জামার তলায় চুরি করা রুশদি! বইমেলায় ক্রমেই ফিকে হচ্ছে বইপাগলরা
Kolkata Book Fair 2023: ক্ষমতা প্রকাশের তাগিদে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা বই প্রকাশ করেন। জানতে খুব ইচ্ছা করে, বছরের অন্যান্য সময় বইগুলির কী অবস্থা হয়।
একটা শহর, যে শহর ভীষণ রাগে যুদ্ধ করতে জানে, আবার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করতেও জানে, সেই শহর মাঝে মাঝে মত্ত হয়ে ওঠে। এই মত্ততা আক্রোশের নয়, আনন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বা নন্দন, আকাদেমিতে যখন শহরের লোকজন দিকশূন্য চিন্তা করতে করতে আর সিগারেটের কাউন্টারে প্যাসিভ চুমু খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন সে আসে। শহরে মেলা আসে! কংক্রিটের জঙ্গলে মেলা লাগে। কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। এই একটা মেলা এখনও, এই মেলা-খেলায় মেতে থাকা রাজ্যের সবক'টা মেলাকে বলে বলে দশ গোল দিতে পারে। এই শহরের এত মানুষ থাকা যেমন অবিশ্বাস্য, অর্ধেককেই যেমন ভূত বলে মনে করেন লীলা মজুমদার থেকে সৃজিত মুখোপাধ্যায় অনেকেই, তেমনই এই একটা শহরে এত বই থাকতে পারে কী করে তাও আস্ত বিস্ময়! বইমেলায় আর সেরকম টান নেই, বইমেলায় আর সেই ঐতিহ্য নেই, বইমেলায় নতুন কিছু নেই- এসব অভিযোগ মাথায় নিয়েই তবু সে অনড়। বইকে কেন্দ্র করে জমাট বাঁধা এক জন সমাবেশ যেন! বই কেনা, বই খুঁজে মরা, বই হারানো, বই চুরি, বইয়ের ভাঁজে জন্মানো প্রেম, প্রথম প্রতিবাদের গন্ধ- সবটুকুই সময় বদলে বদলে এখনও আছে। খুঁজতে হলে অলি-গলি ঢুকে পড়তে হবে মেলার। দেখতে হবে, বইকে ঘিরে কী বিপুল এক শিল্প গড়ে উঠেছে রাজ্যে। অনলাইনের দাপটের মাঝেও সে কী ভাস্বর! এই শহর বইপাগলদের নিজস্ব আস্তানা, এই শহর সারা রাজ্যের বইপ্রেমীদের তীর্থ!
যে রাজ্যে চাকরি চুরি হয় প্রতিদিন নিয়ম করে, যে রাজ্যের শিক্ষা দফতরের ৯০ শতাংশই সেন্ট্রাল (বা প্রেসিডেন্সি) জেলে মশা মারতে ব্যস্ত, সেই বাংলায় এখনও বইমেলায় (যা বৃহৎ অর্থে দেখতে গেলে শিক্ষা সম্পর্কিতই মেলা) মানুষ অষ্টমীর একডালিয়ার মতোই ভিড় করে, এ সম্ভবত বাংলা বলেই সম্ভব। তবে হ্যাঁ, পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যে শিক্ষা চাকরি চুরি হলেও বইমেলার বই চুরির ট্র্যাডিশন কিন্তু গত বইমেলা থেকে একদম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এও একটা পরিবর্তন বটে!
বইমেলা ও বই চুরি নিয়ে এক অধ্যাপকের কাছে শোনা একটি গল্প মনে পড়ছে। তখনও বইমেলা ময়দানে হয়, কোনও একটি স্টলে আমাদের সেই অধ্যাপক (যিনি তখনও অধ্যাপক হননি) ও তাঁর এক বন্ধু ঢুকেছেন। স্যারের সেই বন্ধুর হাতে নাকি জাদু ছিল, সেই জাদু বইমেলাতেই দেখা যেত। এবার সেই বিশেষ স্টলে হাতের খেলা দেখিয়ে সেই বন্ধু সলমান রুশদির একটি বই জামার মধ্যে চালান করে দেন ও নির্বিকার মুখে স্টল থেকে বেরিয়ে আসেন। মেলার মাঠের অন্যপ্রান্তে এসে যখন তিনি বইটা জামার তলা থেকে বের করে দু' এক পাতা উল্টে দেখছেন, তখনই কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। সেদিন সম্ভবত বন্ধুর হাতের জাদু সম্পূর্ণ কাজ করেনি, স্টলের কোনও এক কর্মীর নজরে এসে যায় ব্যাপারটা। পরবর্তীতে স্যারের সেই বন্ধু রুশদির বইয়ের কিছুটা অংশ বাংলায় অনুবাদ করে পড়ে শুনিয়ে তবে ছাড়া পেয়েছিলেন। সৌভাগ্যের বা দুর্ভাগ্যের বিষয়, কলকাতা বইমেলায় এই ট্র্যাডিশন এখন আর নেই।
বইমেলায় প্রতিবছর এত বই লেখা হচ্ছে, ছাপা হচ্ছে, এবং তা বিক্রিও হচ্ছে! ভাবলে অবাক লাগে, এত লেখা আসে কোথা থেকে? আর সেই বইতে লাভই বা কত হয়? একটু গভীরে গিয়ে দেখলে যে চিত্রটি দেখা যাবে, বইমেলার বেশিরভাগ বই-ই লেখক নিজের পকেটের পয়সা খরচা করেই প্রকাশ করেন, অনেক বই থেকে কানাকড়িও লাভ হয় না। কিন্তু বইমেলায় বই প্রকাশের আবেগের কাছে লাভ-লোকসানের দাঁড়িপাল্লা ফুৎকারে উড়ে যায়। বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাসে একবার এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনিও বইমেলা থেকেই ফিরছেন। কথা বলে বোঝা গেল, এত বাংলা বই দেখে যারপরনাই বিরক্ত তিনি। এত বই ছাপিয়ে পয়সা নষ্ট করা নিয়েও বাঙালিদের একপ্রস্থ তুলোধোনা করলেন। নতুন বইয়ের গন্ধের মাদকতা সবাইকে ছোঁয় না স্বাভাবিকভাবেই। তবে যাঁদের ছোঁয় তাঁরাই জানেন, এ কোন ফাঁদ! তবে এমন অনেক বই বইমেলায় এমনও থাকে যা বইমেলার পরে ধুলোর চাদরে ঢেকেই থাকে। ক্ষমতা প্রকাশের তাগিদে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা বই প্রকাশ করেন, তাঁদের কবিতা-অকবিতা নিয়ে বিস্তর তর্কও হয় ফি বছর। জানতে খুব ইচ্ছা করে, বছরের অন্যান্য সময় বইগুলির কী অবস্থা হয়। এই থরে থরে প্রকাশিত বই আসলে বইপ্রেমীদেরই বা কোথায় নিয়ে যায়? বইয়ের জন্য বাঁচতে ভালোবাসা মানুষের জীবনে এই গুচ্ছ গুচ্ছ পুস্তক কি আগের মতোই ঢেউ তোলে, এখনও?
যে মানুষটির বন্ধু সংখ্যা খুব সামান্য, বইমেলায় তাঁরাও দু' একজন চেনা মুখ ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবেনই মেলায়। দীর্ঘ দীর্ঘকাল দেখা না হওয়া বন্ধুদের পুনর্মিলন কেন্দ্র হয়ে ওঠে ধুলোবালির বইমেলা। প্রেমের আকর হয়ে ওঠে বইমেলার ধুলো, বই আর প্রেম মাখামাখি হয়ে কলকাতার সন্ধ্যাকে আরও মগ্ন করে তোলে। বাড়ি বদলে বদলে এক রাজধানীতে সে শীত বসন্তের চৌকাঠে একা ধ্রুবতারা। আকাদেমির উল্টোদিকের মাঠ, কলকাতা ময়দান, পার্ক সার্কাস, যুবভারতী, করুণাময়ী সেন্ট্রাল পার্ক, বাসা বদলে বদলে সে তবু নিজের শিকড় বদলায়না। ৪৬ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় মানুষ আসলে নিজেরই শিকড় খুঁজতে আসে, বইয়ের সঙ্গে নাড়ির টান খুঁজতে আসে। ফিকে হয়ে আসা নিজেকে খুঁজতে আসে।