অলিম্পিক-জয় থেকে শল্যচিকিৎসা ভেস পেজের এক জীবনে বহু জীবন

Vece Paes : ড. ভেস পেজ আমাদের শিখিয়ে গেছেন—জয় মানে শুধু পদক নয়, জয় মানে সততা, নিষ্ঠা, আর মানুষের সেবায় আত্মনিবেদন।

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জীবন যেন এক পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য—অধ্যায় বদলালেও কোথাও থেমে যায় না, বরং প্রতিটি অধ্যায়েই নতুন রং, নতুন গৌরবগাথা যুক্ত হয়। ড. ভেস পেজ তাঁদেরই একজন। ২০২৫-এর ১৪ অগাস্ট, কলকাতার আকাশে এক নিঃশব্দ বিদায়ের সুর বেজে উঠল—চলে গেলেন সেই মানুষটি, যিনি একসঙ্গে ছিলেন ক্রীড়ার নক্ষত্র, শল্যচিকিৎসার নীরব কারিগর, এবং প্রশাসনের দৃঢ় নাবিক।

১৯৭১ সালের বার্সেলোনা বিশ্বকাপ—ভারতীয় ফিল্ড হকি দলের মিডফিল্ডে তাঁর নির্ভুল পাস ও কৌশলী চালনায় জন্ম নিয়েছিল এক অমর অধ্যায়। পরের বছরই, মিউনিখ অলিম্পিকে তিনি ব্রোঞ্জ পদক জয় করে সারা দেশের গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। মাঠের ভেতর তাঁর চোখ ছিল সতর্ক বাজপাখির মতো। বাইরে, তিনি ছিলেন সংযত ও নীরব, কিন্তু ভিতরে জ্বলত এক অদম্য আগুন।

আরও পড়ুন-

মোহনবাগানের ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড জয়, ব্রিটিশদের আত্মবিশ্বাস কীভাবে ভেঙেছিল শিবদাস ভাদুড়ীর দল?

এরপর, খেলার মাঠ থেকে তিনি পা বাড়ালেন চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পথে। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস, তারপর সার্জারিতে মাস্টার্স করলেন। শুরু হল তাঁর দ্বিতীয় যাত্রা। খেলোয়াড়দের সুস্থতা ও দীর্ঘমেয়াদি ফিটনেস নিশ্চিত করাই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। অল ইন্ডিয়া টেনিস অ্যাসোসিয়েশন, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অ্যান্টি-ডোপিং আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ডেভিস কাপের টিম ডাক্তার হিসেবে তিনি খেলোয়াড়দের শুধু শারীরিক শুশ্রূষা-ই দেননি— তাঁদের মানসিক দৃঢ়তাও বাড়িয়ে তুলেছিলেন নীরবে।

ড. ভেস পেজ

ড. ভেস পেজ-এর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রাগবি ফুটবল ইউনিয়ন ও ঐতিহ্যবাহী ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব পেয়েছিল নতুন প্রাণ। তাঁর কাজের মধ্যে ছিল শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতা, আর খেলোয়াড়দের প্রতি অসীম মমতা।

জেনিফার পেজ

লিয়েন্ডার পেজ

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন প্রাক্তন জাতীয় বাস্কেটবল অধিনায়ক জেনিফার পেজ-এর জীবনসঙ্গী, এবং ভারতের টেনিস কিংবদন্তি লিয়েন্ডার পেজ-এর পিতা। এ-প্রসঙ্গে যে তথ্যটি না জানালেই নয়, তা হল, তাঁর স্ত্রী জেনিফার ছিলেন বঙ্গীয় রেনেসাঁসের নবযুগের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের উত্তরপ্রজন্ম। পরিবারের ঐতিহ্য, দেশের প্রতি ভালোবাসা, এবং মানবিকতা—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল প্রেরণার এক অনন্য পাঠশালা।

আরও পড়ুন-

আগুন-ধোঁয়ার কুণ্ডলী ও দুই ফুটবলার! কীভাবে জন্ম নিল পৃথিবী বিখ্যাত এই ছবি?

ড. ভেস পেয আমাদের শিখিয়ে গেছেন—জয় মানে শুধু পদক নয়, জয় মানে সততা, নিষ্ঠা, আর মানুষের সেবায় আত্মনিবেদন। তাঁর প্রয়াণ ক্রীড়াঙ্গন ও চিকিৎসাক্ষেত্রে এক অপূরণীয় শূন্যতা রেখে গেল, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ ও অনুপ্রেরণা আমাদের পথ দেখাবে চিরকাল।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদায়, ড. ভেস পেজ—আপনার খেলার সবুজ মাঠ, সার্জারির টেবিল, খেলোয়াড়দের ঘাম ও হাসি—সবই আমাদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে। আপনি নেই, কিন্তু আপনার জীবনগান বেজে চলবে সময়ের অন্তিম প্রান্ত পর্যন্ত।

More Articles