সিংহের শিকার হয়ে উঠতে পারত তরুণী, কলকাতার সার্কাসের সেইসব দিন আজও রোমাঞ্চকর
সার্কাসের জনপ্রিয়তা উল্কার গতিতে বৃদ্ধি পেলেও গত শতকের শেষ থেকে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। পশুপাখিদের বিভিন্ন খেলায় বিঘ্ন ঘটার কারণে সার্কাসের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে গিয়েছিল।
সার্কাস বলতে সাধারণ মানুষের মাথায় আসে জিমন্যাস্ট, ট্রাপিজের খেলা, বিভিন্ন পশুপাখির খেলা এবং জোকার। বর্তমানে সার্কাস যেন বাংলা এবং বাঙালির জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকা এক অধ্যায়। দেড়শো বছরের বেশি সময় পার করে বর্তমানে সার্কাস বাংলায় নিজের প্রথম রূপে ফিরে গিয়েছে, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা আজ অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে সার্কাসকে জনপ্রিয় করে তোলার অবদান দিতে হয় প্রিয়নাথ বসু এবং তার গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসকে।
ছোটো জাগুলিয়ার প্রিয়নাথ কলকাতায় এসে বিভিন্ন কুস্তি এবং শরীরচর্চার আখড়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পরিবারের অমতে এবং ৭৫ টাকা মাসমাইনের চাকরি ছেড়ে ১৮৮৭ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। সেই সময় সার্কাসে পশুপাখির খেলা দেখানো হতো না। সার্কাস মানে ছিল জিমন্যাস্টিক এবং ট্রাপিজের খেলা। তার সঙ্গে দেখানো হতো বিভিন্ন ধরনের জাগলিং। শুরুতে যাত্রার মতো মাটিতে চাটাই পেতে দর্শকরা সার্কাসের খেলা দেখত কারণ তখন প্রিয়নাথের কাছে তাঁবু কেনার টাকা ছিল না।
সময়ের সঙ্গে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছিল। ১৮৯৭ সালে প্রথম এই সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানো হয়। কথিত আছে যে, প্রখ্যাত কুস্তিগির বাদলচাঁদ এই সার্কাসে বাঘের সঙ্গে কুস্তির খেলা দেখাতেন। প্রিয়নাথ বসু গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের খেলা শুধুমাত্র অবিভক্ত বাংলায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি তাঁর সার্কাসের দল নিয়ে দেশে-বিদেশে খেলা দেখিয়েছিলেন। প্রিয়নাথের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় বহু সার্কাসের দল তৈরি হলো। যার মধ্যে রাজেন্দ্রলাল সিংহর গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস এবং কৃষ্ণলাল বসাকের গ্রেট ইস্টার্ন সার্কাস অন্যতম। পার্ক সার্কাস এলাকার নাম সার্কাসের সঙ্গে জড়িত। সম্ভবত, এখানকার ময়দানে দেখানো সার্কাসের খেলার জনপ্রিয়তার কারণে এই এলাকার নাম হয় পার্ক সার্কাস।
আরও পড়ুন: ২,৫০০ টাকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক চোখ ধাঁধিয়ে দিত, সেই কলকাতা ধরা আছে প্রবাদে
সার্কাসের জনপ্রিয়তা উল্কার গতিতে বৃদ্ধি পেলেও গত শতকের শেষ থেকে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। পশুপাখিদের বিভিন্ন খেলায় বিঘ্ন ঘটার কারণে সার্কাসের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে গিয়েছিল। কলকাতার এক জনপ্রিয় সার্কাসে এক মহিলা দুটো সিংহ নিয়ে খেলা দেখাতেন। মহিলা শুয়ে পড়লে একটি সিংহ তার বুকের ওপর বসে পড়ত। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে সিংহ আবার নেমে খাঁচায় চলে যেত। একবার খেলা দেখানোর সময়ে সিংহ নেমে খাঁচায় যাওয়ার বদলে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। উপস্থিত দর্শক এবং সার্কাসের দলের অনেকেই সিংহের আচরণ দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, সিংহ শিকার ধরার মতো আচরণ শুরু করেছিল। উৎকণ্ঠাময় কিছু মুহূর্ত কাটানোর পরে সার্কাস দলের সদস্যদের প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। এই সময় থেকে সার্কাস পশুপ্রেমীদের রোষের মুখে পড়তে শুরু করেছিল। বন্য পশুদের সঠিক পরিচর্যা না করা, অযথা অত্যাচার সংক্রান্ত বহু অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিলো। এছাড়া বন্য পশুপাখিদের দিয়ে জোর করে খেলা দেখানো নৈতিকভাবে উচিত কি না, সেই প্রশ্ন বরাবর উঠতে শুরু করেছিল।
সার্কাসের জনপ্রিয়তায় যখন ভাটার টান চলছে তখনই মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অতিমারী হাজির হয়েছে। বাংলায় বিভিন্ন সার্কাস অতিমারীর বহু দিন কোনও শোয়ের আয়োজন করতে পারেনি। বহু ক্ষেত্রে কমসংখ্যক দর্শক নিয়ে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। বহু বছর অতিক্রম করে সার্কাস আবার নিজের প্রথম রূপে ফিরে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ সার্কাসের অতীত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান। ভবিষ্যৎ বলবে যে, সার্কাস সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানানসই করে আরও বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাবে, না কি সে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকে।