আমাদের উর্দু একাডেমি! কার হাতে ভাষার ভবিষ্যৎ?

Urdu Academy: দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরে কোনো-একটা রবীন্দ্র-সাহিত্য কি অনুবাদ করেছে উর্দুতে? করবে কী করে! একাডেমি জানে, উর্দু মুসলমানের ভাষা। ভাষা-যে কোনো ধর্মের হয় না, এই সহজ কথাটা এঁদের মাথায় ঢোকে না।

১৯৯৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গ উর্দু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। দশ সদস্যবিশিষ্ট সেই কমিটির প্রত্যেকেই ছিলেন অবাঙালি। অদ্যাবধি একাডেমিতে একটা পুঁচকে বেড়ালও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে নাকি বাঙালি বংশোদ্ভূত। বলতে কী, মুসলিম ইন্সটিটিউট হল এবং আর যা-কিছু মুসলিম পরিচালিত প্রতিষ্ঠান আছে এ-বাংলায়, সবখানেই অবাঙালির পতাকা পতপতিয়ে উড়ছে। কেন? সেই ব্রিটিশ যুগে আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য ফরিদপুরনিবাসী নবাব আবদুল লতিফের গাজোয়ারি আবদার থেকে একটা বিষয় ঝান্ডা উঁচিয়ে আছে যে মুসলমানদের ভাষা উর্দু। যদিও সে-ভুল এবং মোহ বহুদিন আগেই ভেঙেছে, তবু এই সেদিন, গত শতকের সাতের দশকে, ছাত্রাবস্থায়, আমারও বাংলা শুনে কেউ-কেউ জানতে চেয়েছিলেন— বাড়ি ঢাকা কি না! এখানে আরও একটা খিঁচ লেগে আছে। আমরা ভাই বাংলায় কথা বলি। রাঢ়ী কী বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ; নিদেন বৈদ্য কী কায়স্থ। আমরা বাঙালি। আমরাই। ও, তুমি মুসলমান হয়েও বাংলা বলছ? বাঃ! তাহলে তোমরা বাংলাভাষী মুসলমান। বাঙালি? না, না। সে তো আমরা! এমনই ছিল গত শতকের সাতের দশক পর্যন্ত। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর অবস্থা কিছুটা পালটায়। আর তাই, এ-বাংলায় সরকারের পর সরকার আসে, কলকাতাবাসী অবাঙালি মুসলমানদেরই কব্জায় থেকে যায় ক্ষমতার দম্ভ। কোটি কোটি বাঙালি মুসলমান দূর থেকে সে-সব দেখে; কিংবা দেখেও দেখে না। স্বাধীনতার পর শুধু একবারই, ১৯৭২-৭৭ সালের পাঁচ বছরে, বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে উঠে এসেছিলেন আবদুস সাত্তার, জয়নাল আবেদিন, গনি খানচৌধুরীর মতো মানুষজন। সেই একবারই। যাক সে-কথা।

এখনকার এই-যে আধো-ঘুমন্ত উর্দু একাডেমি, সে এবার চারদিক থেকে খোঁচা খেয়ে খানিকটা হতচকিত। কী ব্যাপার? কোনো সাতে নেই, পাঁচে নেই। বলতে কী, তেমন কাজেকর্মেও নেই। সরকারি সংস্থাটি আছে কিনা কেউ খবরও রাখে না ঠিক মতো। কী-এমন হল-যে সবাই মিলে তাঁকে নিয়ে চেঁচামেচি করছে? হয়েছে কী, উর্দু একাডেমি হিন্দি মুভি নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে চারদিনের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলামন্দিরে, যেখানে যৌক্তিক কারণেই আমন্ত্রণ জানানো হয় বিখ্যাত কবি ও কাহিনীকার জাভেদ আখতার-কে। জাভেদ আখতারের লেখা কেউ পছন্দ করুন আর না-ই করুন, দেশজোড়া বিপুল খ্যাতি তো তাঁর রয়েছে। ব্যস, দু-টো সংগঠন জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দ আর কোন-এক ওয়াহিয়া ফাউন্ডেশন উঁচুনীচু নানান কানে লাগিয়ে দেয়, জাভেদ আখতার নামেমাত্র মুসলমান কিন্তু কাজে ঘোর নাস্তিক। এহেন কাউকে উর্দু একাডেমির ডাকা উচিত নয়। একাডেমি রসাতলে যাবে কিনা কেউ জানে না, তবে নিশ্চিত না-পাক তো হবেই! এখনও পর্যন্ত তাঁদের মতো জিন্দাপির যখন রয়েছে, এমন দুষ্কর্ম কলকাতায় হতে দেওয়া যায় না— এমন হুমকিও তাঁরা দেয়। সঙ্গে তসলিমা নাসরিন নামের পুরনো বামফ্রন্টীয় জুজুটিও তাঁরা দেখায়।

আরও পড়ুন 

জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ বাতিল: উদারপন্থীদের নীরবতায় মৌলবাদের উত্থান

অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়ায়-যে করজগ্রামনিবাসী জমিয়তে উলেমা-প্রধান জনাব সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী-কে অতি-দুর্বল উর্দুতে একাডেমির বিরুদ্ধে কিছু বলতে হয়। ভাষা এবং বাকরীতি দুর্বল হলে যা হয়, বক্তব্যও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অথচ, কিশোর বয়সে চৌধুরীমশাইয়ের সুদর্শন বাবাকে আসতে দেখেছি আমাদের বাড়িতে। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বেশ খ্যাতিও ছিল। উপরন্তু বর্তমান মন্ত্রী মহোদয়ের সবসময় খেয়াল থাকে না-যে তাঁর নিজের পদবিটি সংস্কৃতজাত— চতুর্ধারী শব্দ থেকে এসেছে। অর্থাৎ চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড যার। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সারা ভারতেই পদবিটির দেখা মেলে। একসময় ছয়ে-ছন্নছাড়া একাডেমির গায়ে ছ্যাঁকা লাগে-যে এটা শুধু গ্রন্থাগার মন্ত্রীর বন্ধনীর মধ্যে আটকে নেই। হুইখানে, শেষ মগডালে, সুতোটি বাঁধা। তাঁরা অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলার মাথাটি আরও নীচু করে, মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে, উর্দু আর ইংরেজিতে বাধ্যত একটি ঘোষণা দেয় যার ইংরেজি বয়ানটি এরকম—

‘This is to inform that our upcoming event Hindi filmo main Urdu ka kirdaar has been postponed.’

‘হিন্দি ফিল্মোমে উর্দু কা কিরদার’ তো বন্ধ হল। কিন্তু বাংলার উর্দু একাডেমি এবার কী করবে? ১৯৯৯ সাল থেকে এত-এত বছরে কী করেছে একাডেমি? কোনো মৌলিক বই কি প্রকাশ করতে পেরেছে? দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরে কোনো-একটা রবীন্দ্র-সাহিত্য কি অনুবাদ করেছে উর্দুতে? করবে কী করে! একাডেমি জানে, উর্দু মুসলমানের ভাষা। ভাষা-যে কোনো ধর্মের হয় না, এই সহজ কথাটা এঁদের মাথায় ঢোকে না।

গোত্র— ইন্দো-আর্য। লিপি— নাস্তালিক। এ হেন উর্দুভাষা, স্বীকার করছি, আমি জানি না। দু-একবার চেষ্টা করেছি। হয়নি। সম্ভবত ভাষাটির লিপির জন্য। অথচ এই লিপি বেয়েই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ উঠে গেছে এবং যাচ্ছে একাধিক ভাষার সুউচ্চ শিখরে। আমি কেন পারলাম না? এটা আমার অক্ষমতা।

কবি ও সাধক ও পণ্ডিত আমির খুসরো (১২৫৩-১৩২৫)-কে উর্দু সাহিত্যের জনক বলা হয়ে থাকে। আধুনিক উর্দুর পূর্বসূরি উপভাষা হিন্দভির বিকাশে খুসরো অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন। তাঁর রচনায় খুসরো ফারসি, আরবি এবং স্থানীয় উপভাষাগুলিকে সফলভাবে মিশ্রিত করেছিলেন, যা হিন্দভি/উর্দুর পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু ভাষাটি গড়ে উঠেছে মামলুক শাসকদের প্রায় শুরু থেকে। নানা অঞ্চলের সৈন্যদের এক মিশ্র ভাষা এটি। ফারসি, তুর্কি, আরবি, দেশীয় ভাষার উপর স্তরে স্তরে চেপে তৈরি হয়েছে উর্দির ভাষা। আমির খুসরো সেই ভাষাকেই আপন প্রতিভাবলে সুসংহত করেছেন। 

আরও পড়ুন

“গণতন্ত্রে সেন্সরশিপের স্থান নেই”! জাভেদ আখতার বিতর্কে যা বলছে আন্তজার্তিক উর্দু সংগঠনগুলি

এদিকে ইতিহাসবিদরা বলছেন, চেঙ্গিজ খান ও তাঁর পুত্রদের সময় থেকেই মোঙ্গল-সম্রাটদের আবাসস্থল বা তাঁদের সৈন্যদের বসতিস্থানকে ‘উর্দু’ বলা হত। বলতে কী, উর্দু আলতাইক শব্দ এবং তুর্কিদের উপভাষাসমূহে এই শব্দটির ওর্দু, উর্দু, যুর্ত প্রভৃতি রূপে ব্যবহার হয়। তুর্কিভাষায় এর অর্থ হল— তাঁবু, বাসস্থান বা সেনানায়কের সামরিক বাসস্থান ইত্যাদি। জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরও ভারত বিজয়ের পর এক বার্তায় তাঁর সৈন্যদের ‘উর্দু-এ-নুসরত-শয়ার’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁর ‘বাবুর নামা’য়।

১৯৬০ সালে প্রকাশিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা-সংবলিত ‘উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস’এ হরেন্দ্রচন্দ্র পাল লিখছেন—

‘মুঘল-যুগে ও ইংরেজ শাসনের প্রথম যুগে সারা ভারতের যোগ-সূত্র ছিল উর্দু-ভাষা এবং দরবারে তখনও ফারসীতেই কাজ চলিলেও উর্দুই ছিল সর্বজনবিদিত ভাষা, হিন্দী নহে। হিন্দী হিন্দুর ভাষা, কিন্তু উর্দু তথা হিন্দুস্তানী হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ভাষা। যেমন রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই সমানভাবে ইহাকে পরিপুষ্ট করিয়াছে।’

হরেন্দ্রচন্দ্র হিন্দি সম্বন্ধে যা-ই লিখুন, ভাষা কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হতে পারে না। পারে না-যে উর্দু সম্বন্ধে তাঁর উক্তিই সে-কথার প্রমাণ। মুন্সি প্রেমচন্দ, কৃষণচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের চিরায়ত রচনাগুলো হিন্দু-রচিত বলে কি সাম্প্রদায়িক প্ররোচনায় আমরা উর্দু সাহিত্য থেকে ফেলে দেব? সাদাত হাসান মান্টো কতটা ইসলামভক্ত, তিনি পানাসক্ত কিনা, ওয়াহিয়া ফাউন্ডেশন কি মনে করে, এসব বিচার করে তাঁর সাহিত্য আমরা পড়ব? জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দের পরামর্শ নিয়ে কি পড়ব ইসমত চুঘতাই? এঁদের পরামর্শের বা হুমকির মুখে যদি অস্তিত্ব নির্ভর করে উর্দু একাডেমির, তাহলে সে-অস্তিত্বের কানাকড়িও মূল্য নেই।   

আমরা শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গ উর্দু একাডেমির পরিকাঠামো চমৎকার। একটা আস্ত অডিটোরিয়ামও নাকি রয়েছে তাঁদের। কিন্তু একাডেমিটি একান্তভাবেই কলকাতাকেন্দ্রিক। কলকাতা শহরে সরকারি সুবিধা ছিনিয়ে নিয়ে যে কাজটুকু তারা করে, একক চেষ্টায় বাংলার অনেকে তার চেয়ে বেশি কাজ করেন উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে। যেমন ডোমকলের মবিনুল হক বা সিউড়ির পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়। বহু বছর ধরে এঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন এবং নীরবে। সাধনা কমিটি-মিটিং করে হয় না। হয় নীরবতার মাঝে, অন্ধকার স্রোতের পাশে নিবিড় অন্ধকারে, যে নিবিড়তায় সৃষ্টিশীল মানুষ প্রেরণা খুঁজে পান। দুজনেই উর্দু ভাষা-সাহিত্যে সুপণ্ডিত। উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদের জন্য সাম্প্রতিককালে দুজনকেই সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কৃত করেছে। কিন্তু উর্দু একাডেমি আজ পর্যন্ত একটুখানি সংবর্ধনা দিয়েও তাঁদের উৎসাহিত করতে পারেনি। একাডেমি শশব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। কারা হুমকি দিল, কারা কখন নির্দেশ দিল, সেসবকে মান্যতা দিতেই তাদের দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের কাছে রাজ্যের মাথা হেঁট হলেও! এহেন উর্দু একাডেমিকে নিয়ে রাজ্যবাসী কী করবে?

More Articles