কোথাও গাত্রবর্ণ নীল, কোথাও আছে হাত! বাংলার মাটির জগন্নাথ কেন বৈচিত্র্যে ভরা?
Rath Yatra 2025: দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার দক্ষিণ বারাসাতের দাঁড়া গ্রামের মাটির জগন্নাথের মধ্যে একটি বিচিত্র বিষয় লক্ষ্য করা যায়। সেটা হলো, অন্যান্য জায়গায় জগন্নাথদেবের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু এখানে জগন্নাথদেবের গাত্র ন...
রথযাত্রার মধ্যে বাঙালি মৃৎশিল্পীরা তাঁদের শৈল্পিক চেতনাকে পূর্ণ রূপে প্রকাশ করে থাকেন। পাঁপড় ভাজা ও জিলিপির ঊর্ধ্বে শিল্প সাধনার নিরলস পথ চলার প্রতীক হচ্ছে বাঙালি মৃৎশিল্পীদের তৈরি ছোট ছাঁচের জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রের প্রতিমা। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী মতো কাঠামোর বড় প্রতিমা নির্মাণের মধ্যে বাঙালি মৃৎশিল্পীরা যে মননশীলতা ও শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, সেই একই সাধনা তাঁরা জগন্নাথদেবের প্রতিমা নির্মাণেও করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের এই নিরলস সাধনা অবহেলার অন্তরালে থেকে যায়।
বাংলার বিচিত্র মাটির জগন্নাথদেবের প্রতিমা কথা উঠলেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার প্রসঙ্গ সবার আগে আসবে। এখানকার মথুরাপুরের গোপালনগর খামারু পাড়ার মৃৎশিল্পীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাত দেওয়া জগন্নাথ নির্মাণ করে চলেছেন। উজ্জ্বল টানা চোখ। মুখে শান্ত হাসি। লাল ঠোঁট। দুইটি হাত উপরের দিকে তোলা। হলুদ বসনে নীল উত্তরীয়। আর সেই উত্তরীয় থেকে জগন্নাথের পা দেখা যাচ্ছে। মাথায় সোনালি রঙের মুকুট। কপালে তিলক। দেবত্বের পূর্ণ প্রভার সঙ্গে লোকজীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এখানকার পোড়ামাটির ছাঁচের জগন্নাথদেব। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ পাড়ায় জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রের প্রতিমা তৈরি করে চলেছেন সনাতন খামারু। তাঁর কথায়, আগে দেড় ফুট উচ্চতার জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রের ছাঁচের পোড়ামাটির প্রতিমা নির্মাণ করা হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে এক ফুটে। এর থেকেও কম উচ্চতার জগন্নাথ প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন তিনি। এবছর প্রায় ৫০০-রও বেশি জগন্নাথ প্রতিমা তৈরি করেছেন। রথযাত্রার এক মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করে দেন। জগন্নাথদেবের প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে চাষের জমির এঁটেল মাটি ব্যবহার করা হয় বলে তিনি জানিয়েছেন। তাঁর দুই পুত্র লক্ষ্মী ও বিধান খামারু এই পরম্পরা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

শিল্পী সনাতন খামারু
আরও পড়ুন- বাবার কাছে হাতেখড়ি! ৯০ বছর ধরে মাটির পুতুল গড়ছে কালো সূত্রধররা
এ পাড়ার শশধর এবং বাপি খামারু এই অভিনব শৈলীর প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন। শিল্পী বাপি খামারু জানিয়েছেন, প্রায় ৯ প্রজন্ম ধরে তাঁরা জগন্নাথদেবের প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। আর 'খামারু' তাঁদের পদবি নয়, সেটি উপাধি। এখানকার প্রত্যেক শিল্পী রথযাত্রার দিন নিজেদের শৈল্পিক পসরা নিয়ে উপস্থিত থাকেন জয়নগরের রথের মেলায়। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর মজিলপুরের শম্ভুনাথ দাস প্রায় আট প্রজন্ম ধরে হাত দেওয়া জগন্নাথ তৈরি করে আসছেন। ওই একই অঞ্চলের আরও এক শিল্পী রবীন দাসও একই শৈলীর জগন্নাথ প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন।

গোপালনগরের জগন্নাথ
এখানে কেন হাত দেওয়া জগন্নাথদেব তৈরি হয় সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আঞ্চলিক গবেষক সায়ন রায় জানিয়েছেন,
"জয়নগর মজিলপুরে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার দারু বিগ্রহ রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র সমীক্ষার ফলস্বরূপ ধারণা করা হয় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবেই জগন্নাথ মহাপ্রভুর মধ্যেও এমন গঠন বিন্যাস সঞ্চারিত হয়েছে। তিনি যেভাবে দু'হাত তুলে নাম সংকীর্তন করতে করতে নীলাচল উদ্দেশ্যে উপনীত হয়েছিলেন, সেই রূপেই আমরা জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে চেয়েছিলাম। শিল্পীরাও সেই অনুরূপ ভাবনাই অনুকরণ করলেন। সেই থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মাটির ও দারু মূর্তিতে সংযোজিত হলো হাত ও পা। গোপালনগর ছাড়া সোনাকানি গ্রামেও একই শৈলী লক্ষ্য করা যায়।"

নীল জগন্নাথ
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার দক্ষিণ বারাসাতের দাঁড়া গ্রামের মাটির জগন্নাথের মধ্যে একটি বিচিত্র বিষয় লক্ষ্য করা যায়। সেটা হলো, অন্যান্য জায়গায় জগন্নাথদেবের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু এখানে জগন্নাথদেবের গাত্র নীলবর্ণ। শিল্পী বিদ্যাধর নস্কর বংশপরম্পরা মেনে জগন্নাথদেবের শরীরে নীল রঙ করে চলেছেন। দাদু নিতাই চাঁদ নস্কর, পিতা গুণধর নস্কর থেকে পরম্পরাগত সূত্রে এই শৈলীর জগন্নাথ প্রতিমা নির্মাণের শিক্ষা পেয়েছেন শিল্পী বিদ্যাধর নস্কর। বর্তমানে তাঁর পুত্র সোনা নস্করও এই একই শৈলী অবলম্বন করে চলেছেন। জগন্নাথদেবের গায়ের রঙ কেন নীল সে প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী জানিয়েছেন, "যিনি কৃষ্ণ তিনিই জগন্নাথ। আর তিনিই সব। সেই কারণেই নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে।"

দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণ বারাসাতের নীল জগন্নাথ
তাঁর তৈরি নীলবর্ণ জগন্নাথ দেবের মুকুট বিশালাকার। গোলাপি ও হলুদ রঙের পোশাক এবং তার ওপর সোনালি রঙ দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে। জগন্নাথদেবের কপালে এবং গালে কল্কা আঁকা হয়েছে। চোখের গঠন গোলাকার। বিদ্যাধর নস্করের তৈরি জগন্নাথদেবের মধ্যে দেবত্ব ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে। অন্যদিকে তাঁর পুত্র সোনা নস্করের তৈরি জগন্নাথদেবের মধ্যে লোকজ আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায়। গোলাকার মুখমণ্ডলে শান্ত অভিব্যক্তি। টানা চোখ। নীলবর্ণ মুখজুড়ে কলকা আঁকা। সোনালি রঙের মুকুটের তলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত চুল নেমে এসেছে। উত্তরীয় নির্মাণেও নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বিভিন্ন উচ্চতা জগন্নাথ দেবের প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন। দক্ষিণ বারাসাতের দাঁড়ায় কেন নীল রঙের জগন্নাথ দেবের প্রতিমা তৈরি করা হয় সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গবেষক সায়ন রায় জানিয়েছেন,
"মূলত নীল মাধব থেকেই নীল জগন্নাথ দেবের উৎপত্তি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার দক্ষিণ বারাসাতের অন্তর্গত দাঁড়া গ্রামে নীল মাধব রূপে জগন্নাথদেব নীল বর্ণের হয়ে থাকে। এ জেলার সুন্দরবনের বহু অঞ্চলে নীল জগন্নাথদেবের প্রচলন রয়েছে, যা এই জেলার অন্যতম ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।"

শিল্পী বিদ্যাধর নস্কর
আরও পড়ুন-এক বৃদ্ধের হাতে জীবিত নাড়াজোলের কাঠের পুতুল শিল্প
বাঙালির রথযাত্রায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব অবিস্মরণীয়। আর তারই দেখা পাওয়া যায় কলকাতার মানিকতলা খালপাড় পটুয়াপাড়া শিল্পী কেষ্ট পালের তৈরি জগন্নাথদেবের প্রতিমায়। কৃষ্ণের কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। ভগবান কৃষ্ণ তাঁকে আগলে রাখছেন। আর তাঁদের কোলের মধ্যেই অবস্থান করছে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র। আবার কখনও গাছতলায় জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রকে নিয়ে বসে রয়েছেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। এই সকল প্রতিমার মধ্যে শিল্পী আদতে মহাপ্রভুকে কুর্নিশ জানিয়েছেন।

মানিকতলার জগন্নাথ
কলকাতার উল্টোডাঙার দক্ষিণ দাড়ি কুমোর পাড়ায় জগন্নাথদেবের বিভিন্ন শৈলীর দেখা মেলে। যেমন, সিংহাসনে বসে রয়েছেন জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র, পুরীর মন্দিরের সঙ্গে রয়েছেন তারা, ঘোড়া টেনে নিয়ে চলেছে রথ আর তার মধ্যে বসে রয়েছেন জগন্নাথদেব। নদিয়ার শান্তিপুরের জগন্নাথদেবের প্রতিমায় শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনা প্রস্ফুটিত করে থাকে। জগন্নাথদেবের মাথায় কখনও সোনালি রঙের মুকুট তো আবার কখনও মাটির পাগড়ি দিয়ে অলংকরণ করা হয়। টানা চোখ এবং মুখমণ্ডলে অনবদ্য কল্কার কাজ শিশুমনকে আকৃষ্ট করে। সেখানকার কয়েকজন শিল্পী এমনও রয়েছেন যাঁরা জগন্নাথদেবের দারু-বিগ্রহের অনুরূপ মাটির বিগ্রহ তৈরি করতে পারেন। দেখে মনে হবে, কাঠের তৈরি কিন্তু আদতে তা মাটি দিয়ে তৈরি। এখানেই শিল্পীদের ভাবনা এক অনবদ্য রূপ নেয়।
হুগলি জেলার চুঁচুড়ার বড় জগন্নাথ বাড়ির বিগ্রহের আদলে মাটির জগন্নাথদেব তৈরি করেন শিল্পী উজ্জল পাল এবং লালটু পাল। সারা শরীরের রঙ হলুদ বর্ণ। মুখের রঙ কালো। গোটা মুখজুড়ে কল্কা আঁকা। মাথায় সোনালি রঙের মুকুট। আবার কিছু ক্ষেত্রে মুকুটহীন। প্রথম দেখলে মনে হবে কাঠের তৈরি কিন্তু আদতে তা মাটির। শুধুমাত্র জগন্নাথদেবের বিগ্রহই শিল্পীরা তৈরি করে থাকেন। উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলার আধ্যাত্মিক চেতনার অনেক গভীরে বিরাজ করে রথযাত্রা উৎসব। আর সেই রথযাত্রার মধ্যে মাটির জগন্নাথকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলেন মৃৎশিল্পীরাই।