবণকে বধ করেন রাম। রাবণকে কেটে কেটে খণ্ড বিখণ্ড করা হয় বলেই রাবন কাটা উৎসব। রীতি মেনে একাদশীর সন্ধ্যায় ইন্দ্রজিতকে বধ করা হয়। আর দ্বাদশীর রাতে মন্দির প্রাঙ্গনে রাবণ বধের দ্বারা উৎসব শেষ হয়।
অনেক বছর আগে পর্যন্ত এই লোকনাচ বাংলার দশেরা বলে পরিচিত হলেও আজ সেসব অতীত। বর্তমানে একমাত্র দ্বাদশীর দিন সকাল বেলা থেকে নাচ গানের পর ‘যুদ্ধংদেহী’ রাবণের মূর্তি সাজানো হয়। রাম, সীতা, লক্ষ্মণের মূর্তির সামনেই রঘুনাথ জিউ কাছ থেকে ২১ বার যাতায়াতের পর জাম্বুবান আর সুগ্রীবের নাচের মধ্যেই হনুমান রাবণের গলায় কোপ বসায়।
দুর্গাপুজোর সমাপ্তিতে এই বিষ্ণুপুরে কান পাতলেই শোনা যায় ফিকে হয়ে যাওয়া নাকাড়া, টিকারা, কাঁসি, ঝাঝনের শব্দ। একটি শোভাযাত্রার মতো করে এগিয়ে আসে তারা। প্রথম সারিতে থাকে জাম্বুবান, বিভীষণ, হনুমান আর সুগ্রীব। আর তার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের একটি দল। ৮-৮০ সকলেই সামিল সেই শোভাযাত্রায়। এরপর সেই মুখোশ পরা দল এক এক প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের শিল্প দেখালে কিছু প্রণামী পায়। এইভাবেই প্রচলিত পরম্পরাকে সামনে রেখে বিষ্ণুপুরবাসী পালন করে রাবণ কাটা উৎসব।
মুখোশ ও সাজপোশাক
রাবণ কাটা লোকনৃত্যের মূল আকর্ষণ হল এর মুখোশ। জাম্বুবান (কালো), বিভীষণ (লাল), সুগ্রীব (সাদা), হনুমান (সাদা)। আর এই মুখোশ তৈরি করেন প্রায় ২০০ বছর আগে বিষ্ণুপুরে কাটানধারের বাসিন্দা সুকুমার বারিকের পূর্বপুরুষেরা। মুখোশগুলি গামা জাতীয় নরম কাঠের তৈরি, মাথার দিকে ৫০ টি ফুটো করে তার অপর দিয়ে শন পরিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথার চুল তৈরি করা হয়। দাঁতের ছিদ্র দিয়েই অভিনেতাদের দেখার কাজ সারতে হয়। তাদের মুখে থাকে মুখোশ আর দেহে মুখোশের সঙ্গে মানানসই লোমশ পোশাক। হনুমানের পোশাক ‘ঘিয়ে’ রঙের সঙ্গে মুখোশ আর লোম সাদা। জাম্বুবানের মুখোশ ভালুকের মতো, কালো। বিভীষণের লাল রঙ, মাথায় পাগড়ি, কপালে সাদা ত্রিশূল আর ভ্রূ-গোঁফ কোঁচকানো। সুগ্রীবের মুখোশ বানরের আদলে তৈরি। নাচের সময়ে প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ছামধারীর পোশাক থেকে পশমের লোম ছিঁড়ে নিজের ঘরে রাখলে নাকি দূষিত জ্বর থেকে পরিবারের লোকেরা রক্ষা পায়।
রাবণ কাটা নাচের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। নাচের দুটি ভাগ – দেবচাল ও রাক্ষস চাল। প্রথম নৃত্যে আছে লালিত্য আর পরের নৃত্যে আছে বলিষ্ঠতা। শিল্পীরা নিজের দক্ষতায় লাফ দেন।
রাবণকাটাকে কেন্দ্র করে বানানো হয় মাটির এক বিশাল মূর্তি এবং তার সাথে সাজানো হয় রঘুনাথের রথ। দশমী থেকে দ্বাদশী এই তিনদিন ধরে প্রত্যেক শিল্পী গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরে ঘুরে ঘুরে নাচ দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। উৎসবের শেষ দিন রাতে জমা হয় মন্দির প্রাঙ্গনে। অষ্টধাতুর রঘুবীর মূর্তিকে রথে বসিয়ে জাম্বুবান, বিভীষণ, সুগ্রীব আর হনুমানের সঙ্গে গ্রামের লোকেরাও উল্লাস করতে করতে এগিয়ে যান রাবণের উদ্দেশ্যে। জাম্বুবানের হাতে থাকা তরোয়াল দিয়ে রাবণের মস্তক ছেদনের মধ্য দিয়ে উৎসবের শেষ। এরপর সেই রাবণের মূর্তিকে ভেঙে ফেলা হয়। আচার অনুযায়ী অনেকেই রাবণের এই মূর্তি ভাঙা মাটি ঘরে নিয়ে রাখেন, তাদের সংসারের মঙ্গল কামনার জন্য।
আরেকটি প্রচলিত বিশ্বাস এও যে, যে বা যিনি তরোয়াল দিয়ে রাবণের মাথা কাটেন, তার বংশ নাকি লোপ পায়। আগেও দেখা গেছে, যিনি রাবণের মাথা কেটেছেন হয় তিনি গাড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙেছেন নয়ত পঙ্গু হয়ে গেছেন। এই কারণে এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিল্পী আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।
অকালে দেবী দুর্গার বোধন করে শক্তিধর হয়েছিলেন রামচন্দ্র। সেই কাহিনিকে ধরে রেখেই আজও এই বিষ্ণুপুরে রাবণ কাটা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। তবে এই লোকনৃত্য সম্বন্ধে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। যারা এই নৃত্য উৎসবে যোগ দেন তারা নিতান্তই দিন মজুরের পরিবার। বছরের সারা বছর দিন আনে দিন খায় অবস্থা কিন্তু পুজোর দশমী থেকে দ্বাদশী তাদের কাছে আনন্দের সময়। তারপর আবার সেই দিন মজুরের কাজে ফিরে যাওয়া। আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই রাবণ কাটা উৎসবের শিল্পীরা। আর্থিক অনটন সহ্য করে অনেক তরুণ প্রজন্ম তাদের এই সংস্কৃতি বজায় রাখতে চাইছে কিন্তু তারা কেউই আর গামার পোশাক আর পাটের আলখাল্লা পড়তে রাজি নয়।
রাবণ কাটা নাচের শিল্পীদের কথায়, ‘আগে বিষ্ণুপুর মেলায় তাদের ধরাবাঁধা অনুষ্ঠান থাকত কিন্তু এখন কোনও ডাকও আসে না’। তাদের আরও অভিযোগ প্রাচীন শিল্পের প্রসারে প্রশাসন কোনওভাবেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তবে আগামী প্রজন্ম এই লোকনৃত্য ধারা বজায় রাখবে কিনা তা নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন।

Whatsapp
