কেন নিম্মবর্গকে না জানলে অজানাই থাকে ভারতের ইতিহাস? যে দরজা খুলে গেলেন রণজিৎ গুহ...
Historian Ranajit Guha Passes Away: কলকাতায় এসে রণজিৎ জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। সিপিআই-এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ মানতে পারেননি। ছাত্রাবস্থা থেকে যে দল ছিল তাঁর চেতনার খোলা আসমান, সেই আকাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। অথচ আজীবন কাজ করে গেলেন শ্রেণিচেতনা, শ্রেণি দ্বন্দ্ব এবং সমাজ যাদের 'নিম্নবর্গ' করে দাগিয়ে রেখেছে সেই মানুষদের নিয়ে। আর প্রায় মাস খানেক পরেই শতবর্ষ ছুঁতেন। তার আগেই মৃত্যু ছুঁল তাঁকে। প্রয়াত হলেন ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ, অস্ট্রিয়ায় নিজের বাসভবনেই।
১৯২৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশের বরিশালের বাখরগঞ্জের সিদ্ধকাটি গ্রামে জন্ম৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রে তালুকদার ছিল তাঁর পরিবার। বয়স যত বেড়েছে শ্রেণি-পরিচিতির গ্লানি কুরে কুরে খেয়েছে রণজিৎ হগুহকে। সম্ভবত সেই গ্লানি থেকেই সাবঅল্টার্ন ইতিহাস নিয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় এসে রণজিৎ জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। সিপিআইয়ের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হিসেবে ১৯৪৭ সালে প্যারিসে বিশ্ব ছাত্র সম্মেলনেও যোগ দেন। তারপর সাইবেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও চিন বিপ্লব স্বচক্ষে দেখেন, দলের প্রতিনিধি হিসেবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেপথ্যে তাত্ত্বিক ভাবনা নিয়ে লিখতে থাকেন ধারাবাহিক।
১৯৮০ সালে সাবঅল্টার্ন তথা নিম্নবর্গের মানুষ বিষয়ে তত্ত্ব হাজির করেন রণজিৎ গুহ, অক্সফোর্ড থেকে তা প্রকাশিত হলো। রণজিৎ গুহর মতে, ভারতীয় ইতিহাস যেভাবে লিখিত হয়েছে তাতে উচ্চবর্গকে স্বতঃসিদ্ধ আলোচনার বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। নিম্নবর্গের দিকে কানাকড়ি আলোও পড়ে না। অথচ ঐতিহাসিক যদি সেই দিক দিয়ে দেখেন, অন্য কাহিনি উঠে আসবে৷ রণজিৎ গুহ আশির দশকে চূড়ান্ত রাজনৈতিক সাবঅল্টার্ন মুখপত্রগুলি সম্পাদনার ভার নেন। গ্রামশি, ফুকো, রলা বার্ত ও ক্লদ লেভি স্ত্রসের গঠনবাদের ভিত্তিতে, নিজের কিছু বিষয় যোগ করে, অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের একটি কাঠামো তৈরি করেন৷ এই কাঠামোর প্রেক্ষিতেই ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসকে খুঁড়ে দেখতে চান রণজিৎ। ভারতে কৃষক অভ্যুত্থানের গঠনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে লিখলেন রণজিৎ৷ উৎসকে সত্য হিসেবে না ধরে একটি বয়ান হিসেবে পড়তে শেখালেন রণজিৎ, শেখালেন ইতিহাস দর্শন।
আরও পড়ুন- হোমার থেকে শেক্সপীয়র, কালের যাত্রায় চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে যে বিখ্যাত বইগুলি
নব্বই দশকের আগেই নৃতত্ত্ব পড়াতে ক্যানবেরায় চলে যান রণজিৎ গুহ। ভাষাদর্শন নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি, ঘেঁটে দেখতে থাকেন প্রাচীন ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব, হাইডেগারের প্রপঞ্চদর্শন ও হেগেলের ভাববাদ। তার বহু বছর পর সাসেক্সে গবেষণা করতে চলে যান রণজিৎ, সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণা 'আ রুল অব প্রপার্টি'। রণজিৎ গুহের মতে, সাম্রাজ্যবাদীরা যে বিশ্ব সাম্রাজ্য তৈরির খোয়াব দেখেছিল, সেই চিন্তাভাবনা উপনিবেশের ছকভাঙা পরিস্থিতিতে খাটেনি। বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরির বদলে তৈরি হয়েছিল স্বত্বভোগী পরভৃৎ-জমিদার শ্রেণি।
ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর লেখা বইতে এ দেশের গণতান্ত্রিক বোধে কৃষকের ভূমিকা তুলে ধরেন রণজিৎ। সত্তরের দশকের শুরুতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশালপন্থী ছাত্রদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ‘বিশ শতকের সবচেয়ে সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক' ভারতীয় ইতিহাসকে দেখেছিলেন সাবঅল্টার্ন দর্শনে, এদেশের শিকড়ে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন সত্য ঘ্রাণ, নিম্নবর্গের ঘাম। রণজিৎ নেই, তবু, তারই পথে ইতিহাস দর্শনের একাধিক দরজা খুলে দিয়েছেন তারই ছাত্রছাত্রী, গবেষকরা।