সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যেভাবে উঠে এসেছেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চরিত্ররা
Satyajit Ray's stories and iconic characters: সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর বরাবরই এক লৌকিক ও যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খেয়ে বেড়িয়েছে। অবাক করে এতকিছুর পরও প্রিয়তোষের লোহার কারখানার কথা।
“Oh, East is East, and the West is West, and never the twain shall meet,”
—The Ballad of East and West, Rudyard Kipling
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে যখন ব্রাহ্ম সমাজের যুক্তিবাদী আন্দোলন খানিকটা স্তিমিত। ঠিক তখনই পরিচালক সত্যজিৎ রায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রতি। কারণ, ‘পথের পাঁচালি’-কে বিদেশে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নেহরুর আমলারা আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁদের মতে, এতে ভারতীয় সমাজের দারিদ্র চিত্রকে অতিরিক্ত রোমাঞ্চিত করে দেখানো হয়েছে। নেহরু সেই মতামত খারিজ করেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন—
“I admired Nehru, I understood him better, because I am also in a way a kind of product of East and West…”
১৯৫১ সালে মুক্তি পায় ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়াঁর ‘দ্য রিভার’ ছবিটি। প্রাচ্য ও পাশ্চ্যাত্যের অপূর্ব মেলবন্ধনের সূচক এই ছবির প্রথম দৃশ্য শুরু হয় এক ভারতীয় আল্পনার কল্কার মধ্য দিয়ে। ভারতবর্ষে বসবাসকারী একটি ব্রিটিশ পরিবারকে ঘিরে রেনোয়াঁর এর আখ্যান বর্ণিত। এই ছবিতে নানাধরণের চরিত্র দেখা যায়। বাড়ির ছোটছেলে বগির বন্ধু ধুতিপরা- কালোকুলো চেহারার কালু। তাদের বন্ধুত্ব যদিও সকলেই একটু সন্দেহের চোখে দেখে। সাহেবি বাচ্চাদের দেখাশোনা করা বা বাইরে নিয়ে বেরোনোর সবসময়ের সঙ্গী পাঞ্জাবি সর্দার ‘সিং’। তবে ছবির সবথেকে উল্লেখযোগ্য চরিত্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মেলানি। কথকের মতে, তার মধ্যে হিন্দু পরিবারের ছাপ রয়েছে। মেলানি বেশিরভাগ সময়ই শাড়ি পরে এবং তাঁর বাড়ি থেকে ভেসে আসে বীণার আওয়াজ। সে বড়ই ভালবাসে আল্পনা আঁকতে– এইসব শেখা তাঁর ভারতীয় মায়ের থেকে। তাঁর প্রেমিক পুরুষ- ঠাকুর কৃষ্ণ। সিনেমার মাঝেমধ্যেই তাঁকে বলতে শোনা যায়–
“Someday I will find out where I belong.”
ছবিতে মেলানির পুরো চরিত্রটি ঘিরে এক অদ্ভুত দোলাচল। স্বপ্নে তাঁর রাধাবেশ। প্রেমিক পুরুষ কৃষ্ণকে বিমোহিত করতে সে ধ্রুপদী নাচে। আবার তাঁর প্রতি আসক্ত হ্যান্ডসম নাবিক ‘ক্যাপ্টেন জন’। যাঁর একটি পা কাঠের। অথচ জনকে কিছুতেই কাছে আসতে দেয় না মেলানি। যদিও জনের মাথায় ছুঁইয়ে দেয় সে তাঁর পুজোর ফুল। জনের বিশ্বাস ছিল– When an Indian girl gives her heart, its forever। নানা কথোপকথনের মাঝখানে জনকে একদিন সে জানায়, তাঁর আত্মপরিচিতির বিভ্রান্তির কথা। ‘হাফ-কাস্ট’-দের কোনো দেশ হয় না। যেমন হয় না, এক পায়ের নাবিকদের।
“Where will you find the country of a one-legged man?”
– তাঁর এই প্রশ্ন শুনে ক্যাপ্টেন জন বিচলিত হন। সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আবার সমুদ্রে বেরিয়ে পড়বেন। ‘দ্য রিভার’ নির্মাণের সময় জাঁ রেনোয়াঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে সত্যজিৎ রায়ের। পরিদর্শক হিসেবে, আউটডোরে সূর্যের স্বাভাবিক আলোয় শুটিং তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এর কয়েক বছর পরই ‘পথের পাঁচালি’-র কাজ শুরু হয়।
আরও পড়ুন
সংলাপ থেকে মিম! ৫০ পেরিয়ে শোলের যাত্রা যেভাবে চলছে
এরপর বলব, সত্যজিৎ রায়ের একটি কমিক ছবির কথা- ‘পরশপাথর’(১৯৫৮)। রাজশেখর বসুর গল্প অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটির মুখ্য চরিত্র পরেশবাবু একদিন হঠাৎ কর্মী ছাঁটাইয়ের নোটিশ পান। এমনিতেই টেনেটুনে চলছিল তাঁর সংসার। খানিক দিকভ্রান্ত হয়ে হাঁটছিলেন কলকাতার রাস্তায়। হঠাৎ কুড়িয়ে পেলেন একটি পাথর। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবিষ্কার হল, সে পাথর যে কোনো ধাতব জিনিসকে সোনায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম। পরেশবাবুর ফ্যাক্টরিতে শুরু হল সোনা উৎপাদন। টন টন লোহা-লক্কড় থেকে তৈরি হতে থাকল সোনা। হুড়মুড় করে সোনার দাম নেমে গেল বাজারে। একদিন টনক নড়ল সরকারেরও। থানায় ডেকে পাঠানো হল পরেশবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে। স্ত্রী পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন- এই অলক্ষুণে পাথরটিকে বিদায় করার জন্য।

মহানগর ছবির দৃশ্য
পরেশবাবু নিঃসন্তান। তাঁর প্রিয়, বিশ্বস্ত সেক্রেটারি- প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস। ছোকরা অতি নির্লোভ, সদ্য এম.এসসি পাশ করেছে। বেশিরভাগ সময় তার ঘরে, বান্ধবী হিন্দোলা মজুমদারের সঙ্গে গল্প করে সে সময় কাটায়। তবে তাঁর সময়জ্ঞান ঈর্ষাণীয় এবং পরেশবাবুর সোনা নির্মাণের উৎস নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র বাড়তি কৌতূহল নেই। এই প্রিয়তোষকেই পরশপাথর দেবেন বলে ঠিক করেন পরেশবাবু। প্রিয়তোষ জানিয়ে দেয়, সোনায় তাঁর আগ্রহ নেই তবে যেহেতু সে বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই পাথরটি একবার ল্যাবে নিয়ে গবেষণা করে দেখতে চায় সে। পুলিশের কাছে পরেশবাবুদের জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন হঠাৎ একটি ফোন আসে। জানা যায়, ধর্ম আলাদা বলে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পরশপাথর গিলে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে প্রিয়তোষ। পরেশগিন্নি হায়হায় করে ওঠেন। তবে অদ্ভুত মেটাবলিক ক্ষমতায় প্রিয়তোষ হেনরি সে পাথর হজম করে ফেলে। এরপর, পরশপাথরের ছোঁয়া সমস্ত সোনা ধীরে ধীরে লোহা হয়ে যায়। সিনেমার শেষের দিকে প্রিয়তোষ ঠিক করে সে একটি লোহার ফ্যাক্টরি বানাবে। রাজশেখর বসুর উপন্যাসটির শেষে তাঁকে বলতে শোনা যায়,
“...সেন্ট ফ্রান্সিস আর পরমহংসদেব খাঁটি কথা বলে গেছেন, কামিনী আর কাঞ্চন দুইই রাবিশ; লোহার তুল্য কিছু নেই। এখন সে পরেশবাবুর নতুন লোহার কারখানা চালাচ্ছে, রোজ পঞ্চাশ টন নানা রকম মাল ঢালাই করছে, এবং বেশ ফুর্তিতে আছে”।
সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর বরাবরই এক লৌকিক ও যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খেয়ে বেড়িয়েছে। অবাক করে এতকিছুর পরও প্রিয়তোষের লোহার কারখানার কথা। সোনা থেকে এই লোহায় ফিরে আসার অর্থ কী? এক অলৌকিক আলেয়া থেকে খাঁটি যুক্তিবাদ ও বাস্তবের কাঠিন্যে ফিরে আসার গল্প। তবে এখানে থাকে অন্য আরেকটি প্রশ্ন। পাথর হজম করাবার জন্য বসু বা রায় কেন বেছে নিলেন প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসকে? এই চরিত্রটি অঙ্কনের মধ্যেও রয়েছে এক মেদহীন যুক্তিবাদের ছাপ। এই যুক্তিবাদ নির্মাণের জন্যই কি প্রয়োজন পড়েছিল এক খ্রিস্টান পদবীর যুবককে? বলিষ্ঠ যুক্তিবাদ, বাস্তব ও ‘পশ্চিম’– কোথাও এই সমীকরণেরই কি ইঙ্গিত করেছেন লেখক পরশুরাম বা পরিচালক সত্যজিৎ রায়?
মিশ্র জাতির মানুষ হওয়ার এক অদ্ভুত দ্যোতনা– যে উপলব্ধি আমার পরিচিত বেশিরভাগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষদের। সাদা ও কালোর দ্বন্দ্ব, উপমহাদেশ– প্রথমবিশ্বের নাগরিকত্বের দ্বন্দ্ব, নিরন্তর খুঁজে চলা তাঁদের ‘স্যুইট হোম’, ভাষা ও মন। আসলে যে কোনো অপূর্ণতাই হয়ত মানুষকে চরণশীল করে তোলে। দিকবিহীন নাবিকের মতো সে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। কোথাও হয়ত রোহিঙ্গারা ঘুরছে, কোথাও আশ্রয় খুঁজছেন প্যালেস্টাইনের মানুষ। বহুদিন আগে কাঁটাতার পেরিয়ে এসেছিল একদল মানুষ, আবার রয়ে গেছে ঔপনিবেশিকের ফেলে যাওয়া কিছু সংকর সন্তান। আর এসবের মাঝখান দিয়েই প্রতিনিয়ত চলতে থাকে রাজনীতি, যুক্তিবাদ ও পরাবাস্তব, প্রাচীন ও আধুনিকের ঘূর্ণাবর্ত। এই কাঠামোতেই খুঁজে পাওয়া যায় 'মহানগর'-এর (১৯৬৩) এডিথ কিম্বা 'চিড়িয়াখানা'-র (১৯৬৭) রোজি-কে।
টকি সিনেমার আদিলগ্ন থেকে বিশেষ করে গোয়েন্দা কাহিনীতে একধরণের বুদ্ধিমতী, রহস্যময়ী নারী চরিত্র উঠে আসতে শুরু করে– পরিভাষায় যাদের বলা হয়- ‘Femme Fatale’। কথাটির অর্থ হল ‘deadly’ অথবা ‘lethal’ মহিলা। উত্তর-ঔপনিবেশিক জমানায় ছবি বানাতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়কেও ‘ফেমে ফাতাল’ খুঁজতে হয়েছিল এক অ্যাংলো যুবতীর মধ্যে।

পথের পাঁচালি ছবির দৃশ্য
রোজি-র চরিত্রটি খুবই অল্প সময়ের। ৯ নম্বর মির্জা মাহেদি লেনে একটি বাড়িতে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে সে। গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় উত্তমকুমার। রোজির পরনে পশ্চিমী পোশাক ও হাই হিল জুতো। অপরিচিত গোয়েন্দা বাড়িতে ঢুকে মুখ বেঁধে ফেললে ঘাবড়ে যায় না সে। কায়দা করে মুখের বাঁধন খুলে ফেলে এক কৌতুকহাস্য নিয়ে তাকিয়ে থাকে, বাইরে থেকে আসা গানের তালে পা নাচায়। কিন্তু নিশ্চুপে, সাংকেতিক ভাষায় তদন্তে সাহায্য করে গোয়েন্দাকে। এর ঠিক চার বছর আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘মহানগর’। অভিনেত্রী মাধবী মুখপাধ্যায়-কে সহকর্মী এডিথ সিমন্সের লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি দর্শকদের মন কেড়ে নেয়। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শহরমুখী হচ্ছে সমাজ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সংসার খরচের যোগান দিতে অফিসের ব্যাগ কাঁধে বেরিয়েছিলেন বাড়ির বউ আরতি মজুমদার। অফিসে তাঁর প্রথম বন্ধু হল ছোটচুলের অ্যাংলো মেয়ে এডিথ সিমন্স। কথায় কথায় প্রশ্ন করার স্বভাব তাঁর। সিনেমায় আরতির চেহারায় এক ছা-পোষা বাঙালি পরিবারের ছাপ দেখা যায়।
আরও পড়ুন
টানা ১১ বার পথের পাঁচালী দেখেছিলাম : শ্যাম বেনেগাল
অন্যদিকে, এডিথ চরিত্রটির এক ঝকঝকে আবেদন রয়েছে। খ্রিস্টান মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভালো চোখে দেখেনি আরতির পরিবার। অথচ তাঁর জন্যই আরতি প্রথমবার ঠোঁটে লাগালো লিপস্টিক, চোখে উঠল রোদ-চশমা। সিনেমার শেষে এডিথের চাকরি যায়। এডিথের গৃহসজ্জাতেও এক ইউরোপীয় পারিপাট্যের ছাপ ছিল। সুবিন্যস্ত তাঁর পোশাকের আলনা, ঘরে বিদেশি মিউজিক চলছে এবং নির্ভাবনায় এডিথ শুয়ে শুয়ে একটি ম্যাগাজিনের পাতা থেকে ছবি কাটছিলেন।
সত্যজিৎ রায় এই দুটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারী চরিত্রই নির্মাণ করেছেন সুতীক্ষ্ণ আধুনিকতার প্রচ্ছায়ায়। ছবির বাকি চরিত্রগুলির সঙ্গে তাঁদের বিভেদ দৃশ্যমান। তাঁদেরকে বহন করে এক জীবনমুখী-যুক্তিবাদী চেতনাও। তবে সুদক্ষ পরিচালক কিন্তু এই মিশ্র সংস্কৃতির চরিত্রদের শুধুমাত্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কিংবা পুরোপুরি ইউরোপীয় ছাঁচে আঁকেননি। তাই প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাসের আছে বাংলা কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগ, রোজির সঙ্গে ব্যোমকেশের এক স্বাভাবিক সমঝোতা গড়ে ওঠে, আর এডিথ তাঁর মনের কথা বলতে পারে বাঙালি আরতিকেই। এই চরিত্রগুলির মতো আসলে সত্যজিৎ রায়ও হয়ত অনুভব করেছিলেন পূর্ব ও পশ্চিমের সেই অদ্ভুত দোলাচল। এক ঘূর্ণন অথবা খোঁজ। ক্ষ্যাপার হাতে পরশপাথরের মতো, প্রিয়তোষের লোহার ব্যাবসার মতো তা যুক্তি ও অযুক্তির সঙ্গে নিরন্তর লুকোচুরি খেলে চলেছে।

Whatsapp
