দেশ জুড়ে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক নির্যাতন কীভাবে থামাতে পারে সরকার?
Migrant Labours : কর্মসংস্থানের অভাব। কিছু ক্ষেত্রে আবার, প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও কাজের সুযোগ না থাকায় শ্রমিকেরা আবারও বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে, পাট শিল্প নিয়ে কেন্দ্রের উদাসীনতা প্রশ্নের মুখোমুখি, জুট কর্পোরেশ...
বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতি বছর হাজার-হাজার শ্রমিক জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কৃষি ও স্থানীয় পর্যায়ে কাজের অভাব, দারিদ্র্য, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং অতিরিক্ত আয়ের প্রয়োজন তাদের বাধ্য করে পরিবার ছেড়ে অজানা শহরে পাড়ি দিতে। অথচ এটাই সত্য— শ্রম, পুঁজি এবং পণ্যের মতো মানুষের চলাচলকেও আটকে রাখা যায় না; অর্থনীতির চাহিদা-যোগানের সহজ সূত্রেই তা ঘটে। এই শ্রমিকরা ইটভাটায়, দোকানে, ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। রাজমিস্ত্রি বা সহকারীর কাজে দেশের নানা প্রান্তে দিনরাত পরিশ্রম করেন। কিন্তু রোজগারের নিশ্চয়তার পরিবর্তে তাদের ভাগ্যে নেমে এসেছে ভয়, হেনস্থা ও অনিশ্চয়তা।
আরও পড়ুন-
দেশজুড়ে বাঙালি খেদাও অভিযান! কী বলছে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল?
ভাষার অপরাধে নির্যাতন
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে, বাংলা ভাষাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হেনস্থার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। শুধু বাংলা বলার অপরাধেই তাদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পরিচয়পত্র যাচাইয়ের নামে পুলিশ টার্গেট করছে বাঙালি শ্রমিকদের; মাঝরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হচ্ছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখা হচ্ছে— ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে তোলার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। জল, খাবার, ওষুধ— কিছুই দেওয়া হচ্ছে না; অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁরা দিন-রাত কাটাচ্ছে।
পুলিশ ও বিএসএফের বিচারক সাজার প্রবণতা
বিজেপি-শাসিত রাজ্যের পুলিশ নাগরিকত্ব যাচাই না করেই শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশি’ ঘোষণা করছে। অনেককে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, এবং বিএসএফ তাঁদের মারধর করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ-ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই উদাহরণ। শিশুদেরও এর থেকে রেহাই নেই। পরিবারের সদস্যরা জানতেই পারছেন না প্রিয়জন কোথায়, বেঁচে আছে কি না। আটক শ্রমিকদের অনেকের কাছেই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড আছে। তবুও তাঁরা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আতঙ্কে গ্রামে ফিরে আসছেন— কিন্তু সেখানেও কাজ নেই, আছে ঋণের বোঝা ও অভাব। স্কুলছুট হচ্ছে সন্তান, রোগীর ওষুধ বন্ধ, পরিবার ভেঙে পড়ছে।

ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক
সরকারের নীরবতা ও ব্যর্থতা
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো হলেও কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। আমি নিজে আরটিআই (RTI) করে জানতে চেয়েছিলাম— ১. পরিযায়ী শ্রমিকদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে কী কী নথি লাগবে? ২. কতজন শ্রমিক বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে আটক? বলা বাহুল্য, কোনও উত্তর আসেনি।
নির্যাতনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত
দিল্লি পুলিশ ২০১৫ সালে ছিটমহলের নাগরিকত্বপ্রাপ্ত সামশুল হককে 'বাংলাদেশি' বলে আটক করে। মুর্শিদাবাদের সুজন সরকারকে উড়িষ্যায় 'বাংলা' বলার কারণে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ, তারপর রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে। লালবাগের মিলন সেখ ও ইসমাইল সেখকে চেন্নাইয়ে মারধর করে হাত ভেঙে, মাথা ফাটিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, কোর্টে না তুলে দিনের পর দিন পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক রাখার ঘটনা বারবার ঘটছে। এক্ষেত্রে সমাধানের একটাই পথ, প্রতিটি রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হেল্পডেস্ক ও আইনি সহায়তা কেন্দ্র গঠন করতে হবে। এবং পরিচয়পত্র যাচাইয়ের নামে হয়রানি বন্ধের ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে কড়া পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। রাজ্য সরকারকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে একটি স্পষ্ট তালিকা প্রস্তুত করতে হবে যে, কারা-কারা ভিন রাজ্যে কাজ করতে গেছেন।

ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক
কর্মসংস্থানের অভাব। কিছু ক্ষেত্রে আবার, প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও কাজের সুযোগ না থাকায় শ্রমিকেরা আবারও বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে, পাট শিল্প নিয়ে কেন্দ্রের উদাসীনতা প্রশ্নের মুখোমুখি, জুট কর্পোরেশন কার্যত বন্ধ। দীর্ঘদিন ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় সমস্যা আরও গভীর হয়েছে; হাইকোর্টের নির্দেশে কিছুটা স্বস্তি মিললেও তা যথেষ্ট নয়। তবুও ১ আগষ্ট থেকে কাজ শুরু হয়নি। প্রশিক্ষণের পর, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারকে শ্রমিকদের 'কর্মস্থান' নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন-
দেশজুড়ে বাঙালি খেদাও অভিযান! কী বলছে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল?
সচেতন সমাজ ও সরকারের যৌথ দায়িত্ব হল স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই কর্মসংস্থান গড়ে তোলা। হস্তশিল্প, কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগকে শক্তিশালী করে তোলা। কেন্দ্রের উচিত আন্তঃরাজ্য শ্রমিকদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করা। সচেতন নাগরিক সমাজকেও রুখে দাঁড়াতে হবে। যাঁরা ঘাম-রক্তে দেশ গড়ছেন, তাঁদের হেনস্থা সভ্যতার লজ্জা। ভাষা, ধর্ম বা রাজ্য নির্বিশেষে শ্রমিকদের মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে— এটাই সভ্য-সমাজের পরিচয়।স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি শক্তিশালী সংবিধান থাকা সত্বেও বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা স্বাধীন দেশে পরাধীন ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছেন। ভাষার স্বাধীনতা হারিয়ে, মাতৃভাষা বলতেও আজ ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। বাংলা ভাষা খুন হচ্ছে। এই লজ্জা দেশের লজ্জা— যা থামাতে হবে এখনই।
Whatsapp
