দুর্গাপুজোয় পেটপুজোর ঢল! চমকে দেবে কলকাতার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির এ বছরের লাভের অঙ্ক
Kolkata splurges on food during Durga puja: ২০২৩ সালে যে ভোজনরসিক বাঙালির দৌলতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি পেটপুজোটিও বেশ ভালোই মিটেছে, সে কথা জানান দিচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির লাভের খাতাই।
অক্টোবরের কলকাতার একটা আলাদা আমেজ রয়েছে। আলোয় সেজে ওঠা অলিগলি শহরতলি, দুর্দান্ত সব প্যান্ডেল, ঢাউস সব প্রতিমা, রাস্তার মোড়ে মোড়ে খাবারের দোকান, রাস্তায় জনস্রোত, রেস্তোরাঁর সামনে মানুষের লম্বা লাইন। বহু মানুষেরই সম্বৎসরের আয় নির্ভর করে এই পুজোর সময়টার উপরে। ছোট ছোট খাবারের দোকানেরা লাভের মুখ দেখে। ফুলে ফেঁপে ওঠে বড় বড় রেস্তোঁরা-চেনগুলি। হবে না-ই বা কেন! পেটপুজো ছাড়া যে কোনও উৎসবই যে ফিকে। অন্তত বাঙালির কাছে তো বটেই।
করোনা অতিমারির দৌলতে মধ্যিখানে বেশ কয়েকটা বছর নমো নমো করেই পুজো সারতে হয়েছে বাঙালিকে। সেই দুটো বছর অতিকষ্ট নিজেকে বাড়িতে বন্দি করে রেখেছিল মানুষ। পুজোর প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরি, নতুন জামা পরা, ঠাকুর দেখা বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সব কিছুই থমকে গিয়েছিল। তবে সেই অন্ধকার কাটিয়ে গত বছর থেকেই আলোয় ফিরেছে কলকাতা, ফিরেছে উৎসবের মেজাজে। ২০২২ সালে তবু লকডাউনের স্মৃতি খানিকটা বেধে রেখেছিল মানুষকে। তবে সেই সমস্ত বাধা কাটিয়ে এ বছর পুরোদমে মেজাজে ছিল পুজোর কলকাতা। কার্যত মহালয়ার দিন থেকেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়েছিল মানুষ। ঠাকুর দেখার সঙ্গে সঙ্গে পেটপুজোও হয়েছে আশ মিটিয়ে। আর লক্ষ্মীলাভ হয়েছে কলকাতার খাবারের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির। কলকাতার হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবের খাতা অবষ্য তেমনটাই বলছে। এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে পঞ্চমী থেকে দশমী, এই ছ'দিনে নাকি প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা আয় করেছে শহরের ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলি। যা গত বছরের এই সময়ের থেকে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি তো হবেই।
আরও পড়ুন: পুজো পরিক্রমা
২০২০ সালটা শুধু কলকাতা বা ভারত, গোটা বিশ্ব জুড়েই এক বিভীষিতাময় সময়। করোনা নামক এক ভয়ঙ্কর ভাইরাস এসে কার্যত কেড়ে নিয়েছিল মানুষর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনের ছন্দটাকেই পাল্টে দিয়েছিল অসুখ, লকডাউন আর মৃত্যুমিছিল। একের পর এক ঢেউ এসেছে। সেই সব ঢেউ সামনে ২০২২ সালে অবশেষে কোভিড কড়াকড়ি থেকে কিছুটা রেহাই পায় মানুষ। তবে ভয়-আতঙ্ক সবটাই তখনও ছিল। সেই সব স্মৃতি ঝেড়ে ২০২৩ সালে আনন্দে গা ভাসিয়েছিল কলকাতাবাসী। মেতে উঠেছিল শারদোৎসবে।
মহালয়া থেকেই যে উৎসবের আমেজ শুরু হয়েছিল, তা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয় পঞ্চমী থেকে। দশমীর দিন মঙ্গলবার পড়ায় এ বছর বহু পুজোকমিটিই প্রতিমা বিসর্জন দেননি। ফলে উৎসবের জন্য আরও একদিন সময় বেশি পেয়েছেন কলকাতাবাসী। আর সেই দিনটারও যে পূর্ণ ব্যবহার তাঁরা করেছেন, তা তো হোটেল রেস্তোরাঁর আয়ের হিসাবই বলে দিচ্ছে। দশমীর দিন গভীর রাত পর্যন্ত হোটেল রেস্তোরাঁগুলি কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (HRAEI)-র সভাপতি সুদেশ পোদ্দারও জানাচ্ছেন সেই কথাই। পুজোর দিনগুলো রাতভর মানুষ ভিড় জমিয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁতে। রাত তিনটের সময়েই ফাঁকা পাওয়া যেত না খাওয়ার জায়গাগুলি। কলকাতায় নিজের একটি রেস্তোরাঁ কাম বার রয়েছে সুদেশ বাবুরও। তিনি জানাচ্ছেন, প্রাথমিক হিসেবে যা দেখা যাচ্ছে, এই পুজোর মরসুমে ১,১০০ কোটি টাকার উপরে ব্যবসা করেছে কলকাতার রেস্তোরাঁগুলি।
গত বছরের তুলনায় বিক্রি অনেকটাই বেড়েছে অনেকবছর। বেড়েছে মানুষের উন্মাদনা। মানুষ যেমন বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁয় এসে খেয়েছেন, তেমনই বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে খাবার বাড়িতে অর্ডার করেও খেয়েছেন। এ বছর পুজোয় বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বেশ কয়েকটি ভালো সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। মানুষ পুজোর রুটিনে ঢুকিয়ে ফেলেছেন সেই সিনেমা দেখাকেও। বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গেও কিন্তু ফুড চেনের একটা যোগ থাকে। সেখান থেকেও ভালোই লাভ এসেছে। আর সিনেমা দেখে বা সারাদিন-রাত ঠাকুর দেখে সুস্বাদু খাবারের খোঁজ তো ছিলই। তেমনটাই জানালেন পিটার ক্যাট ও মোকাম্বর মতো নামী রেস্তরাঁর মালিক নীতিন কোঠারি। নবমীর সন্ধ্যাতেও কানায় কানায় পূর্ণ ছিল নীতিনবাবুর প্রত্যেকটি রেস্তোরাঁ। আমিনিয়ার সেলস ডিরেক্টর আজরা আশের আথারের গলাতেও শোনা গেল সেই সুর। মানুষ যেভাবে দুর্গাপুজোর আনন্দে রেস্তোরাঁগুলিকে সঙ্গী করেছে, তাতে আপ্লুত তাঁকা। গত বছরের তুলনায় প্রতিটি আউটলেটে এ সময়টায় বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১০-১২ শতাংশ।
আরও পড়ুন:পুজোয় জোয়ার ক্ষণিকের প্রেমেরই! কেন হু হু করে বাড়ছে ‘ফেস্টিভাল ডেটিং’?
কলকাতার বহু রেস্তোরাঁতেই দুর্গাপুজোর জন্য বিশেষ কিছু মেনু অফার করা হয়। আসলে এ সময়টায় ঐতিহ্যের দিকে ছোটেন বহু বাঙালিই। খাঁটি বাঙালি খাবারের চাহিদা স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ে। আর তার সঙ্গে চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, মোগলাই- এ সব তো রয়েছেই। সেই সব আন্তর্জাতিক কুইজেনের দিকেও ছোটেন অনেকে। দুর্গাপুজোর চারটে দিন বাড়িতে রান্না করার চেয়ে হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেতেও পছন্দ করেন অনেকে। বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি অ্যাপগুলির কল্যাণে সেই ব্যাপারটি এখন আরও সহজ হয়েছে। ফলে ভোজনরসিকদের সঙ্গে সঙ্গে রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ীদেরও পোয়া বারো। সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে প্রায় এক মাসের এই মহোৎসব, তাতে ভীষণ রকম জরুরি এই পেটপুজো ব্যাপারটি। আর ২০২৩ সালে যে ভোজনরসিক বাঙালির দৌলতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি পেটপুজোটিও বেশ ভালোই মিটেছে, সে কথা জানান দিচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির লাভের খাতাই। আগামী বছরগুলিতে সেই খাতাও যে রেস্তোরাঁর চেয়ারের মতোই ভরে উঠবে, তা নিয়ে আশাবাদী কলকাতার হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশন।