১৩৫ বছর ধরে নেশার জল বেচছে কোকাকোলা? কীভাবে জন্ম নিল এই পানীয়, অবাক করবে যে ইতিহাস

History of Coca-Cola: নেশায় বুঁদ জন হুইস্কিতে সোডা মেশানোর পরিবর্তে কোকা আর কোলা বাদামের মিশ্রণে সোডা মিশিয়ে গ্লাসে চুমুক দেন। ব্যাস প্রথম চুমুকেই একপ্রকার ক্লিন বোল্ড হয়ে যান জন পেম্বারটন।

বিশ্ব বাজারে কোকা কোলা কোম্পানি ১৩৫ বছর সম্পন্ন করেছে গত বছর। সুদীর্ঘ এই সময়ে নানা উপায়ে নিজেদের ছাপ রেখেছে এই সংস্থা। কোকা কোলা কোম্পানির লোগো, বিজ্ঞাপন, ট্যাগলাইন এবং সর্বোপরি প্রোডাক্ট সবই ব্যবসায়িকভাবে অত্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেছে। কিন্তু অনেকেরই অজানা, এই পানীয়টির প্রস্তুতকারক জাতীয় ওষুধ হিসেবে বাজারে নিয়ে এসেছিলেন মিশ্রণটিকে। এমনকী সংস্থার এত সাফল্য তিনি চাক্ষুষ করতেও পারেননি। কীভাবে শুরু হল কোকা কোলা কোম্পানির ব্যবসা?

কোকা কোলা তৈরির নেপথ্য নায়ক

১৮৩১ সালের ৮ জুলাই আমেরিকার জর্জিয়াতে জন্ম হয় জন পেম্বারটনের। পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই ভালো ছিলের তিনি। রিফর্ম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনার জন্য। ১৮৫০ সালে ডিগ্রি এবং লাইসেন্স দুই’ই অর্জন করেন জন। পেম্বারটনের স্বপ্ন ছিল মানুষের রোগ মুক্তির জন্য নানা ওষুধ তৈরি করবেন তিনি। কিন্তু সেই সময় দাসপ্রথা নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আমেরিকায়। গৃহযুদ্ধে পেম্বারটন লড়াই করেছিলেন জর্জিয়ার স্টেট গার্ডের হয়ে। ব্যাটেল অফ কলম্বাসের লড়াইয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মরফিন ইনজেকশন নেওয়া শুরু করেন জন। দিনে দু’ তিনবার মরফিন গ্রহণ করতে থাকায় একসময় চূড়ান্তভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন জন পেম্বারটন।

তখনকার সময় মরফিন ছিল বেশ দামি নেশা। তাই পয়সায় কুলোতে না পেরে সহজলভ্য কোকা পাতা চিবোতে শুরু করেন পেম্বারটন। কোকা গাছ থেকেই তৈরি হয় আরেক ভয়ঙ্কর ড্রাগ কোকেন। কোকা পাতা চিবোলে নেশা হয় ঠিকই কিন্তু স্বাদে এতই তেতো যে মুখে বেশিক্ষণ রাখাই যায় না। তাই এই পাতাকে সামান্য উপাদেয় করতেই নিজের ল্যাবেরটরিতে কোকা পাতার নির্যাসের সঙ্গে নানা উপাদান মিশোতে শুরু করেন তিনি। শুধুমাত্র নিজের নেশার দ্রব্য জোগান রাখতেই পেম্বারটন গবেষণা শুরু করেন।

একদিন এভাবেই কোকা পাতার নির্যাসের সঙ্গে কোলা বাদামের গুঁড়ো মিশিয়েছিলেন জন। স্বাদে বেশ ভালোই ছিল সেই পানীয়। কিন্তু পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় নেশায় বুঁদ জন হুইস্কিতে সোডা মেশানোর পরিবর্তে কোকা আর কোলা বাদামের মিশ্রণে সোডা মিশিয়ে গ্লাসে চুমুক দেন। ব্যাস প্রথম চুমুকেই একপ্রকার ক্লিন বোল্ড হয়ে যান জন পেম্বারটন।

আরও পড়ুন- কোকে কোকেন ফেরাব, বলছেন এলন মাস্ক || সত্যিই কি ঠান্ডা পানীয়ে মিশত ভয়ানক মাদক?

পরের দিন বন্ধু উইলিস ভেনাবলের সঙ্গে দেখা করেন পেম্বারটন। উইলিস ওষুধের দোকানের মালিক। বন্ধুকেও সেই কোকা পাতা, কোলা বাদামের গুঁড়ো এবং সোডা ওয়াটারের মিশ্রণটি চেখে দেখতে অনুরোধ করেন জন পেম্বারটন। উইলিস এক চুমুক দিয়েই আনন্দে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন। সেদিনই দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেন এই মিশ্রণকে ব্যবসায়িকভাবে বাজারে আনবেন তিনি।

কয়েক মাসের মধ্যেই পেম্বারটনের তৈরি করা মিশ্রণটি দুই বন্ধু মিলে ব্রেন টনিক জাতীয় ওষুধ হিসেবে বাজারে এনেছিলেন। মিশ্রণটি খেলে বেশ ফুরফুরে লাগে এবং মানসিক অবসাদ কাটে। সেই সময় মিশ্রণটির এক গ্লাসের দাম ছিল পাঁচ সেন্ট। তবে প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধি সম্পন্ন পেম্বারটন নিজের বন্ধুকেও ওই মিশ্রণ তৈরির ফর্মুলা জানাননি। নিজের ল্যাবরটরিতেই তৈরি করতেন মিশ্রণটি। বাজারে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ব্রেন টনিকের পরিবর্তে সোডা ফাউন্টেন ড্রিংক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পেম্বারটনের মিশ্রণটি। একসময় কোম্পানির নাম দেওয়ার তাগিদেই বিজ্ঞাপন কোম্পানির মালিক ফ্র্যাঙ্ক ম্যাসন রবিনসন এই মিশ্রণটির নাম রাখলেন Coca Cola। তৈরি হল সবার পছন্দের কোকা-কোলা ব্র্যান্ড।

তবে মরফিনের নেশা ছাড়তে পারেননি জন। একসময় নেশায় প্রায় দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছিলেন তিনি। সংসার চালাবার তাগিদে তাই বেচতে হয়েছিল কোকা কোলা তৈরির ফর্মুলা। যদিও সিংহভাগ শেয়ার রেখেছিলেন নিজের তত্ত্বাবধানেই। ভেবেছিলেন তাঁর ছেলে চার্লি এই ব্যবসার হাল ধরবে ভবিষ্যতে। তবে অনেকেই বলেন, কোকাকোলার ফর্মুলা বেচলেও কোনওদিনও নাকি পুরোটা কাউকেই জানাননি তিনি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন একদিন এই পানীয় আমেরিকার জাতীয় পানীয় হয়ে উঠবে। তবে জনের পর তাঁর ছেলে চার্লিও প্রথমদিকে ব্যবসা জমাতে পারেননি। তবে কোকাকোলা নামের পেটেন্ট ছিল চার্লির কাছেই। বাবার মতো মরফিনের নেশা ছিল চার্লির। এমনকী সঙ্গে মদ ও আফিমের নেশাও করতেন তিনি। তাই টাকা রোজগারের আশায় ১৮৮৮ সালে ধনকুবের এসা ক্যান্ডলারকে কোকা কোলা কোম্পানি বেচে দেন চার্লি। সে বছরই পাকস্থলীর ক্যান্সারে ভুগে মারা যান জন পেম্বারটন। জনের মৃত্যুর ছয় বছরের মধ্যেই মৃত্যু হয় চার্লির। মৃত্যুর সময় কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেলেও নেশা ছাড়তে পারেননি বাবা ও ছেলে। তবে এসার বুদ্ধিতেই কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে ওঠে সংস্থার ব্যবসা।

আরও পড়ুন- টয়লেট ক্লিনার দিয়ে তৈরি হয় কোল্ড ড্রিঙ্কস! চমকে দেওয়া তথ্য জানাচ্ছে আসল সত্য

জোরকদমে বিজ্ঞাপন

জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যেতে নানা কৌশল অবলম্বন করে কোম্পানি। বিভিন্ন প্রিন্ট মাধ্যম যেমন ন্যাপকিন, দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে এই কোম্পানি। কোকা কোলা কোম্পানি বিজ্ঞাপনের উপর কতখানি জোর দিত তার প্রমাণ তাদের বিজ্ঞাপনী বাজেট। ১৯১১ সালেই এই কোম্পানি আনুমানিক এক মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিজ্ঞাপনে। এক দশক পরেই ফোর্বসের প্রথম ১০ কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নেয় কোকা কোলা। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধেই বিখ্যাত আমেরিকান মডেল হিলডা ক্লার্ক এই কোম্পানির মুখ হয়ে ওঠে, যা সময়ের নিরিখে একেবারে ভিন্ন পদক্ষেপ। ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশিয় ম্যাগাজিন, রেডিও চ্যানেল এবং অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন চালু করল কোম্পানি। ১৯৬১ সালে কোম্পানি বাজারে নিয়ে এল নতুন পানীয় স্প্রাইট (Sprite)। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন চালু হল তখন কোম্পানির আয় বিদেশের বাজারে প্রায় ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে পেপসির জনপ্রিয়তায় খানিক ভাটা পড়ে ব্যবসায় কিন্তু ব্যবসায়িক কৌশল বদলে বাজারে টিকে থাকে কোকা কোলা।

ভারতে কোকা কোলা

১৯৫৯ সাল নাগাদ ভারতের বাজারে প্রবেশ করে কোকা কোলা কোম্পানি। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তারা ভারত থেকে ধীরে ধীরে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় বাজারের মন্দার কারণে। এরপর ১৯৭৭ সালে শিল্প মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের দাবির মুখে পড়ে সম্পূর্ণভাবে ব্যবসা তুলে নেয় কোকা কোলা কোম্পানি। তারপর ১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের সরকারের সময় উদার অর্থনীতির জন্য ফের ভারতে আসে কোকা কোলা। পেপসির সঙ্গে বারে বারে ব্যবসায়িক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও বিজ্ঞাপনের উপর ভর করে আজও ভারতের বাজারে টিকে রয়েছে কোকা কোলা। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে মোট ২৭৪১.৫৪ কোটি আয় বেড়েছে কোম্পানির যা আগের বছরের তুলনায় ১৮.৬৩ শতাংশ বেশি। নস্টালজিয়াকে অক্ষত রেখেই আজও ভারত তথা বিশ্ববাসীর মনে নিজের জায়গা ধরে রেখেছে কোকা কোলা। একশো শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য ক্যানের মতো পরিবেশ বান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করে নতুন প্রজন্মকে কোকের নেশায় বুদ করে রেখেছে কোকা কোলা কোম্পানি।

 

More Articles