প্রথম ভারতীয় দৃষ্টিহীন মহিলা হিসেবে এভারেস্ট জয়, অনুপ্রেরণার নাম ছোনজিন অ্যাংমো

Chhonzin Angmo Mount Everest: ২০১৮ সালে সাইকেল চালিয়ে মানালি থেকে খার্দুং লা যান অ্যাংমো। যা ১৮,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটরযান চলাচলের রাস্তার মধ্যে একটি।

মাত্র আট বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারান হিমাচলী কন্যা ছোনজিন। ভারত-তিব্বত সীমান্তে হিমাচল প্রদেশের কিন্নৌর জেলার প্রত্যন্ত চাঙ্গো গ্রামে জন্ম তাঁর। ১৯ মে প্রথম ভারতীয় দৃষ্টিহীন মহিলা হিসেবে এভারেস্ট জয় করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন অ্যাংমো। দৃষ্টিহীন হয়েও বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় সারা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির গড়ে তুলেছে। অনুপ্রেরণার অন্য নাম ছোনজিন অ্যাংমো। তিনি প্রমাণ করেছেন প্রতিবন্ধকতা কোনও বাধা নয়। দৃষ্টিহীন হলেও লক্ষ্য নিশ্চিত ছিল তাঁর। অ্যাংমো পিটিআই-কে জানিয়েছিলেন, তাঁর গল্প সবে শুরু, দৃষ্টিহীনতা তাঁর দুর্বলতা নয় বরং শক্তি। ছোট থেকেই পাহাড় চড়ার স্বপ্ন ছিল এই পাহাড়িয়া কন্যার। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। "এখন আমি বাকি সব চূড়ায় আরোহণ করব", বলেছিলেন ছোনজিন।

অ্যাংমোর এই সাফল্যে তাঁর পরিবারের পাশাপশি গর্বিত সারা গ্রামবাসী। অ্যাংমোর বাবা অমর চাঁদ পিটিআইকে বলেন, "আমার মেয়ে আমাকে গর্বিত করেছে এবং আমরা সবাই ওঁর কৃতিত্বে খুব খুশি।"

হিমাচলের এক ছোট গ্রাম থেকেও যে বড় স্বপ্ন দেখা যায়, তা প্রমাণ করেছেন অ্যাংমো। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরান্ডা হাউস থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। বর্তমানে দিল্লিতে ইউনিয়ন ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে গ্রাহক পরিষেবা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

আরও পড়ুন- দুর্ঘটনা কেড়েছিল দুই পা, এক হাত! সব অক্ষমতাকে হারিয়ে যেভাবে এভারেস্ট ডিঙোলেন যুবক

তবে, মাউন্ট এভারেস্টই অ্যাংমোর প্রথম পর্বত আরোহণ নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতীয় দৃষ্টিহীন মহিলা হিসেবে মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্পে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৩৬৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত) ট্রেকিং করেছিলেন। এর আগে লাদাখের মাউন্ট কাং ইয়াতসে ২ (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,২৫০মিটার উঁচুতে অবস্থিত) আরোহণ করেন। এছাড়া একটি বিশেষভাবে সক্ষম দলের সঙ্গে একটি ৬,০০০ মিটার উঁচু শৃঙ্গ জয় করেন। একের পর এক কৃতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর নজরেও আসেন অ্যাংমো। ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ছোনজিন অ্যাংমোর বিষয়ে বলেন নরেন্দ্র মোদি।

অ্যাংমো শুধু একজন পর্বতারোহীই নন, একজন প্রতিভাবান অ্যাথলিটও। রাজ্যস্তরের সাঁতারে সোনার পদক জেতেন তিনি। এছাড়া জাতীয় স্তরের জুডোতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অসংখ্য ম্যারাথনেও অংশগ্রহণ করেছেন। জাতীয় স্তরের ম্যারাথনে দু'টি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছেন এবং তিনবার দিল্লি ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করেছেন। এরইসঙ্গে পিঙ্ক ম্যারাথন এবং দিল্লি বেদান্ত ম্যারাথনেও অংশগ্রহণ করেছেন। আঞ্চলিক এবং জাতীয় উভয়স্তরেই ফুটবলও খেলেছেন অ্যাংমো।

পর্বতারোহণের স্বপ্ন পূরণের জন্য ২০১৬ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যালাইড স্পোর্টস থেকে একটি কোর্স করেন অ্যাংমো। যেখানে সেরা প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে মনোনীত হন তিনি।

এখানেই শেষ নয়, সাইক্লিং চ্যালেঞ্জও নিয়েছেন অ্যাংমো। ২০১৮ সালে সাইকেল চালিয়ে মানালি থেকে খার্দুং লা যান অ্যাংমো। যা ১৮,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটরযান চলাচলের রাস্তার মধ্যে একটি। এই যাত্রাপথে হিমাঙ্কের তাপমাত্রার সম্মুখীন হন অ্যাংমো। সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করতে ১০ দিন সময় লেগেছিল তাঁর।

আরও পড়ুন- রাধানাথ শিকদার না থাকলে জানা যেত না উচ্চতা, তাও এভারেস্টের নাম এভারেস্ট হলো কেন?

এরপর ২০১৯ সালে মাত্র ছয়দিনে নীলগিরির মধ্য দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ভারতের তিনটি রাজ্য অতিক্রম করেন তিনি। এছাড়া গতবছর জুলাইয়ে মানালি থেকে কল্পা পর্যন্ত আরেকটি সাইক্লিং অভিযান সম্পন্ন করেন অ্যাংমো। সাতদিনে স্পিতি ভ্যালি এবং কিন্নৌর অতিক্রম করার রেকর্ডও আছে তাঁর ঝুলিতে।

সিয়াচেনেও ইতিহাস রচনা করেছেন। ২০২১ সালে অপরেশন ব্লু ফ্রিডমের অংশ বিশ্বের সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন হিমবাহে  পর্বতারোহণকারীদের বিশেষ দলে একমাত্র মহিলা পর্বতারোহী ছিলেন অ্যাংমো। এর মাধ্যমে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন তিনি।

অসামান্য সব কৃতিত্বের জন্য একাধিক জাতীয় পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন অ্যাংমো। বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের নজির হিসেবে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ দিব্যাঙ্গজন জাতীয় পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি ন্যাব মধু শর্মা ইয়ং অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, আন্তর্জাতিক বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি দিবসে দিল্লি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ব্লাইন্ড থেকে পুরস্কৃত হন এবং কাভিঙ্কারে এবিলিটি মাস্টারি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। জীবনে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সদিচ্ছা থাকলে কোনও বাধাই অতিক্রম করা যে আসলে কোনও ব্যাপারই না, তা নিজের জীবনের একের পর এক কৃতিত্ব ও সাফল্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন ছোনজিন অ্যাংমো।

More Articles