একই দেহে কৃষ্ণ-কালী
Temple: কৃষ্ণ-কালীর পূজা শুধু ধর্মীয় আরাধনা নয়, এটি শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক। কৃষ্ণ ও কালীর সম্মিলিতরূপ শাক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার গড়জঙ্গলে শ্যামরূপা মন্দির বিশেষ প্রসিদ্ধ। জনশ্রুতি আছে,কবি জয়দেব দেবীর এই নামকরণ করেছিলেন। শাল-সেগুন-মহুয়ার গড়জঙ্গলে বর্তমানে শেয়াল ও বুনো শুয়োরের বাস। এই গড়জঙ্গলেই প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন রাজা সুরথ। মেধসমুনির সমাধিস্থলরূপেও গড়জঙ্গল পরিচিত। কথিত আছে, বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলা আক্রমণ করেন, তখন লক্ষণ সেন এখানেই আশ্রয় নেন। শোনা যায়, তিনি এখানে কিছুদিন লুকিয়েও ছিলেন। সেই সুত্রেই গড়জঙ্গলের আর এক নাম সেনপাহাড়ি।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, বহুকাল আগে গড়জঙ্গলে থাকতেন এক কাপালিক। সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য তিনি নরবলি দিতেন। পরবর্তীকালে কবি জয়দেবের কৃষ্ণভক্তির কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। উল্লেখ্য, এই জঙ্গলেই দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন জয়দেব। তাঁর ভক্তিতে সাড়া দিয়ে মা চণ্ডী তাঁকে কৃষ্ণরূপে দেখা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরের নাম হয় শ্যামরূপা মন্দির। দেবীর বিগ্রহরূপ এখানে যুদ্ধরতা।
রাঢ়বাংলার প্রাচীন কাব্য 'ধর্মমঙ্গল'-এর অন্যতম চরিত্র ইছাই ঘোষ। চরিত্রটির ঐতিহাসিক পরিচয়ও আছে। তিনি নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। একদা গড়জঙ্গল ছিল গোপভূমি। তখন এখানকার নাম ছিল ঢেকুরগড়। ইছাই ঘোষের আরাধ্যা দেবী ছিলেন শ্যামরূপা এবং ইছাই ঘোষ নিজে একজন তান্ত্রিক ছিলেন। অসংখ্য কিংবদন্তী আছে তাঁকে নিয়ে। যেমন জানা যায়, এখানেই ইছাই ঘোষ ও ধর্মরাজ লাউসেনের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। ইছাই ঘোষ নিম্নবর্গের মানুষজন নিয়ে নিজের সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। মন্দিরের সুড়ঙ্গ-পথে একটি নালা দেখতে পাওয়া যায়। কথিত, ওই নালা দিয়ে বলির সময় রক্ত বয়ে যেত। এবার অনেকের মত, ইছাই ঘোষ ও লাউসনের যুদ্ধে রক্তও প্রবাহিত হয়েছিল ওই রক্তনালা দিয়েই।
মন্দিরের কাছেই দেবী চৌধুরানীর গুহা-সুড়ঙ্গের মুখ। পাশেই রয়েছে প্রাচীন একটি ওয়াচ টাওয়ার। মন্দিরে ভোগগৃহ আছে। প্রসঙ্গত, মন্দিরের ঠাকুর মশাইকে সকালে জানিয়ে রাখলে দেবীর ভোগ পাওয়া যায়। আসলে, প্রকৃতি ও ইতিহাস মিলে এই স্থান ও মন্দিরটি পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের বিষয়!
আরও পড়ুন
শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে আনা হতো পুজোয়, চমকে দেয় উত্তর কলকাতার কালী মন্দিরের ইতিহাস
শ্যামনাম ছাড়াও কৃষ্ণ নামের সঙ্গে যুক্ত দেবী কালীর কিছু মন্দির বাংলায় লক্ষিত হয়। কৃষ্ণকালীর ধারণাটি বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও লোককথায় পাওয়া যায়। এই কৃষ্ণকালীর পূজা শুধু ধর্মীয় আরাধনা নয়, এটি শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক। কৃষ্ণ ও কালীর সম্মিলিতরূপ শাক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রজধামে রাধারাণী গোপিনীসহ যখন কৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করছিলেন, তখন জটিলা-কুটিলা রাধার স্বামী আয়ানদ্বীপ ঘোষকে নালিশ করেন। আয়ান রাধাকে ধরতে এসে দেখেন রাধা নিষ্ঠাসহ কালীর পূজা করছেন। আসলে কৃষ্ণ তখন রাধার সামনে কালীরূপ ধারণ করে দাঁড়িয়েছিলেন। রাধার দেবীভক্তি দেখে কালীভক্ত আয়ান তখন খুবই আনন্দিত হন। এই ছিল পুরাণের কাহিনি। অনেকের মতে, সেই থেকেই জগতে কৃষ্ণকালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
দেবীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী বা রটন্তী চতুর্দশী তিথিতে। 'রটনা' শব্দের অর্থ প্রচার হওয়া। দ্বাপর যুগে এই তিথিতেই জগন্মাতা মুক্তকেশী শ্রী শ্রী রটন্তী কালীর অপার মহিমা ধরাধামে প্রচারিত হয়। কৃষ্ণকালীর ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী মা কৃষ্ণবর্ণা, চতুর্ভুজা, চূড়ামুকুটমন্ডিতা। দেবীর দক্ষিণ হস্তে শঙ্খ ও খর্পর, বাম-হস্তে দেবী খড়্গচক্রধারিণী, মুন্ডমালা বিভূষিতা। তিনি গোপিনী পরিবৃতা, নানা অলংকারে সুসজ্জিতা। চতুর্বর্গ প্রদানকারিণী দেবী ব্রহ্মরূপা সনাতনী। দারিদ্র্য শোকনাশকারিণী ও মোক্ষদায়িনী।
বাংলার মন্দির প্রসঙ্গে জানাই, হুগলী জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত শ্রীপতিপুর গ্রামে সবুজকালীর মন্দির বিশেষভাবে বিখ্যাত। এই গ্রামের অধিকারী পরিবারে দীর্ঘকাল সবুজ রঙের কালী পূজিতা হচ্ছেন। মা কালীর গায়ের রঙ নিকষ কালো বা সাধারণত শ্যামলা হয়। কিন্তু এখানে কালীর গায়ের রঙ সবুজ। কালীর প্রিয় ফুল জবার বদলে জুঁই দিয়ে পূজা করা হয়। এই মন্দিরের দেবীকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ইতিহাস আছে। জনশ্রুতি এই যে, বঙ্গাব্দ ১৩৫৭-তে এই কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীপতিপুরের অধিবাসী বটকৃষ্ণ অধিকারী। তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে অন্য রাজ্যে চাকরিতে যোগদান করেন। ভাগ্যচক্রে তিনি আবার ফিরে আসেন বাংলায়। চাষের কাজ শুরু করেন। তিনি আঙ্গুরবালা দেবীকে বিবাহ করেছিলেন, তবে সংসারজীবনে তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল না। তিনি মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন।
আরও পড়ুন
শাহী ইদগাহ না শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি: ইতিহাস জানুন
একদিন বটকৃষ্ণ হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর মুখে দীক্ষার কথা শোনেন। এবং শ্মশানে একাগ্রভাবে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। পরে, স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে তিনি মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে বটকৃষ্ণ অধিকারীর পরিবার গোঁড়া বৈষ্ণব ছিলেন। সকলে রাধাগোবিন্দর নাম নিয়ে তবে জলস্পর্শ করতেন। সেজন্য বৈষ্ণববাড়িতে কালীপুজোর ব্যাপারে সমাজের মোড়লরা আপত্তি তোলেন। কিন্তু বটকৃষ্ণ অধিকারী মায়ের মূর্তি স্থাপনের যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাতে কৃষ্ণ ও কালী একই অঙ্গে বিরাজিত ছিলেন এবং সেখানে মায়ের গায়ের রঙ ছিল সবুজ। তাই রটন্তী পুজোর দিন বটকৃষ্ণ সবুজকালী মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে বৈষ্ণববাড়িতে কালী পুজো হত বলে কিছু নিয়ম এখানে পালিত হয়। মায়ের বলির চল নেই। মায়ের মূর্তি পঞ্চমুন্ডির আসনে স্থাপিত। কপালে তিলক আঁকা কালীর মধ্যে এক বৈষ্ণবীয় রূপ দেখতে পাওয়া যায়। ইলিশ মাছ, মায়ের প্রিয় ভোগ। মায়ের পুজোয় মাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাতেন সেবায়েতরা। এই মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় ভক্ত সমাগম হয়। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে সফল হয়।
নদীয়ার হোগলবেড়িয়া থানার অন্তর্গত সেন পাড়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিতা কৃষ্ণকালী মা-র কথাও উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালে সেন পাড়া গ্রামের অধিবাসী জয়দেব মণ্ডল স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে গ্রামবাসী ও ভক্তদের দানসাহায্য পেয়ে কৃষ্ণকালী মায়ের মন্দির নির্মাণ করেন। দেবীর এক হাতে খাঁড়া, অন্য হাতে পদ্ম এবং বাকি দুই হাতে রয়েছে বাঁশি । দেবীর বিগ্রহে কৃষ্ণ ও কালীর এক সমন্বিতরূপ দেখা যায়। নদীয়া জেলায় এই একটি স্থানেই কৃষ্ণকালী দেবীর পূজা হয়।
কলকাতার বাঘাযতীন তালপুকুরে এক কৃষ্ণ-কালী মন্দির লক্ষিত হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা তারিখ, ১৩ই শ্রাবণ, বঙ্গাব্দ ১৩৭৩। মন্দিরটির বিশেষ প্রচার নেই। বর্তমানে এ-মন্দিরের দেখাশোনা করেন কেশব সাহা। গর্ভগৃহে কৃষ্ণ ও কালীর দুটি বিগ্রহ পাশাপাশি সুন্দর সজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। শোনা যায়, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এসে মন্দির প্রতিষ্ঠাতা গীতা'মাকে তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। গীতা'মা মূলত কালীভক্ত ছিলেন। তিনি প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হননি। তারপর যখন উপলদ্ধি করেন যিনি কালী, তিনিই কৃষ্ণ, তখন কৃষ্ণ-কালী মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দিরে বাৎসরিক উৎসব হয় ১৩ই শ্রাবণ। এছাড়া প্রতি মাসের ১৩ তারিখ বিশেষ পুজো হয়।
বাংলায় বহু স্থাপত্য-নিদর্শনেও দেবী কৃষ্ণ-কালী লক্ষিত হন। যেমন, বীরভূম জেলার ইলামবাজারের কাছে মৌখিরা গ্রামে টেরাকোটার যে সকল প্রাচীন (১৮০১ খ্রিস্টাব্দ) মন্দিরগুলো আছে, তাদের মধ্যে ডানদিকের প্রথম দেউলের কেন্দ্রীয় খিলানের ডান পাশে কৃষ্ণ-কালীর টেরাকোটার প্যানেলটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য!