দেবব্রত বিশ্বাসের গান কেন পছন্দ করতেন না অন্যান্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীরা?
Debabrata Biswas : দেবব্রত বিশ্বাসের এক পূর্বপুরুষ কালীকিশোর বিশ্বাস ছিলেন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত। ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে সে-সময় সাধারণ মানুষের কোনো স্বচ্ছ ধারণাই ছিল না।
উনিশ শতকের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে রামমোহনের ব্রাহ্ম সমাজ ও ধর্ম আন্দোলন ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিঁহ্ন। দেবব্রত বিশ্বাসের এক পূর্বপুরুষ কালীকিশোর বিশ্বাস ছিলেন এই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত। ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে সে-সময় সাধারণ মানুষের কোনো স্বচ্ছ ধারণাই ছিল না। হিন্দুদের বাইরে অন্য যে কোনো ধর্মের মানুষকেই তাঁরা বিধর্মী বা 'ম্লেচ্ছ' বলে জ্ঞান করতেন। তাই দেবব্রত বিশ্বাসের পরিবারও ছিলেন 'ম্লেচ্ছ'। ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল গান। দেবব্রত বিশ্বাসের পরিবারেও ছিল গানের আবহ। ব্রাহ্ম সমাজের যে কোনো অনুষ্ঠানে এঁরা ছিলেন নিয়মিত গায়ক-গায়িকা । ব্রাহ্ম সমাজের অনুষ্ঠানগুলিতে এঁরা যে গান গাইতেন তার অধিকাংশই ছিল রবীন্দ্রনাথ বিরচিত ব্রম্হসংগীত। পরিবারে গানের আগ্রহ লক্ষ্য করে দেবব্রত বিশ্বাসের বাবা কলকাতা থেকে একটি নতুন অর্গ্যান কিনে আনেন। আসলে গান ছিল তাঁদের পরিবারের কবচ কুণ্ডলের মতো।
তখন ছিল স্বাদেশিকতার যুগ। আকাশে-বাতাসে দেশাত্মবোধের আবহ। নজরুলের রক্ত গরম করা ' দুর্গম গিরি', মুকুন্দদাসের 'ছেড়ে দে রেশমী চুড়ি' তরুণ দেবব্রতকে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাড়িতে সাহিত্যচর্চাও সমান তালে অব্যাহত ছিল । 'সন্দেশ ' আর 'মৌচাক' ছাড়াও বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন মুখপত্রের পাঠক-পাঠিকা ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষ্ণকুমার মিত্রের 'সঞ্জীবনী'।
আরও পড়ুন-
রবীন্দ্রসংগীতের আকাশে যিনি একা ও অপ্রতিম।। কেন গান গাওয়া বন্ধ করেছিলেন বাঙালির জর্জ বিশ্বাস!
জীবন সব সময় নির্দিষ্ট পথে চলে না। চলার পথেও বাঁক আছে । মানুষকে জীবনের জন্য অন্নসংস্থান করতে হয়। অতএব দেবব্রত বিশ্বাসকেও সেই পথে হাঁটতে হয়েছিল। তিনি অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করলেন । এল.আই.সি অফিসে চাকরি করলেন। রবীন্দ্রতীর্থ জোড়াসাঁকোয় গেলেন, শান্তিনিকেতন গেলেন। তাঁর সামনে, সুরের জগতের এক বিশাল দরজা উন্মুক্ত হল। জোড়াসাঁকোর মাঘোৎসবের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে বিশ্বাস পরিবারের অংশগ্রহন ছিল অবধারিত।
এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে সংগীত শিল্পীরা, স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের সুযোগ পান । শুধু বামপন্থী শিল্পীরা নয়, সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী গণনাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ করলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে রবিশঙ্কর পর্যন্ত সকলেই এই আন্দোলনে সামিল হলেন। বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' বাংলা নাটকের ভাবনা-চিন্তায় বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এল। জর্জ বিশ্বাস-ও এই আন্দোলনের শরিক হলেন।

বাড়িতে, অবসর মুহূর্তে দেবব্রত বিশ্বাস
তাঁর পরিবার ছিল চিরকালই রবি ঠাকুরের ভক্ত। জর্জ, রবীন্দ্রগানে যে নতুন মাত্রা যোগ করলেন , তা কারোর মনোযোগ এড়িয়ে যায়নি । তাঁর গলায় রবীন্দ্রসংগীত আলাদা তাৎপর্য পায়। রাতারাতি বিপুল শ্রোতৃমণ্ডলী তৈরি করলেন তিনি। যখন তাঁর কণ্ঠে বাজতে থাকে, 'গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা' তখন সমুদ্র মন্থিত এক বেদনার বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে তাঁর কন্ঠস্বর। রবীন্দ্রগান যেন তাঁর উচ্চারণে নতুন অর্থ খুঁজে পায়। 'সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়' গানটিতে জর্জ বিশ্বাস তাঁর হৃদয়ের সমস্ত আকুতিকে যেন উজাড় করে দেন। সুদূর বিপুল সুদূর যেন কোন সুদূরেরই হাতছানি। 'তাসের দেশ ' নাটকের শেষ গানটির গায়নভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে দেন তিনি । কোনো পেলব ভঙ্গিমা নয় , বাঁধ ভাঙার জন্য তিনি ভাঙনের আহ্বানকে জোরালো কণ্ঠস্বরে ফুটিয়ে তুলতে শেখান।
রবীন্দ্রগানের কোনো ব্যাকরণের গণ্ডীতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি জর্জ বিশ্বাস। তবু যেসব শিল্পী নিজেদের রবীন্দ্রগানের জমিদার বলে মনে করতেন তাঁরা জর্জকে মেনে নিতে চাননি । জর্জ বিশ্বাসের বিপুল জনপ্রিয়তা তাঁদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তাঁরা প্রতিপদে তাঁর চলার পথে বাধা সৃষ্টি করলেন । তাঁরা 'তুমি রবে নীরবে' গানটিকে রেকর্ডিং-এর জন্য অনুমোদন দিতে চাননি। কেন ? কারণ, যেখানে আছে 'মম দুঃখ বেদন ,সফল স্বপন' সেখানে নাকি তিনি সফলের বদলে 'সকল'' গেয়েছেন। কিন্ত জর্জ বললেন , স্বরলিপিতে তিনি সকল পেয়েছেন । অনাদি দস্তিদার প্রথমে রাজি না হলেও, পরে রাজি হন। এক সময় জর্জ বিশ্বাসের গানকে 'অতিনাটকীয়' বলে বর্জন করার চেষ্টা-ও করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন-
জোড়াসাঁকোতে অসমবর্ণ বিবাহ, সম্বন্ধ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
হিজ মাস্টার্স ভয়েস , কলম্বিয়া , হিন্দুস্থান ও ইনরেকো রেকর্ড কোম্পানিগুলি জর্জ বিশ্বাসের গান রেকর্ড করতে উৎসাহিত হন। কিন্ত বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড দেবব্রত-র গান রেকর্ডিং-এ বাধা দিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, জর্জ কোথাও কারোর কাছে বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ নেননি। সেই কারণে রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি যথাযোগ্য জায়গায় যথাসম্মতভাবে অনুসৃত হয়নি। মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রানুষঙ্গ যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। অতএব দেবব্রত বিশ্বাসকে বিশ্বভারতীর নিয়ম মেনেই গান গাইতে হবে। নয়তো নয়।

দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড
দেবব্রত মনের খুশিতে গান গাইতেন । কোনো ব্যাকরণ মেনে নয়। জর্জ বিশ্বাসের মনের আনন্দ প্রচণ্ড পরিমাণে ধাক্কা খেল। তাঁর জন্মগত হাঁপানি রোগটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। জর্জ বিশ্বাসের গান বন্ধ করার জন্য এ ছিল এক জঘন্য চক্রান্ত। পরবর্তী যুগের বহু বিখ্যাত শিল্পীও এই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন। একদিনকার ' ম্লেচ্ছ' জর্জ, গানের জগতেও 'ব্রাত্য' হয়ে রইলেন। তবু তাঁর গান ইংরিজিতে অনূদিত হয়েছে। যেমন 'ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু' (This weariness forgive me oh my Lord) এবং 'বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও' (With a high hope come upto you), প্রভৃতি গান তাঁর কণ্ঠে বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর গাওয়া ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি তক্কো গপ্পো' চলচ্চিত্রে 'কেন চেয়ে আছ গো মা মুখপানে', 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিতে দ্বৈত কণ্ঠে 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি' এক কথায় অনবদ্য।
এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল 'এক্ষণ' পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩৭৪ সংখ্যায়। 'রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা" শীর্ষক একটি রচনায় তিনি আমাদের অনেক নতুন ভাবনার সম্মুখীন করে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ বলেছিলেন, "'performer is never greater than music'. আবার, 'মরি লো মরি যখন শুনব' তখন তা অমিয়া ঠাকুরের গলাতেই তা শুনতে চাইব।" সত্যজিৎ সব রবীন্দ্রসংগীতে তবলা ব্যবহারেরও বিরোধিতা করেছেন। অতএব ভাববার অনেক পরিসরই থেকে গেলেও জর্জ বিশ্বাসের ভূমিকা রবীন্দ্রসংগীতের আকাশে এককভাবেই জেগে থাকে।
Whatsapp
