পাহাড়ের কোলে রয়েছে বিশাল মনসা মন্দির, ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য অনেকেরই অজানা
Oldest Manasa Mandir: পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝেই, মণিমাজরার জমির মালিক রাজা গোপাল সিং এই মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ করেন।
ঠাকুর দেবতাদের হায়ারার্কিতে মনসার ঠাঁই তলানির দিকে একথা প্রবল ভক্তও স্বীকার করবেন। বাঁ হাতে পুজো পেয়েছেন চাঁদ সদাগরের। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের মধ্যেই একমাত্র তাঁর আরাধনার রমরমা। তবু, তিনি মনসা, অন্যতম 'জাগ্রত'। সাপের দেবী তিনি। বাংলায় কাব্যের আধার তিনি, বেহুলা লখিন্দরের প্রেমকে অমর করা দেবী তিনি। ভারতেই এমন একটি মন্দির রয়েছে মনসার, যার বয়স ২১২ বছর! তবে সেখানে মনসার সঙ্গে অবশ্য জড়িয়ে রয়েছে শক্তিপীঠের কিংবদন্তি। ১৮১১ সাল নাগাদ, মণিমাজরার রাজা ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরে তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। শিবালিকের পাদদেশে বিলাসপুর গ্রামে অবস্থিত ভারতের এই বিখ্যাত মনসা মন্দির।
তবে মনসা নয়, এই মন্দিরটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই শিব-সতীর গল্পই! কথিত আছে, পার্বতীর পিতা রাজা দক্ষ একবার শিবের আচরণে অপমানিত বোধ করেছিলেন এবং রেগে গিয়ে শিবকে হরিদ্বারের কাছে এক বড় যজ্ঞে আমন্ত্রণ জানাননি। পার্বতী অবশ্য যজ্ঞে যোগ দিতে গিয়েছিলেন কিন্তু এসেই বোঝেন হাওয়া খারাপ। অনুষ্ঠানটি তাঁর স্বামী শিবের অপমানের জন্যই আয়োজিত হয়েছে। গভীরভাবে আহত হয়ে তিনি ওই যজ্ঞের আগুনেই ঝাঁপ দিয়ে দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে, ওই সময় শিব মৃত স্ত্রীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য করেন সারা বিশ্ব জুড়ে। বিষ্ণু শিবের এই ক্রোধ দমাতে সতীর দেহকে বিভিন্ন অংশে কেটে ফেলেন সুদর্শন চক্র দিয়ে। সতীর দেহ সারা ভারতের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সতীর মাথাটি নাকি পড়েছিল এখানে, এই বিলাসপুরে।
আরও পড়ুন- জ্যান্ত অজগরের আরাধনা পাইথন মন্দিরে, দুর্বলচিত্তদের প্রবেশ নিষেধ
স্বাধীনতার আগে, এই মন্দিরটি মণিমাজরার বিভিন্ন রাজারাই দেখভাল করতেন। কিন্তু প্রিন্সলে স্টেটগুলি ভারতের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে মন্দিরটি পুরোহিতদের হাতে চলে যায়। পুরোহিতরা এর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থ হন। তীর্থযাত্রীরা আসেন ঠিকই কিন্তু মন্দিরটি ঘিরে চরম অব্যবস্থা চলতে থাকে। ১৯৯১ সালে যখন মনসা দেবী শ্রাইন বোর্ড গঠিত হয় এবং হরিয়ানা মাতা মনসা দেবী শ্রাইন অ্যাক্ট ১৯৯১ প্রণয়ন করে মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা হয় তখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। অবহেলার ফলস্বরূপ, হরিয়ানা সরকার মন্দিরটি দখল করে নেয় এবং মন্দির পরিচালনার জন্য "শ্রী মাতা মনসা দেবী শ্রাইন বোর্ড (SMMDSB) পঞ্চকুলা" ট্রাস্ট স্থাপন করে। ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত অত্যন্ত অবহেলিত ছিল এই মন্দির। তবে এর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক তাত্পর্যের জন্য জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল মনসা মন্দির। ভক্তদের কথা মাথায় রেখেই হরিয়ানা সরকার একটি আইনের (১৯৯১ সালের হরিয়ানা আইন নং ১৪) মাধ্যমে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। মন্দির পরিচালনা এবং এই অঞ্চলের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য হরিয়ানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে চেয়ারপার্সন করেই বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
কিংবদন্তি অনুসারে, শিবালিক পর্বতমালার চরম প্রান্তে অবস্থিত এই মন্দিরটির আশেপাশের দৃশ্য ছিল নয়নাভিরাম। পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝেই, মণিমাজরার জমির মালিক রাজা গোপাল সিং এই মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ করেন। লোক বিশ্বাস, মণিমাজরার রাজা গোপালদাস তাঁর দুর্গের দরজা থেকে মন্দির পর্যন্ত একটি গুহা তৈরি করেছিলেন, যা প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। সতীকে দেখতে তিনি প্রতিদিন তাঁর রাণীর সঙ্গে এই গুহা দিয়েই যেতেন। রাজার আগমন না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের দরজা খোলা হতো না। মূল মন্দিরে দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়। আরও তিনটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়; সরস্বতী, মনসা এবং মহালক্ষ্মী। এই মন্দির চত্বরে ৩টি মন্দির রয়েছে। মণি মাজরার মহারাজা গোপাল দাস সিং নির্মিত মনসা মন্দিরটিই প্রাচীনতম। এই চত্বরে যে ৩টি মন্দির রয়েছে, সবের মধ্যে মূল মন্দিরটি প্রাচীনতম। মণিমাজরার মহারাজা গোপাল দাস সিং, ১৭৮৩ সালে সিংহাসনে বসেন। তিনিই বিলাসপুর, তহসিল এবং জেলা পঞ্চকুলার গ্রামে শিবালিক পাদদেশে অবস্থিত মনসার বর্তমান মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। পাতিয়ালার মহারাজা করম সিং ১৮৪০ সালে পাতিয়ালা শিবালয় মন্দির স্থাপন করেন।