ভোটে শুধু সারথি বদলান অর্জুন সিং! বাস্তবে কেমন আছেন ব্যারাকপুরের মজদুররা?
Barrackpore Lok Sabha Election 2024: এককালের রমরম করে চলা মিলগুলোর ভিতর থেকে লোহার যন্ত্রপাতি চুরি করে বিক্রিই হয়ে ওঠে নতুন 'ধান্দা'।
অপেক্ষা করতে করতে প্রায় তিনটে দশক কাটল। আবার একটা নির্বাচন। চটকলিয়া শহরগুলো আবারও একটা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। এখন চোখে ছানি পড়েছে বিজয় হেলার। এককালে গৌরীপুর জুটমিলের 'পার্মানেন্ট' মজদুর ছিল। ভালো মাইনে ছিল। বোনাস ছিল। ওভারটাইম ছিল। সেসব এখন অতীত। গত তিন দশকে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে গৌরীপুর জুটমিল। এখন বাড়ির সামনের চৌমাথায় একটা লিট্টির দোকান দিয়েছেন। দোকান বলা ভুল। স্রেফ একটা উনুন আর একটা প্লাস্টিক। তাও প্লাস্টিক লাগে বর্ষা হলে। নয়তো ফুটপাতের কোণে স্রেফ একটা উনুন। আলুর চোখা, ধনেপাতার চাটনি দিয়ে লিট্টি। আগে শুধু মজদুর লাইনের লোকজনই খেত, এখন বাঙালি ছেলেমেয়েরাও খায়। এই করেই দিন গুজরান হয় এককালের মিলের স্থায়ী কর্মী বিজয়ের। ওদের ভাষায় 'পারমনেন্ট মজদুর'। এই 'পারমনেন্ট' হওয়ার এক গর্ব এখনও লেগে আছে বিজয়ের ক্ষয়াটে শরীরে। যদি কখনও মিল খোলে, বিজয়ের চাকরিটা কি বিজয়ের ছেলে পাবে? 'ইপিএফ' বাবদ টাকাটাও তো পাওয়া বাকি!
সিপাহী বিদ্রোহের পরপরই ব্রিটিশদের উদ্যোগে গঙ্গার দু'ধারে পাটশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শিল্পাঞ্চল। গঙ্গার এধারে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল আর ওপারে হুগলি শিল্পাঞ্চল। একটা সময়ের পর পাটের ব্যবহার প্রায় উঠে গেল। আজ দুই শিল্পাঞ্চলই মৃতপ্রায়। এককালে রমরম করে চলা জুটমিলগুলো এখন স্রেফ পোড়ো বাড়ি।
উনিশ শতকের শেষ থেকেই বিজয় হেলা'র মতো অসংখ্য মজদুরদের দাদু বা দাদুর বাবারা আরাহ, ছাপরা, গয়া, বালিয়া, বেনারস, গোরক্ষপুর সহ বিহার এবং তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ থেকে আসতে শুরু করেন। বাঙালি বাবুরা কায়িকশ্রম অতটা করতে পারত না। আজও বিশেষ পারে তেমন না। তখন বাঙালিরা সাধারণত হতো মিলের বড়বাবু। কাগজপত্রের কাজ করত। আর গতর খাটানো কাজের জন্য বিহার-যুক্তপ্রদেশ থেকে হাজারে হাজারে মজদুর আসতে লাগল গঙ্গাতীরবর্তী এই জনপদগুলোয়। তৈরি হলো মজদুর লাইন। কুলিডিপো।
আরও পড়ুন- তৃণমূলকে জেতাতেই ডায়মন্ড হারবার থেকে প্রার্থী হলেন না নৌশাদ?
এরপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। মজদুরদের হয়ে 'লাল পার্টির' লড়াই দেখেছে চটকলিয়া মজদুর লাইনের মানুষরা। তারপর একদিন লালপার্টিকে ক্ষমতাতেও এনেছে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে সিপিএমের প্রভাবে বাঘে-গরুকে যেমন একঘাটে জল খেতে দেখেছে এখানকার মজদুররা, তেমনই একদিন জ্যোতি বসুর বক্তব্য শুনে মোহিত হয়েছে মিলের মাঠে। 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগান শুনে জগদ্দল কাঁকিনাড়ার মজদুর লাইন অবাক হয়ে ভেবেছে, আগে যাই হোক এই মজদুর মহল্লায় 'সাউ' আর 'যাদব'-কেও তার মানে এবার থেকে এক হতে হবে। আদতে 'তিলি' আর 'আহির'-দের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। কিন্তু মজদুর লাইনে সবার একটাই পরিচয়। সবাই মজদুর! কে 'তিলি', আর কে 'আহির', কে 'কুর্মি' দেখলে চলবে না!
সিপিএম ক্ষমতায় এসেছে। আর আশির দশকের শেষ দিক থেকেই হঠাৎ হঠাৎ মিল বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। নতুন শব্দ যুক্ত হলো বাঙালির অভিধানে, 'লক আউট'। কংগ্রেস তখনও সক্রিয় শিল্পাঞ্চলে। কংগ্রেসের নেতা বোঝালেন, মিলের লক আউটের জন্য দায়ী সিটু! মালিকের সঙ্গে মিটিং করছেন কংগ্রেসি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। মজদুর মহল্লা ভাবছে, এবার সব ঠিক হবে। মিলের দরজা নিশ্চয়ই খুলবে। কিন্তু মিলের ব্রিটিশ আমলের বাংলোতে বসে মালিকের অভ্যর্থনা গ্রহণ করে একসঙ্গে দামী স্কচে চুমুক দিয়েছে কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা আর সিপিএমের আগুনখেকো নেতা। লক আউটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সমাজবিরোধীদের সংখ্যা। ভুখা পেট সবচেয়ে সাহসী। আর এই ভুখা পেটের লোকগুলোকেই বরাবর নিজেদের কাজে ব্যবহার করে রাজনীতির কারবারিরা! এরমধ্যে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল পেয়েছে সিপিএমের শিক্ষক সাংসদকে। রসায়নের শিক্ষক সেই মাস্টারমশাইয়ের সামনে তাঁর পার্টি কমরেডরাও বেশি মুখ খুলতে পারতেন না। ব্যারিটোন ভয়েসের অধিকারী মাস্টারমশাই এক ধমকে চুপ করিয়ে দিতে পারতেন নিজের দলের কমরেড, বিরোধী দলের কর্মী থেকে সাধারণ মানুষকে!
চটকলিয়া শহরের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। এককালের রমরম করে চলা মিলগুলোর ভিতর থেকে লোহার যন্ত্রপাতি চুরি করে বিক্রিই হয়ে ওঠে নতুন 'ধান্দা'। ভুখাপেটে আগুন জ্বলে। মিলের ভিতর বোমা-গুলি মজুত করতে থাকে কেউ কেউ। নতুন 'বাহুবলী' নেতার জন্ম দেয় শিল্পাঞ্চল। কিন্তু তারমধ্যেই রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া। সেই হাওয়া এসে লাগে শিল্পাঞ্চলের মজদুর লাইনেও। এক গুজরাতি প্রার্থী এসে চটকলিয়া মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে দাবি করেন, জুটমিলের চাবি তাঁর পকেটে। বিশ্বাস করে বারবার ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া বিজয়, উমেশ, শিউপ্রসাদের মতো শিল্পাঞ্চলের হাজার হাজার কর্মহীন মজদুররা। পরিবর্তন হয়। কিন্তু সেটা রাজনীতির। কুলিডিপো, জগদ্দল, ভাটপাড়া, টিটাগড়ের মজদুর লাইনের কোনও পরিবর্তন হয় না।
রসায়নের মাস্টারমশাই অবশ্য হেরে যান গুজরাতি বেনিয়া প্রার্থীর কাছে। আরও দশটা বছর কেটে যায়, আরও কিছু জুটমিল বন্ধ হয় চিরতরে। কোনও কোনও জুটমিলে একটা-দুটো ইউনিট চালু রেখে, ব্যবসা একেবারেই নেই যুক্তি দেখিয়ে, বাকি ইউনিটগুলো বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ। আবারও বৈঠক হয়। বাহুবলী নেতা নিজেকে মজদুরদের মসিহা দাবি করে বৈঠকে বসে মালিকের সঙ্গে। মজদুর মহল্লা ফের আশায় বুক বাঁধে। গলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠে বজরংবলীর মন্দির। মজদুর মহল্লার কালীমন্দিরের পাশে দেখা যায়, কারা যেন গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তাতে 'রাগী বজরংবলী'র ছবি। রামনবমী এলে কারা যেন বোম মেরে যায় কাঁকিনাড়ার ঈদগাহ মসজিদে! সাম্প্রদায়িক হিংসা বাধে হাজিনগরে। যে মজদুর মহল্লায় কোনওদিন কেউ আলাদা ছিল না, সবার একটাই পরিচয় ছিল 'মজদুর'- সেই ধারণাটাই রাতারাতি বদলে গেল।
বাহুবলী নেতা দল পাল্টান। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান। জেতেন। এবং মজদুর মহল্লাগুলোতেই ব্যাপক বোমাবাজি শুরু হয়! এককালে ৫৫০টাকার মজুরিতে মিলে কাজ করার গল্প জনে জনে বলে বেড়ানো লোকটাই, সাংসদ হয়ে আগুন লাগায় মজদুর মহল্লায়। বাড়ি পোড়ে কয়েকশো। খুন হয় বেশ কিছু মানুষ। টানা ৬ মাস ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল রণাঙ্গন হয়েই থাকে।
আরও পড়ুন- বাহুবলে ব্যারাকপুর দখল করতে পারবেন তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জার অর্জুন সিং?
কিন্তু মিল কি খুলল? মজদুরদের মসিহা বলে দাবি করা সাংসদ মিল কিন্তু খুলতে পারলেন না। কিংবা খোলার চেষ্টাই করলেন না। শাসক চায়, নিজের সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। আর অন্যের সন্তানের হাতে ৫০০-১০০০ টাকার সঙ্গে 'নাইন এম এম' রিভালভার আর কিছু দেশি পেটো তুলে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই মজদুর মহল্লার কাজ না পাওয়া ছেলেগুলোই ভরসা। মিল খুলে গেলে, মিলে মজদুরি করলে 'ভাইয়াজি'র হয়ে এলাকায় দাপাবে কারা? কিছু বাইক, বাইকের তেল, মদ আর মাংসের টাকা- এইটুকুই তো বিনিয়োগ। তার বদলে গোটা শিল্পাঞ্চলের ক্ষমতা দখল। ভাইয়াজি'র কাছে এটা হাতের ময়লা। মজদুর মহল্লা জানে, এটাই এখানকার নিয়ম। টাকা আর বাহুবলের সামনে চুপ করেই থাকতে হয়। কিন্তু চটকলিয়া শহরের মানুষগুলোকে অবাক করে দিয়ে গুজরাতি বেনিয়া প্রাক্তন সাংসদ দল পালটে হয়ে যান বিজেপি! আর তার কয়েকমাসের মধ্যে বাহুবলী বিজেপি সাংসদ হয়ে যান তৃণমূল। তৃণমূল থেকে আবার বিজেপি। দলবদলের খেলা চলতে থাকে। মজদুর মহল্লা হিসেব কষে, ইপিএফের কতটা টাকা মালিক মেরেছে! আর মালিক হিসেব করে, আবার ভোটের সময় কত কোটি রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে হবে!
আবার একটা ভোট দেখবে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। হাজিনগরের চশমা বাবার মাজারে আর টিটাগড়ের হনুমান মন্দিরে একই প্রার্থনা হয়, আর যেন লাশ না পড়ে এই শিল্পাঞ্চলে। ভোট এলেই মজদুর মহল্লা চিন্তায় ডুবে থাকে আবার কোন মায়ের কোল খালি হবে! বাহুবলী নেতার ছেলে বিধায়ক হবে। তারপর তার ছেলে হবে। আর মজদুরের ছেলে প্রথমে হবে বেকার, তারপর পাড়ার 'দাদা' তারপর খবরের কাগজে নাম উঠবে 'কুখ্যাত দুষ্কৃতী' হিসেবে! তারপর একদিন হারিয়েই যাবে সে!
আরও একটা নির্বাচন শিল্পাঞ্চলে।
বিজয় হেলা জানে, ওদের মিল আর খুলবে না। তারপরেও এই মজদুর মহল্লায় মিল আর মিল শ্রমিককে নিয়েই রাজনীতি হবে! এসব দেখে দেখে চোখে তো ছানি পড়ে গেছে। ছানিটা কাটানো দরকার। তার জন্য টাকা চাই। কিন্তু ভোট নিয়ে আবার 'বাওয়াল' শুরু হলে ফুটপাতে এই লিট্টির উনুনটাও বন্ধ রাখতে হবে। বিজয় হেলা'র কাছে 'গণতন্ত্রের উৎসবে' সামিল হওয়ার চেয়েও ছানি কাটানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ! দুটো লিট্টি আলুচোখা আর ধনেপাতার চাটনি এখন ১০ টাকা করে নেয় বিজয়। জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে তাতে আরও ৫ টা টাকা বাড়াতেই হবে। ৪ জুনের পর থেকে ১০-এর জায়গায় ১৫ টাকায় দুটো লিট্টি বেচবে বিজয়!