ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েমে আরএসএস-এর ভূমিকা

Socio Political Economy of India: গত ৯ সেপ্টেম্বর, শনিবার কলকাতার রায়া দেবনাথ মঞ্চে সারা বাংলা কর্পোরেট আগ্রাসন বিরোধী উদ্যোগে বক্তৃতা দেন সুমন কল্যাণ মৌলিক। সেই বক্তৃতার লিখিত সংরূপ ইনস্ক্রিপ্ট-এ ধরা রইল।

সারা বাংলা কর্পোরেট আগ্রাসন বিরোধী গণ উদ্যোগ আয়োজিত 'নয়া উদারবাদী কর্পোরেট তন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদের গাঁটছড়া' শীর্ষক আলোচনা সভায় আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই। আজকের সভার বিষয়বস্তু বহু পূর্বেই ঘোষিত। আজকের প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করব ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল কুশীলব রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতাদর্শগত অবস্থান, তার বিবর্তন, ফলিত অর্থনীতিতে তার প্রয়োগ। এখানে তাত্ত্বিক অবস্থান ও বাস্তব প্রয়োগে সঙ্ঘের দ্বিচারিতার প্রশ্নটিও আলোচিত হবে, না হলে আজকের ভারতবর্ষ যারা শাসন করছেন তাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বরূপ আমরা চিহ্নিত করতে পারব না।

(১)

অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে একটা কথা প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। একটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে অর্থনীতির চরিত্র বিচার, তার কার্যকারিতার মূল্যাঙ্কন আসলে সেটা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার হওয়া জরুরি। যেমন ধরুন ভারতে একজন ব্যাক্তি মানুষের আর্থিক সম্পদ দেশের ৪৫ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। এই তথ্যটিকে আপনি কীভাবে দেখবেন তা আসলে আপনার চেতনা সঞ্জাত দৃষ্টি ভঙ্গির উপর নির্ভর করবে। বিশ্বায়নের এই জমানায় এক গুজরাটি বেনিয়ার এই চোখ ধাঁধানো সাফল্যে আপনি উর্ধ্ববাহু নৃত্য করতে পারেন অথবা বৈষম্যের এই কুৎসিত কথকতায় লজ্জায় আপনার মাথা ঝুঁকে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশ জয়ী যোগীকে এবার মোদীর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরবে সঙ্ঘ?

আজকাল আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, একটি সূচক নিয়ে খুব আলোচনা হয়। এটার নাম 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস'। এই সূচকে ভারতের একদা স্থান ছিল ১৪২ যা মোদি জমানায় ৬৩। মোদ্দা কথাটি হল কর্পোরেট পুঁজির স্বচ্ছন্দ চলনের ক্ষেত্রে ভারত আজ সামনের সারির দেশ। এই তথ্য কর্পোরেট হাঙরদের খুশি নিশ্চিত ভাবে করবে। কিন্তু নীতি আয়োগ কর্তৃক প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে ভারতের ২১ কোটি মানুষ (ইউএনডিপি-র ওই একই ডেটা নিয়ে কাজ করে রিপোর্ট বলা হয়েছে সংখ্যাটা ২৩ কোটি) দরিদ্র। এই অমৃতকালে এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার অধিকার আমার আছে, যেমন অধিকার আছে এ কথা জিজ্ঞেস করার যে দেশ বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার দৌঁড়ে আছে, কেন সে দেশে বেকারত্বের হার এই মুহূর্তে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি। ২০২২-২৩ সালে ৭.২% জিডিপি গ্রোথে আপনি আলোড়িত হবেন না কি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত সেই তথ্যটিতে আপনি বেশি আলোড়িত হবেন যে মুদ্রাস্ফীতির হার যাবতীয় রেকর্ডকে ভেঙেছে এবং ৭.৪৪% হয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে গত পাঁচ বছরে একটা ভেজ থালির মূল্য ৫০% বেড়েছে। এক কথায় বলা চলে জিডিপির উর্ধ্বগতি, সেনসেক্সের চড়াই-উতরাই, আকাশ ছোঁয়া আবাসন, ঝাঁ চকচকে সড়ক, শপিং মল কে উন্নয়নের মাপকাঠি মেনে নিয়ে অর্থনীতির একটা আলোচনা হওয়া সম্ভব। আরেকটা আলোচনা হওয়া সম্ভব মানব উন্নয়ন সূচক, কর্মসংস্থান, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। প্রথম আলোচনা সমর্থকরা পুঁজির স্বার্থে, কর্পোরেট স্বার্থে সরকারের কাছে আরো বেশি বেশি মাত্রায় কর ছাড় দাবি করে। দ্বিতীয় আলোচনার সমর্থকেরা দাবি করে ধনীদের উপর সম্পদ কর চাপানোর। তারা হিসাব করে দেখায় যদি ভারতের প্রথম তিনটি সবচেয়ে ধনী গোষ্টীর উপর ২% সম্পদ কর চাপানো হয় তাতে আগামী তিন বছর দেশের সমস্ত আদিবাসী মানুষকে উন্নত মানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবা নিখরচায় দেওয়া সম্ভব। কোন রকম যদি, কিন্তু, অথবা শব্দের অবকাশ না রেখে বলতে চাই প্রথম পর্বের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতাদর্শ গত অবস্থান হোক বা দ্বিতীয় পর্বে শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ অরুণকুমারের আলোচনা, অর্থনীতির পিপলস কেন্দ্রিক ভাবনার উপর ভিত্তি করে তৈরি।

(২)

ভারতে রাজনৈতিক অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে আরেকটা বড়ো সমস্যা হল তথ্য প্রকাশে মোদি সরকারের চূড়ান্ত অনীহা এবং এক অর্থে নিষেধাজ্ঞা। দি প্রিন্ট (২২ আগস্ট, ২০২৩) এ টি সি এ শারদ রাঘবন এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন যা আসলে তথ্যের আকাল ও সমস্ত সরকারি দাবির প্রতি যুক্তিসংগত সন্দেহ তৈরি করেছে। জনগণনার তথ্য, কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে, কর্মসংস্থান সার্ভে, শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন তথ্য ১২ বছরের পুরনো, ইনপুট - আউটপুট ডেটা ১৫ বছরের পুরনো। তাহলে কিসের ভিত্তিতে হিসাব হবে।এমনকি তথ্য নিরুপণের যে সমস্ত মাপকাঠি তৈরি করা হয়েছে তা-ও সন্দেহজনক। এ বিষয়ে আজকের অন্যতম আলোচক অরুণ কুমার এই বিষয়ে ধারাবাহিক ভাবে আমাদের অবহিত করছেন।

(৩)

মূল আলোচনার শুরুতে আমাদের ভাবনার সূত্রটা জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমরা আলোচনার প্রথম পর্বে কেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এলাম? সাদা চোখে দেখলে আরএসএস নিজেদের একটি জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে মনে করে,তারা নির্বাচনে অংশ নেয় না, এমনকী সংসদীয় প্রতিষ্ঠান বা সরকার চালাতে তাদের সরাসরি কোনও ভূমিকা নেই। তাই দেশে চালিত অর্থনীতির ভালো মন্দের দায় কেন নেবে তারা? এখানে আমাদের ভাবনা হল আরএসএস নিছক সাংস্কৃতিক সংগঠন নয় বরং আজকে ভারতের শাসক শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে রাজনীতির অনুশীলন করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তার মস্তিষ্ক। এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে শত বর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এই মুহূর্তে ভারতে সবচেয়ে প্রভাবশালী আর্থ- সামাজিক - রাজনৈতিক সংগঠন। একাধিক শাখা সংগঠনকে হাতিয়ার করে, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামাবলী গায়ে, হিন্দি - হিন্দু - হিন্দুস্তানের শ্লোগান দিয়ে তাদের পরিকল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রকে সফল করতে কাজ করে চলেছে সঙ্ঘ পরিবার। উপুর্যুপরি নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য এবং কর্পোরেট হিন্দুত্বের রসায়ন তাদের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।

A draft of a speech on socio economical politics

এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে যে তীব্র মেরুকরণ ও ধর্মীয় হিংসার প্রকোপ আমরা উপলব্ধি করছি তা ৪৭' পরবর্তী ভারত কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। সম্ভবত ভারতে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সি নেই যেখানে সঙ্ঘ তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ সঙ্ঘের দুই মুখপত্র অর্গানাইজার ও পাঞ্চজন্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান (সঙ্ঘের ভাষায় সরসঙ্ঘচালক) মোহন ভাগবতের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।এই আলোচনায় ভাগবত আর 'অরাজনৈতিক' মুখোশ পড়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তিনি বলেছেন, সূচনালগ্ন থেকে সঙ্ঘ কখনো নিত্যদিনের রাজনীতি (নির্বাচনের রাজনীতি, ভোটের রাজনীতি, একে অপরকে কাদা ছোঁড়ার রাজনীতি ইত্যাদি) নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু যখনই রাষ্ট্রনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও হিন্দু স্বার্থের প্রশ্ন এসেছে তখনই কিন্তু সঙ্ঘ মাথা গলিয়েছে। ভাগবতের ভাষায় যখনই রাজনীতি ভুল রাস্তায় গেছে (পড়ুন হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনার বিপরীতে গেছে), আমাদের সামাজিক চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখনই সঙ্ঘ চিন্তিত হয়েছে।তবে একই সঙ্গে ভাগবত এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে পূর্বেকার পরিস্থিতি থেকে এখনকার পরিস্থিতির গুণগত পার্থক্য হল এখন সঙ্ঘের হাতে 'রাজনৈতিক ক্ষমতা' এসে গেছে। তারা আজ কতটা ক্ষমতাশালী সেটা বোঝাতে বলা হয়েছে জনগন বা কোনও গোষ্ঠী যদি কোনও কিছুর আকাঙ্খা করেন বা তাঁদের কোনও রাজনৈতিক দাবি দাওয়া থাকে তবে তাঁরা সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। ভাগবতকে প্রশ্ন করা হয়েছিল অর্থনীতি নিয়ে। সেখানে ভাগবত আত্মনির্ভর ভারত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন, তাদের মতে আত্মনির্ভরতার অর্থ অর্থনীতির কেন্দ্রিকতা নয়, বিকেন্দ্রীকরণ। কয়েকজনের সমৃদ্ধি নয়, দেশের বেশির ভাগ মানুষের সমৃদ্ধি। পশ্চিমী ভোগবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে এক সহজ সরল জীবনাদর্শ। এক্ষেত্রে আমার বলার বিষয় হল শিক্ষার প্রশ্নে, ইতিহাসের প্রশ্নে, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে, আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে, বিদেশ-নীতির প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের যেমন কিছু ভাবনা চিন্তা আছে তেমনি অর্থনীতির প্রশ্নে তার কিছু ভাবনা আছে,সেই ভাবনার মধ্যে আপাত স্ববিরোধ ও দ্বিচারিতা আছে এবং অবশ্যই তার এক অভিমুখ আছে। একই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন নির্দিষ্ট কাজটি সম্পাদন করতে নির্দিষ্ট সংগঠন আছে যেমন হিন্দু স্বার্থ রক্ষার নামে মেরুকরণের রাজনীতিকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সামরিক ভাবনায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বজরং দল, শ্রমিকদের জন্য ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, ছাত্রদের জন্য অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, শিক্ষার জন্য সরস্বতী বিদ্যামন্দির, মেয়েদের জন্য দুর্গা বাহিনী তেমনি অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ।

(৪)

এখানে উপস্থিত মানুষদের অধিকাংশদের যদিও জানা তবুও আলোচনার ধারাবাহিকতার স্বার্থে আরেকবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্মকুণ্ডলী অতি সংক্ষেপে আমাদের দেখে নেওয়া দরকার। ১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীর দিন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার,বি এস মুঞ্জে, এল ভি পরাঞ্জপে, বাবারাও সাভারকার ও বি বি থলকার একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন থেকেই তাঁরা ঘোষিত ভাবে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সমস্ত ধরণের আন্দোলনগুলির বিরোধিতা শুরু করে। হেডগাওয়ারের জীবনীকার সি পি ভিশিকর কিভাবে হেডগাওয়ার আরএসএস প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হলেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন : "মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশে জাতীয়তাবাদের উদ্দীপনা ঠান্ডা হয়ে গেল এবং এই আন্দোলনের ফলে সমাজ জীবনে যে অশুভ দিকগুলি জন্ম নিয়েছিল তা ভয়ানকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সঙ্ঘাত শুরু হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ -অব্রাহ্মণ সঙ্ঘাত নগ্ন হয়ে উঠল। কোন সংগঠনই পূর্ণাঙ্গ ও ঐক্যবদ্ধ থাকল না। অসহযোগের দুগ্ধে সঞ্জীবিত হয়ে যবন সর্প বিষাক্ত হিস হিস শব্দে দেশে দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে লাগল।" একথা থেকে এটা পরিষ্কার যে হেডগেওয়ার শুধু যবন সর্পের জবাব দিতে চাননি, তিনি নিচুতলার শূদ্র-অতিশূদ্র জাগরণে ভীত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরিত্রাণ করার তীব্র চাহিদা অনুভব করেছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদকে রক্ষা করার তাগিদে তিনি 'যবন-সর্প' ও ব্রাহ্মণ - অব্রাহ্মণ সঙ্ঘাতকে একাসনে বসিয়েছেন।

A draft of a speech on socio economical politics

এই প্রেক্ষাপটকে উল্লেখ করার কারণ হল আরএসএস অহরহ যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ডঙ্কা বাজায়, তারা মুক্তিযুদ্ধে শুধু ভূমিকা নেয়নি তাই নয়, বরং গণআন্দোলনগুলিকে কালিমালিপ্ত করা তথা বিপথগামী করার কাজে নিয়োজিত থেকেছে। বস্তুত পক্ষে হেড গাওয়ার ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক ছিলেন হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার ব্যাপারে। পরবর্তী কালে গোলওয়ারকর ৪২' এর উত্তাল আন্দোলনকে তীব্র ভাবে সমালোচনা করেছেন। বস্তুত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অধীনতা থেকে জাতীয় মুক্তি অর্জনের বদলে তাঁর মনপ্রাণ একাগ্র ছিল কীভাবে বিদেশী ও বিজাতীয় মুসলমানদের দেশ থেকে বিতাড়নের মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা। এইজন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সমস্ত ধরণের সহযোগিতা করতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। এই বিষয়টা না বুঝলে, সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাদের ঐতিহাসিক ভাবে আনুগত্য না বুঝলে আজকের কর্পোরেট লুণ্ঠনে সঙ্ঘ পরিবারের সহযোগী ভূমিকাকে উপলব্ধি করা যাবে না।

(৫)

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অর্থনৈতিক মতাদর্শের ধারণাটি স্পষ্ট হয়েছে আশি সালের অনেক পরে। সেক্ষেত্রেও মনে রাখা দরকার এই মতাদর্শের বাস্তবতা নির্ধারণ করতে হবে ক্ষমতার অলিন্দে তার প্রবেশের পর। গান্ধী হত্যায় সঙ্ঘের কর্মকর্তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ভারতীয় রাজনীতিতে ব্রাত্য ছিল আরএসএস। রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছাকাছি তারা প্রথম আসে যখন মোরারজি দেশাই এর নেতৃত্বে জরুরি অবস্থার পর জনতা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের চিন্তার তেমন কোনও প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তাদের বক্তব্যে স্বদেশী অর্থনীতির প্রতি দায়বদ্ধতার কথা শোনা যায়। ছবিটা পাল্টায় রাম জন্মভূমি মন্দির আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একদিকে বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতালাভ এবং পরবর্তী সময়ে দু- পর্বের বাজপেয়ী সরকারের সময়ে তাদের আর্থিক মতিগতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ধারা হিসাবে যে কথাগুলো আজ আমি এখানে উপস্থিত করছি তার রসদ সংগৃহীত হয়েছে মূলত সঙ্ঘের বিভিন্ন মুখপত্র থেকে।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পক্ষ থেকে প্রচারিত লেখাপত্র অনুযায়ী তাদের একটা তাত্ত্বিক অবস্থান আমরা তৈরি করার চেষ্টা করব।প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে দুটো বই এর কথা। প্রথমটির নাম 'third way', লেখক দত্তাপত্তি থেঙ্গাডি। দ্বিতীয় বইটির নাম Hindu economics, লেখক এম জি বোকরে। সঙ্ঘের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থেঙ্গাডি,ইনি ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ ( বিএমএস), ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ ও স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা।বোগরে ছিলেন নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, প্রথম জীবনে এক বামপন্থী অর্থনীতিবিদ এবং কমুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সদস্য। পরবর্তীতে তার বয়ান অনুযায়ী তিনি কমুনিজমের প্রতি বিশ্বাস হারান ও থেঙ্গাডির অনুপ্রেরণায় ভারতীয় ধর্মীয় ও ন্যায় শাস্ত্রের মধ্যে নিহিত অর্থনৈতিক নীতিগুলো নিয়ে গবেষণা করেন এবং এক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির সন্ধান পান যার পরিণতি এই হিন্দু ইকোনমিক্স গ্রন্থটি।

এই দুটি বইতে যে অর্থনৈতিক ভাবনা বিবৃত হয়েছে, তার কিছু নির্যাস পয়েন্ট আকারে এখানে উপস্থিত করছি : "Communism has collapsed and capitalism is on the decline but its demise is being delayed.The search for a third alternative has begun." পশ্চিমী অর্থনীতি ভারতের কাজে লাগবে না কারণ আমাদের দেশ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নে পৃথিবীর বাকি দেশগুলি থেকে পৃথক।আমাদের ভরসা করতে হবে হিন্দু ইকোনমিক্সের উপর যা প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য ও দর্শন থেকে উদ্ভূত। তৃতীয় পন্থার উপাদান হিসাবে থাকবে এক পৃষ্ঠপোষক ( পেট্রোন) রাষ্ট্র, মাইক্রো,স্মল ও মিডিয়াম মানে MSME সেক্টরে উৎসাহ দান, প্রথাগত অসংগঠিত ক্ষেত্রকে রক্ষা কারণ এখানে দেশের ৯৩ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত। প্রগতিশীল শ্রম সংস্কার,পরিবেশ সচেতন ও প্রযুক্তিগত ভাবে দায়িত্বশীল বৃদ্ধি তথা উন্নয়নকে সমর্থন ইত্যাদি।

বস্তুবাদী পশ্চিমী দর্শনে মনে করা হয় বস্তু হচ্ছে ভিত্তি এবং মন হল উপরিকাঠামো। এই মতে সামাজিক-আর্থিক কাঠামো প্রধান ও তার পরিবর্তন হলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মানুষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটবে। হিন্দু ইকোনমিক্সে বিষয়টা ঠিক উল্টো। এখানে ধর্ম থাকবে কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। ধর্ম বলতে অবশ্য এখানে রিলিজিয়নকে বোঝানো হচ্ছে না,এখানে ধর্ম বলতে এক চিরন্তন নীতি মালা যা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে স্বনির্ভর ও পরস্পরের সহযোগী করে তুলবে।এর ফলে এক নতুন ধরণের মানসিক সংযুক্তি ঘটবে এবং এক নতুন বিশ্ব তৈরি হবে অর্থাৎ বসুদেব কুটুমবভম। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা দাবি করেন যে রাষ্ট্র যাতে কোনমতেই অর্থনৈতিক কার্যকলাপে মাথা না ঘামায় অথচ একশ বছরের পরেও দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদ যখনই সংকটে পড়ছে তখনই সে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দাবি করছে। এই নতুন জমানায় সব মানুষ স্বনিযুক্ত হবে। "All will have to seek their living by earning incomes in the process of self employment. Hindu economics has a theory of inevitability of self employment after the disappearance of capitalism."

এই ব্যবস্থায় সমস্ত মানুষই হবে প্রোপাইটার বা মালিক ও উপার্জনশীল। সমাজে ফলত কোন প্রলেতারিয়েত থাকবে না। যদি প্রলেতারিয়েত না থাকে তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোন চিহ্ন থাকবে না। এই তত্ত্ব সমস্ত বিশ্বের ক্ষেত্রে সত্য ও একদিন বিশ্ব এই হিন্দু ইকোনমিক্সকে গ্রহণ করবে।
এই তত্ত্ব আদৌ কোন তত্ত্ব কি না তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে কারণ শ্রেণি বিভক্ত সমাজ, উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা, উদ্বৃত্ত মূল্যের হিসাব, লগ্নি পুঁজির চলন, শোষণের কারণ নিয়ে কোন বিস্তারিত আলোচনা এখানে নেই। কিন্তু যা আছে তা হল এক আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির মনোগত আকাঙ্খা যা পরবর্তী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অর্থনৈতিক ভাষ্যের এক অনিবার্য উপাদান হিসাবে উচ্চারিত হবে।

(৬)

এই মডেলকেও কিন্তু বেশিদিন চালানো সম্ভব ছিল না। কারণ কর্পোরেট লুণ্ঠনের পথ প্রস্তুত করতে, গুজরাট মডেলের নামে একটা রাজ্যের জল-জমি-প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ কর্পোরেট হাঙরদের হাতে তুলে দিতে এই থার্ড ওয়ে কাজ করবে না। ইতিমধ্যে ১৯৯১ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেছে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ যার ঘোষিত লক্ষ্য বিশ্বায়নের নামে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের যে কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং শুরু করেছেন তার বিরোধিতা করা। মুখে বিরোধিতা ও কার্যক্ষেত্রে তার সমর্থন করার মধ্যে যে স্ববিরোধীতা আছে তাকে ন্যায্যতা দিতে,সমর্থকদের বিভ্রান্ত করতে এবং অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করতে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপিকে যেমন ক্রমাগত মুখোশ বদলাতে হয়েছে ঠিক তেমনি এই বদলকে এক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের। এই তত্ত্বায়নটি সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে।

নতুন অর্থনৈতিক ভাবনার দাবি নিয়ে একটা শব্দবন্ধ তৈরি করা হল যার নাম ' ইকনমিক ন্যাশানালিজম'। বিধিসম্মত সতর্কতা দেওয়া হল যে বামপন্থী ও লিবেরাল অর্থনীতিবিদরা এই ভাবনাকে ত্রুটিপূর্ণ ও বিপর্যয়কারী বলে মনে করেন। কিন্তু চিন আজ এই মডেলকে ব্যবহার করেই ১৯৭০ সাল থেকেই অগ্রগতি করছে ও মাও সে তুং এর আমলে ক্ষুধাতুর চিন আজ ১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই তার স্থান।আর নরেন্দ্র মোদির জমানায় এই অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের নাম আত্মনির্ভর ভারত। এতে বলা হল মনমোহন সিং এর আমলে অমর্ত্য সেন ও জোসেফ স্টিগলিজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, একশো দিনের রোজগার যোজন, financial inclusion, স্বাবলম্বন প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে যে জনকল্যাণ মুখী ভারতের কথা বলা হয়েছিল, কেইনস মডেলের অন্যান্য উদাহরণের মত এটাও ভেঙে পড়ল। বেকারি, মুদ্রাস্ফীতি, একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়ে উঠল মনমোহন সিং সরকারের অভিজ্ঞান। এই সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় বসল।

A draft of a speech on socio economical politics

নরেন্দ্র মোদি সরকার ইতিপূর্বে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন 'গুজরাট মডেল ' নামে এক অভূতপূর্ব আর্থিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এবং এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী।অমর্ত্য সেন ও স্টিগলিজের ভাবনাকে বাতিল করে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রফেসর বললেন নেহেরুর অতীত থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজারের শক্তির উপর ভরসা রাখতে হবে,বাণিজ্য ও শ্রম সংস্কার করতে হবে,জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পগুলিকে প্রয়োজন অনুযায়ী পুনর্গঠন করতে হবে।ভগবতীর লেখা বই 'why growth matters' আসলে সঙ্ঘের মতে গুজরাট মডেলের প্রতি সমর্থন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অভিভাবকত্বে নরেন্দ্র মোদি আজ দেশজুড়ে যে অর্থনৈতিক মডেল চালাচ্ছেন তা গুজরাট মডেলের নতুন সংস্করণ এবং অবশ্যই তাতে নতুন কিছু বিষয় আছে। নরেন্দ্র মোদির উপলব্ধি হল ভারতবর্ষ অসম বিকাশের দেশ হওয়ার কারণে হুবহু গুজরাট মডেল এখানে লাগু করা সম্ভব নয়। এই নতুন মডেল আসলে থেঙ্গাডির আত্মনির্ভর ভারত এবং জগদীশ ভগবতীর মুক্তবাজার অর্থনীতির অভূতপূর্ব সঙ্গম। আপাতভাবে থেঙ্গাডি ও ভগবতীর আর্থিক চিন্তা দুটি মেরুতে অবস্থিত হলেও আচ্ছে দিনের ভারতে সেই দুটোরই প্রতিফলন হচ্ছে। আত্মনির্ভর ভারত,মেক ইন ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া,মুদ্রা লোন,এমএসএমই সেক্টরকে উৎসাহ দান,বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, স্বচ্ছ ভারত অভিযান থেঙ্গাডির ভাবনার সার্থক রূপায়ণ। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণ, জিএসটি, নোটবন্দী, শ্রম আইন, এফ ডিআই এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রকে উন্মোচিত করে দেওয়া ভগবতীর মতাদর্শ। আজ ভারতবর্ষের আর্থিক সমৃদ্ধির যে উড়ান শুরু হয়েছে তা আসলে এই ব্যালেন্সিং অ্যাক্টেরই ফসল।

(৭)

আর এস এসের অর্থনীতি সংক্রান্ত তত্ত্বায়নের শেষ বিষয়টি আমরা রাখছি তা হল কোভিড উত্তর পর্বে ১০-১২ মার্চ(২০২২) গুজরাটের কর্ণাবতীতে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত ও সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসবলের উপস্থিতিতে আর্থিক প্রশ্নে বিশেষ প্রস্তাব নেওয়া। এতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা হল: "ভারত কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মডেলের খোঁজ বিশেষ করে কৃষি, রফতানি,শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের উন্নতি"। সারা দেশে কর্মসংস্থানের হাল দেখে চিন্তিত সঙ্ঘ সেই ধরণের মডেলের উপর জোর দিতে বলেছে যা গ্রাম ভারত কেন্দ্রিক হবে। কৃষি, এমএসএমই, হস্ত শিল্প,খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পারিবারিক শিল্পগুলিতে জোর দিতে হবে কারণ এগুলো শ্রম নিবিড়। স্টার্ট আপ ও নয়া জমানার প্রযুক্তিতে জোর দিতে হবে। আমদানি কমাতে হবে,রফতানি বাড়াতে হবে।লক্ষ্য হবে বিশ্ব বাণিজ্যের ৫ শতাংশ নিজের দখলে নিয়ে আসা। তৃণমূল স্তরে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে স্টেকহোল্ডার হিসাবে গণ্য করে তাদের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামিল করতে হবে।স্ব নির্ভর গোষ্ঠী, সমবায় সংস্থাগুলিকে, স্থানীয় ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি এবং দক্ষতা বৃদ্ধিকে।

(৮)

এবার আমরা কার্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিভিন্ন আর্থিক প্রশ্নে দ্বিচারিতার বিষয়গুলো জেনে নেব। তবে এক্ষেত্রে আমার মত হল এই দ্বিচারিতা বা স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের ছদ্ম লড়াইকে আমরা অবশ্যই স্পষ্ট করব কিন্তু জোর দেব যে আর্থিক প্রকল্প বা সিদ্ধান্ত গুলোকে সঙ্ঘ নিজেদের সাফল্য বলে দাবি করে তার চরিত্র বিচারে।

এক্ষেত্রে প্রথম উদাহরণ হিসাবে অবশ্যই আসবে আদানি গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা। আদানি সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট বা occrp রিপোর্ট যে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সামনে এনেছে তাকে ব্যাখ্যা করা আমার বক্তব্যের বিষয় নয়,আমি শুধু উল্লেখ করতে চাই যে জালিয়াতির প্রশ্নটিকে দূরে সরিয়ে রেখে যেভাবে সঙ্ঘ পরিবার গোটা বিষয়টাকে দেশের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন করে তুলতে চাইছে সে বিষয়ে। এক্ষেত্রে স্বঘোষিত স্বদেশী ধর্মযোদ্ধা, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের কো কনভেনর অশ্বিনী মহাজন বলেছেন যেহেতু আদানিরা দেশের হয়ে সম্পদ (বন্দর,বিমানবন্দর, সোলার প্যানেল,সেমি কনডাকটার ইত্যাদি) তৈরি করছেন, দেশের প্রধান শত্রু চিন আদানিদের রণকৌশলের কাছে পরাজিত হচ্ছে তাই আদানিরা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার।ভারতবাসী হিসাবে আমরা কখনই তা মেনে নেব না। অর্থাৎ আর্থিক জালিয়াতিকে তথাকথিত দেশপ্রেমের মোড়কে পুরে তার ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টার মাধ্যমে কর্পোরেট ভজনার নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।' the gain of adani is loss of china' - এই শ্লোগানের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা হচ্ছে। (এক্ষেত্রে এস গুরুমূর্তির উদাহরণ টা দেওয়া যেতে পারে)।

দ্বিতীয় উদাহরণটি অবশ্যই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ সংক্রান্ত। এই ক্ষেত্রে কিন্তু নব্বই এর দশকে চালু হওয়া উদারীকরণের সময় থেকে শাসক শ্রেণির বেশিরভাগ দলের মধ্যে একটা কনসেশসাস ছিল। পার্থক্য ছিল বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিলগ্নিকরণ হবে তা নিয়ে।আর এই বিলগ্নিকরণের প্রশ্নে সবচেয়ে আগ্রাসী ও ধারাবাহিক এনডিএ সরকার।অথচ স্বদেশীর ধ্বজাধারী সঙ্ঘের মুখ স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের পক্ষে এই পাইকারি হারে বিলগ্নিকরণ হজম করা সহজ হচ্ছিল না তাই তাকে এবং সঙ্ঘের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘকে এক ছদ্ম লড়াই / নাটক করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। একদম সাম্প্রতিক উদাহরণ হল ২০১৯ সালে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের হরিদ্বার অধিবেশনে বিপিসিএল,কনকর, শিপিং কর্পোরেশন বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্তকে দেশের স্বার্থ বিরোধী (দেশদ্রোহী?) আখ্যা দেওয়া হল। এমনকি পরে এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটাদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকেও সমালোচনা করা হয়।অথচ আমরা যদি বেশ কিছুদিন পিছিয়ে যাই তবে দেখব তবে দেখব ১৯৯৮-২০০৪ পর্বে অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রী সভায় প্রথমবার বিলগ্নীকরণ মন্ত্রক তৈরি হয় এবং বিলগ্নীকরণের বিষয়টিকে সমন্বিত করার দায়িত্বে ছিলেন বিলগ্নীকরণ মন্ত্রী অরুন শৌরি,অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা ও বিদেশ মন্ত্রী যশোবন্ত সিং- এরা সবাই আদতে হাফপ্যান্ট পরা আরএসএস ক্যাডার।সঙ্ঘ পরিবার আরো ন্যাজে গোবরে হয় জীবন ও সাধারণ বিমার বেসরকারি করণের সময়। শুধু মুখে প্রতিবাদ নয়, সঙ্ঘ কর্মকর্তারা ঘুরিয়ে এই ধরণের দেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মোদি-অমিত শাহদের দায়ি না করে মূল শত্রু চিহ্নিত করেন নীতি আয়োগ ও সরকারের বিভিন্ন স্তরের আমলাদের। অশ্বিনীর বক্তব্য ছিল গ্রাউন্ড রিয়েলিটির সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এই সরকারি বাবুরা মোদি সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। অসততার এও এক সঙ্ঘধর্মী উদাহরণ।

তৃতীয় উদাহরণটি অবশ্যই ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে। ৯০ দশক থেকে যত সমস্ত সরকার এদেশে এসেছে তারা তাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভরকেন্দ্রে রেখেছ বিদেশ থেকে আগত বিনিয়োগের উপর। ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় সরকার নয়,পাল্লা দিয়ে রাজ্য সরকার গুলিও। কে কত বেশি সুযোগ দিয়ে এবং জনগনের স্বার্থকে বলি দিয়ে বিদেশি পুঁজি নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। এই আবহাওয়ায় সঙ্ঘের আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি সবার কাছেই এক উপহাসের বিষয় হয়ে রয়েছে।এই অবস্থায় এক জাতীয়তাবাদী ঢেঁকুর তোলা ছাড়া স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের কাছে আর অন্য কোন উপায় অবশিষ্ট নেই। তাই ২০১৬ সালে মঞ্চের প্রস্তাবে লেখা হয়-- ' opening up sectors like retail,defence and pharma to fdi and relaxing norms is betrayal to the people of the country"। অবশ্য এখানে বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটি নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই কারণ সঙ্ঘের ইতিহাসই হল ভারতীয় জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।

একই ভাবে জিএসটি সহ বহু কিছুর কথা আলোচনা করা যায় কিন্তু আপাতত সেই আলোচনায় দাঁড়ি টানছি।কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়,তা হল দেশের কৃষি ক্ষেত্রকে কর্পোরেট মৃগয়া ক্ষেত্র বানাবার জন্য মোদি সরকার যে তিনটি কৃষি আইন তৈরি করে এবং ভারতের কৃষক সমাজ তার বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে, সেই পরিস্থিতিতে স্বঘোষিত জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ঠিকেদার আরএসএসের ভূমিকার কথা। এক্ষেত্রে কোনও ছদ্ম বিরোধিতার নাটক তারা করেনি বরং দু একটি সংশোধনী-সহ কৃষিআইনগুলির পূর্ণ রূপায়ণ তারা চেয়েছিল। মোদি সরকার যখন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে তখন তারা মোদি সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে আন্দোলনকারী দেশদ্রোহীদের হাতে আর কোনও অ্যাজেন্ডা থাকল না। তবে সরকারের সৎ ও দরদী উদ্দেশ্য কৃষকরা বুঝতে পারলেন না,এটা বেদনার। এমনকি আরএসএস পরিবারের সংগঠনগুলো এতেও থেমে থাকে নি। এমনকী আইন প্রত্যাহারের এক মাস পরে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের সম্পাদক বদ্রী নারায়ন চৌধুরী জানান, ফার্ম ল পুনরায় লাগু করার জন্য তারা দেশের প্রতিটি ব্লকে আন্দোলন শুরু করবেন।

(৯)

এবার আমরা আসব মোদি জমানার সবচেয়ে ভয়ংকর অর্থনৈতিক ধামাকা বিমুদ্রাকরণ নিয়ে যাকে বহুবার সঙ্ঘের কর্মকর্তারা নিজেদের সাফল্য বলে প্রচার করেছেন। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের পর বহু বছর কেটে গেছে। ৯৯.৯% নোট পরের বছরই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে। ডিজিটাল ইকোনমির গতি স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। কালো টাকা উদ্ধারের গল্পটাও অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছু প্রসব করেনি। কিন্তু আমাদের বিচারে বিমুদ্রাকরণ খুব ভেবে চিন্তে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত যার ফল হবে সূদুর প্রসারী। কর্পোরেট স্বার্থে দেশের অর্থনীতিকে চালনা করাই এর লক্ষ্য ছিল।একই সঙ্গে পুঁজিপতি ও কর্পোরেটরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার ফলে ব্যাঙ্কের নন পারফর্মিং অ্যাসেটের পরিমাণ উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছিল। অনেক অর্থনীতিবিদ এটা আশঙ্কা করছিলেন যে এভাবে চলতে থাকলে দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। নোটবন্দির কারণে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘরে ফিরেছিল তা আবার কম সুদে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের মুনাফার পথ প্রশস্ত করাই ছিল বিমুদ্রাকরণের লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যপূরণের নীল নকশা প্রস্তুত হয়েছিল আরএসএসের অভিভাবকত্বে। তাই সঙ্ঘের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ বৃন্দাবনে বিশেষ সভা করে বিমুদ্রাকরণের পক্ষে শিলমোহর দেন। 'ক্যারাভান' পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের তাত্ত্বিক নেতা এস গুরুমূর্তি এই নকশার অন্যতম কারিগর।

A draft of a speech on socio economical politics

অর্থনৈতিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমাদের শেষ আলোচনা বহু বিজ্ঞাপিত ' মেক ইন ইন্ডিয়া ' নিয়ে যা সঙ্ঘ পরিবারের সন্তান বলে দাবি করা হয়। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হিসাবে সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছিল -
(ক) ২০২২ সালের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের অবদান ২৫% করে ফেলা (পরে এটাকে পিছিয়ে ২০২৫ সাল করা হয়)।
(খ) ২০২২ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষেত্রে ১০ কোটি নতুন কর্মসংস্থান।
(গ) বিদেশি পুঁজির জন্য অর্থনীতির ক্ষেত্রকে আরো উন্মুক্ত করা।
(ঘ) ভারতীয় অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ পুঁজি তৈরি করা।
(ঙ) এভাবে ভারতকে উৎপাদন ক্ষেত্রের গ্লোবাল হাব করে তোলা।
(চ) আমদানি কমিয়ে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি।

কিন্তু আজ ৭-৮ বছর পরে দেখা যাচ্ছে এই মেক ইন ইন্ডিয়া প্রজেক্ট মুখ থুবড়ে পড়েছে। ৩০% তো বহু দূরের কথা, গত ৭ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের গড় অবদান ১৪% ছাড়ায় নি। কর্ম সংস্থান বাড়ার বদলে কমছে। এই বিপর্যয়ের কারণ লুকিয়ে আছে সঙ্ঘের ইকনমিক মডেলের চরিত্রে।
প্রথম কথা হল এই প্রকল্পটার উদ্দেশ্য কখনই ছিল না ভারতকে এক ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসাবে তৈরি করার। এটা প্রথম দিন থেকে ছিল ' assemble in india' প্রকল্প। অনেকটা অ্যাপেলের সেই শ্লোগানের মত, 'designed in California, assembled in china'। তাই দেশীয় উৎপাদকদের কোন বিশাল লাভ হওয়ার সম্ভাবনা থাকল না। এমনকি ২০২০ সালে ইন্ডিয়ান ইকনমিক সার্ভে এই বিষয়ে একটা রিপোর্ট পেশ করে যার শিরোনাম ছিল অ্যাসেম্বল ইন ইন্ডিয়া। একথা কেউ বলছে না যে ২০১৬ সালে ইন্ডিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার trade facilitated agreement সই করে। এই চুক্তির প্রধান কথা হল বিদেশে তৈরি ফিনিশড গুডস ও প্রোডাক্টসের জন্য ভারতের বাজারকে খুলে দেওয়া। এতে দেশীয় উৎপাদকরা আরো বেশি বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সন্মুখীন হবে। আজ এই মেক ইন ইন্ডিয়ার চিল চিৎকারে এমএসএমই সেক্টরের সংকটকে লুকানো যাচ্ছে না। আমরা যদি শেষ তিন বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে এদের অবদান গড়ে ৩৬.৫% মাত্র। আর যদি রফতানির ক্ষেত্রে দেখি তবে ২০২০-২১ -- ৪৯.৪%,২১-২২ এ ৪৫%,২২-২৩ এ ৪৩.৬%।তাহলে মেক ইন ইন্ডিয়া সফল হবে কি করে? অনেকে স্টার্ট আপের কথা বলছেন। কিন্তু আভ্যন্তরীন ভাবে পুঁজি তৈরি না হয় তাহলে সেটাও বিদেশিদের দ্বারা অধিগৃহীত হয়ে যাবে।

আমরা যদি গিগ শ্রমিকেরা যে যে ক্ষেত্রে যুক্ত, তার ছবিটা দেখি তবে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। বহু আলোচিত ব্লিংকিট দেশীয় প্রতিষ্ঠান বলে গর্ব করা হয়।কিন্তু তথ্য বলছে এই স্টার্ট আপে ৬৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লগ্নী করেছে সফট ব্যাঙ্ক,টাইগার গ্লোবাল,সিয়োলা ক্যাপিটেল এর মত বিদেশি সংস্থা। ক্রমান্বয়ে ক্ষতিতে চলা সংস্থা জোমাটোকে পুঁজি জোগাচ্ছে ক্যামাস ইনভেস্টমেন্ট,ফ্রাঙ্কলিন টেমপ্লেটন এর মত বিদেশি অর্থ লগ্নী প্রতিষ্ঠান। ফ্লিপকার্টকে তো কিনেই নিয়েছে আমেরিকান রিটেল দানব ওয়ালমার্ট। ছবিটা পাল্টাতো যদি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পুঁজি তৈরি হত। জিডিপির শতাংশের হিসাবে দেশে কতখানি অভ্যন্তরীণ পুঁজি তৈরি হচ্ছে তা বিনিয়োগের এক উল্লেখযোগ্য মাপকাঠি। ২০১১ সালের জুনে এই পুঁজি তৈরি হওয়ার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫.৪%। ২০১৭ সালে মার্চ মাসে অনুপাতটি কমে ২৮.৫% হয়ে গেছে।২০২১ সালের পর এটা ২০% পেরোতে পারছে না। শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ কতখানি বাড়ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঋণের টাকা ব্যবহার করা হয় নতুন কারখানা তৈরির কাজে অথবা পুরনো কারখানার সম্প্রসারণে। বড়,মাঝারি,ক্ষুদ্র- সব ধরণের শিল্পকে দেওয়া ঋণের হার স্মরণাতীত কালের মধ্যে সবচেয়ে কম হয়ে ২.৭% হয়েছে।এই পরিপ্রেক্ষিতে মেক ইন ইন্ডিয়া এক শূন্য গর্ভ আস্ফালনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

A draft of a speech on socio economical politics

এই ধরণের প্রকল্পের সাফল্যের জন্য মোদি সরকার নির্ভর করে আছে এফ ডি আই এর উপর, আর সঙ্ঘ বলছে এটা আত্মনির্ভরতার প্রতীক। সঙ্ঘের এই দ্বিচারিতাটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। একে তো শেষ ৫ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। তাছাড়া যেটুকু পুঁজি আসছে তার সিংহভাগ এসেছে নানান সংস্থার ইকুইটি শেয়ারে,নতুন প্রকল্পে নয়। ২০২২-২৩ সালে এফডিআই ইনফ্লো ২৭% কমে গিয়ে ২৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ক্রস বর্ডার মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন হচ্ছে না।কোভিড পরবর্তী সময়ে জিও তে গুগল ও হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া বড় বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। তাই বিদেশি পুঁজি তাগদে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপ্লব এক দিবাস্বপ্ন মাত্র।

মার্কস সাহেবের একটা বহু উদ্ধৃত কথা আছে। দার্শনিকরা নানা ভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা। আজ এই যে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করলো, এই যে আলোচনা সভার আয়োজন—সব কিছুর লক্ষ্য তো একটাই—দেশি-বিদেশি কর্পোরেটতন্ত্রর বিরুদ্ধে লড়াই এবং এদেশে এই মুহূর্তে তার প্রধান দালাল বা রাজনৈতিক প্রতিনিধি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করা। আমরা জানি, রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। আর শাসকের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে জনগণকে নিজের রাজনীতিকেই সামনে রাখতে হয়। নইলে সকল লড়াই নানা অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার অলিগলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে একদিন হতোদ্যম হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: ইন্ডিয়া নয়, ভারতেই জোর মোদির! জি-২০ তে স্পষ্ট হচ্ছে যেসব ইশারা


এতক্ষণের আলোচনায় আমরা দেখলাম, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যবাদ, মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতি ও বৃহৎ জমিদার শ্রেণির স্বার্থে কাজ করছে। এরা মুখে স্বদেশিয়ানার কথা বললেও শ্রেণি স্বার্থে জাতীয় পুঁজির বিকাশে কোনো পদক্ষেপ করতে পারছে না, সেই সংকট মেটাতে দেশের যাবতীয় সম্পদ দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরা দেশের জনগণের মধ্যে এই বিভ্রম তৈরি করছে যে তারা ভারতকে ‘উন্নত’ দেশে পরিণত করবে, কিন্তু বাস্তবে নিজেদের হিন্দুত্বের কর্মসূচি অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করছে ও ২০২৪-এর সংসদীয় নির্বাচন জেতার জন্য কোনও কৌশল নিতে বাকি রাখছে না। বস্তুত তাদের লক্ষ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই ফ্যাসিবাদের বিপদের তীব্রতাকে বোঝা, ব্যাপক বিস্তৃত যুক্তফ্রন্ট, বিস্তৃত জঙ্গি গণআন্দোলন ও বিস্তৃত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলাটা আশু প্রয়োজন। এর জন্য মেহনতি মানুষের অধিকারের সংগ্রামকে তীব্র করার পাশাপাশি মতাদর্শগত, তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির ভিত্তিতে চুরমার করে দিতেই হবে। দৈনন্দিন জীবন, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি রাস্তা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, কারখানা এবং জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

২০২২ সালের মধ্যে নতুন ভারত বা হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের যে প্রকল্প বিজেপি নিয়েছিল, ব্যাপক জনগণের প্রতিরোধের ফলে তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা ২০৪৭ সালের কথা বলছে। ফ্যাসিস্টদের এই পিছু হঠা কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়নি। তাই ফ্যাসিবাদবিরোধী ব্যাপক বিস্তৃত যুক্তফ্রন্টকে সংসদবাদের মধ্যে পড়লে চলবে না। একে একটি দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একে শুধুমাত্র সংসদীয় নির্বাচনের সময়কালে বেঁধে রাখলে চলবে না। সকল প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শক্তি, নিপীড়িত শ্রেণি, নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠী ও নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলিকে অটল, দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগঠিত প্রতিরোধ আন্দোলন চালাতে হবে। এটাই দেশের জনগণের প্রাথমিক, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রধান ও আশু কর্তব্য।

More Articles