কোথায় হারাল ঘসেটি বেগমের লুকোনো ধনসম্পদ?
ঐতিহাসিক শহর মুর্শিদাবাদ, আবার বলা চলে নবাবদের শহর। নবাব যুগের ইতি বহুপূর্বে ঘটলেও, নবাবিয়ানা আজও এই শহরে দৃশ্যমান। ঘোড়ায় টানা গাড়ি বোধহয় তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। এই শহরের কানাঘুষো গলিগুলিতেও যেন লুকিয়ে আছে নানা ইতিহাস, লুকিয়ে আছে আরও কতো অজানা তথ্য। শহরে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলির সামনে দাঁড়িয়ে আপনার মনে হতেই পারে, সময় যেন দু-তিনশত বছর পিছিয়ে গেছে। হাজারদুয়ারিতে অবস্থান করা নানান আসবাবপত্রগুলি একদিকে যেমন বাংলায় ঐশ্বর্যের রমরমার কথা বলে, আবার অন্যদিকে হয়তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেদিন স্বাধীনতার সূর্য কেন পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিল। শহরের একপ্রান্তে মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা আবার অন্যপ্রান্তেই রয়েছে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের গোটা পরিবার। এতো স্থানের মধ্যেই রয়েছে ঘসেটি বেগমের শখের প্রাসাদ আর মতিঝিলও।
ফিরে যাওয়া যাক বেশ কয়েকশো বছর আগে। গিরীয়ার যুদ্ধে নবাব সারফরাজ খাঁ’কে পরাজিত করে বাংলার মসনদে বসেছেন আলিবর্দী খাঁ। এইসময় থেকেই বাংলার শাসন ক্ষমতা ক্রমে দিল্লি থেকে স্থানান্তরিত হতে থাকে মুর্শিদাবাদে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদই হয়ে উঠেছিল বাংলার শাসনকেন্দ্র। যাই হোক, মসনদে বসার পরেই আলিবর্দী খাঁ সেখানে ডেকে নেন তাঁর প্রিয় কন্যা মেহের-উন-নিশা বেগমকে, যিনি অধিক পরিচিত ঘসেটি বেগম হিসাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নবাবকন্যার সঙ্গে মুশির্দাবাদে পা রাখেন কন্যার স্বামী এবং আলিবর্দীর জামাতা, ঢাকার দেওয়ান নওয়াজিস মোহাম্মদ শাহমত জং। তাঁদের দুজনের জন্য নবাব গড়ে দিলেন এক সুন্দর প্রাসাদ, যা পরিচিত ছিল ‘সাঙ্গ-ই-দালান’ নামে। এখানেই শেষ নয়, পাশে আবার কাটা হল একটি ঝিল। যদিও কেবলমাত্র সৌন্দর্য বৃদ্ধি এই ঝিলের উদ্দেশ্য ছিল না, নিরপত্তার বিষয়টিও মাথায় রেখে বানানো হয়েছিল ঝিলটি কারণ এই সময়তেই গোটা বাংলা জুড়ে একাধিকবার লুটপাট চালিয়েছিল বর্গীরা। ঘসেটি বেগমের স্বামীর ছিল মতি অর্থাৎ মুক্তোর শখ, তাই তিনি নবাব নির্মিত ঝিলকেই বেছে নিলেন এই মুক্তো চাষের ক্ষেত্র হিসাবে। এই মতি চাষের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গোটা অঞ্চল নাম পায় মতিঝিল হিসাবে।
এইভাবে সুখে-শান্তিতেই বেশ কয়েকবছর কেটে যায়, ঘসেটি বেগম তাঁর স্বামী এবং পালিত পুত্র নিয়ে এক মনোরম পরিবেশে দিন গুজরান করেন। কিন্তু এই সুখের ব্যাঘাত ঘটে পলাশি যুদ্ধের কিছু আগের থেকে। একথা কারোরই অজানা নয়, পলাশি ষড়যন্ত্র মূল ঘাঁটি ছিল এই ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। তাই খবর পেয়ে নবাব সিরাজদৌল্লা হঠাৎই একদিন মতিঝিল আক্রমণ করেন। নিজগৃহেই আটক করেন মাসি মেহের-উন-নিশাকে। এই ঘটনার আগেই আকস্মিক রোগে ভুগে মৃত্যু ঘটেছিল ঘসেটি বেগমের স্বামী এবং পালিত পুত্রের। সুতরাং মতিঝিল অধিগ্ৰহণ করে তরুণ নবাব সিরাজ। এরপর সিরাজ এখানেই বিলাসবহুল জীবনে মেতে ওঠেন এবং কথিত রয়েছে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদ দেখে, এই প্রাসাদের অনুকরণে তিনি নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন হিরাঝিল প্রাসাদ। এরপরেই সময় আসে পলাশির। শোনা যায়, এই মতিঝিলের প্রাসাদ থেকেই তিনি পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা দিয়েছিলেন। তবে সিরাজের ফেরা হয়নি মতিঝিলে, তার সঙ্গেই নিজের সাধের প্রাসাদে আর ফেরা হয়নি ঘসেটি বেগমেরও। কথিত রয়েছে, পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করার পর মীরজাফরের পুত্র মীরণ তাঁকে বুড়িগঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করে।
ওই সময় থেকেই মানুষের মনে একটি জিনিস নিয়ে প্রশ্ন দানা বাঁধতে থাকে। ঘসেটি বেগম ছিলেন বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের কন্যা আবার অন্যদিকে ছিলেন ঢাকার দেওয়ানের স্ত্রী, তাই তিনি যে বিশাল আকারের এক ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন, একথা বলার অবকাশ রাখে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে, কোথায় গেল সেই সব ধন? সেই প্রশ্ন আজও কেবল প্রশ্নই থেকে গেছে। অনেকে বলে থাকেন, ঘসেটি বেগমকে গৃহবন্দি করার পরে সিরাজ নিজেই সেই সম্পদ লুঠ করে তাঁর হীরাঝিলে সঞ্চয় করে রাখে। পরবর্তী সময়ে মীরজাফর যা আত্মস্বাদ করে। কিন্তু এখনও বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, সিরাজের মতিঝিল আক্রমণের খবর আগে থেকে পেয়ে, ঘসেটি বেগম মতিঝিলের এই ঘরে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি লুকিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, সেগুলিকে আরও নিরাপদ করার জন্য এবং সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটানোর জন্য তিনি সেই ঘরের জানালা-দরজা অবধি ইট দিয়ে গেঁথে দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন একদিন তাঁর এই রূদ্ধ অবস্থার অবসান ঘটবে কিন্তু তা আর হয়নি। মতিঝিলে সত্যিই এমন একটি ঘর আজও বর্তমান। এই ঘরটির অবস্থান মতিঝিল মসজিদ বা কালা মসজিদের ঠিক পাশেই। ইংরেজ আমলে মতিঝিল পরিণত হয়েছিল ‘কোম্পানিবাগ’ নামে। নতুন করে সেইসব সঞ্চিত সম্পদ খোঁজার কাজ শুরু হয়। অনেক ইংরেজ আধিকারিকই এই ধনভাণ্ডারের খোঁজ চালান অবশেষে খাজনার লোভে কামানও দাগা হয় একবার। এতকিছুর পরেও ঘরটিকে ভাঙা যায়নি। কামানের গোলার দাগ এখনো দেখা যায় ঘরটির গায়ে। বিস্ময়কর ঘটনাটি হল, এই ঘরটি ভাঙার কাজে যারা যুক্ত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই মুখে রক্ত উঠে মারা যান। এই ঘটনার পরে আর কেউ ঘরটি নিয়ে কেউ বিশেষ আগ্ৰহ দেখায়নি। ঘসেটির ধনসম্পত্তির রহস্য আজও সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্র –
১।https://www.prohor.in/the-mysteries-behind-the-treasure-of-ghasheti-begum