ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন রামদেব! বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করল সুপ্রিম কোর্ট
Supreme Court on Baba Ramdev's Patanjali: এই বিজ্ঞাপনগুলো বিভ্রান্তিকর জানার পরেও কেন কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ করেনি , সে নিয়েও তীব্র ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টে বড় ধাক্কা যোগগুরু রামদেবের। একই সঙ্গে ধাক্কা খেল কেন্দ্র সরকারও। রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির বিজ্ঞাপন ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিকর, জানিয়ে দিল দেশের শীর্ষ আদালত। সব জেনে-বুঝেও চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে কেন্দ্র সরকার। বিজেপি সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের।
এই প্রথম নয়, গত নভেম্বরেই সুপ্রিম রায়ে জরিমানার মুখে পড়েছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর একটি আবেদনের শুনানি পর্বে মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচার পিছু ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হতে পারে বলে মৌখিক ভাবে জানিয়েছিল বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমানুল্লাহ এবং বিচারপতি প্রশান্তকুমার মিশ্রের বেঞ্চ। কোভিড প্রতিরোধী না-হওয়া সত্ত্বেও শুধু 'করোনিল' কিট বিক্রি করেই আড়াইশো কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার অভিযোগ উঠেছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির বিরুদ্ধে।
২০২০ সালের ২৩ জুন প্রথম বার করোনিল কিট বাজারে এনেছিল পতঞ্জলি। করোনিল এবং শ্বাসারি বটি নামে দু’ধরনের ট্যাবলেট এবং অণু তৈল নামের ২০ মিলিলিটারের একটি তেলের শিশি নিয়ে তৈরি ওই কিটের দাম রাখা হয়েছিল ৫৪৫ টাকা। চাইলে আলাদা ভাবে ট্যাবলেট এবং তেল কেনা যাবে বলেও জানানো হয়েছিল। তার পর ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৩ লক্ষ ৫৪ হাজার করোনিল কিট বিক্রি হয়েছে বলে সংস্থার তরফে জানানো হয়। পতঞ্জলির বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচারের অভিযোগ এনেছিল আইএমএ।
আরও পড়ুন: রামদেবের দন্তকান্তি টুথপেস্ট চিন্তায় ফেলে দেয় বিজ্ঞানীদেরও! কেন একথা বলছে কোলগেট?
সেই কোভিড-বিপত্তির পরে ফের সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেলেন রামদেব। বিজেপির সঙ্গে যোগগুরু রামদেবের ঘনিষ্ঠতা কারওরই অজানিত নয়। সেই সুযোগ নিয়েই বহু কেন্দ্রীয় সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকত পতঞ্জলি। আর সেই সব বিজ্ঞাপন নিয়েই ক্ষোভপ্রকাশ করেছে এবার দেশের শীর্ষ আদালত। শুধু তাই নয়, পতঞ্জলির ওষুধ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করল সুপ্রিম কোর্ট। সেইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে অ্যালোপাথি ওষুধের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করায় পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডে এবং সংস্থার অধিকর্তা আচার্য বালাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশও জারি করা হয়েছে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমানুল্লা বলেন, 'আপনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সবকিছু করে দিতে পারেন - এইসব বিজ্ঞাপন দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। বিষয়টা হল যে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে আপনি আপনার দ্রব্য বিক্রি করছেন। এটা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর এবং আইন বিরোধী।'
যে মামলার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার এই মন্তব্য করেছে বিচারপতি কোহলি ও বিচারপতি আমানুল্লা, সেই মামলাটি দায়ের করেছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। সেই প্রতিষ্ঠানের তরফে অভিযোগ জানানো হয়েছিল, অ্যালোপাথি ওষুধের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করেছে পতঞ্জলি। শুধু তাই নয়, রোগ সারিয়ে দেওয়া নিয়ে আইন লঙ্ঘন করে ভিত্তিহীন দাবি করা হচ্ছেও বলে অভিযোগ করা হয়। সেই সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ এবং নথি জমা দেয় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন।
এদিন শুনানিতে বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমানুল্লা জানতে চান যে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডে কোনও পদে রামদেব আছেন কিনা। সেই প্রশ্নের জবাবে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডের আইনজীবী বিপিন সংঘি বলেন, ‘কোম্পানির কোনও পদে নেই উনি। উনি শুধু যোগগুরু।’ আর এ বিষয়টি নিয়েই প্রবল বিতর্কের মুখে পড়েছে রামদেব ও তাঁর সংস্থা পতঞ্জলি। এতদিন পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডের হয়ে মুখ খুলতেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরও মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার নোটিশ জারির সময় আসতেই ‘যোগগুরু’ হয়ে গেলেন বাবা রামদেব। প্রশ্ন অনেকেরই।
গত বছরের নভেম্বরে পতঞ্জলির বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেই এই রামদেবই কিন্তু দিনই বলেছিলেন, ‘আমরা কোনও ভুয়ো প্রচার করছি না। বরং কয়েকজন চিকিৎসক মিলে একটি গোষ্ঠী শুরু চালু করেছেন, যাঁরা যোগ, আয়ুর্বেদ, প্রাকৃতিক চিকিৎসা, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ভুয়ো প্রচার করেন।' সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘যদি আমরা মিথ্যাবাদী হই, তাহলে আমাদের উপর ১,০০০ কোটি টাকার জরিমানা চাপানো হোক। আমরা মৃত্যুদণ্ডেও রাজি আছি। কিন্তু আমরা যদি মিথ্যা না বলি, তাহলে সেইসব লোকেদের শাস্তি দিতে হবে, যাঁরা ভুয়ো প্রচার করছেন। আমি এটা বলছি, কারণ গত পাঁচ বছর ধরে স্বামী রামদেব ও পতঞ্জলিকে টার্গেট করে ভুয়ো প্রচার চালানো হচ্ছে।’ এমনকী সরাসরি অ্যালোপাথির বিরুদ্ধেই তোপ দেগে বসেছিলেন রামদেব। সে নিয়ে আবার কড়া বার্তাও দিয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন। তারপর নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন রামদেব। পরবর্তীতে অবশ্য পতঞ্জলির হয়ে প্রচারও করেছেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই পতঞ্জলির বিরুদ্ধে বেশ কিছু নথি জমা দিয়েছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। তার মধ্য়ে রয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কাগজে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন এবং ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর বাবা রামদেব ও পতঞ্জলির অধিকর্তা যে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, সেই নথিও। যে সাংবাদিক বৈঠক হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ঠিক পরদিনই। সেদিন আইনজীবীর মাধ্যমে পতঞ্জলির তরফে জানানো হয়েছিল যে অ্যালোপাথি বা অন্য কোনও ওষুধের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করা হবে না। শুধু তাই নয়, ১৫ জানুয়ারি অজ্ঞাত সূত্র থেকে একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। তাতে দুটি ভিডিয়ো ছিল। ৭ জানুয়ারির সেই ভিডিয়ো ক্লিপে পতঞ্জলি দাবি করেছিল যে ‘রাসায়নিক-ভিত্তিক সিন্থেথিক অ্যালোপাথির থেকে তাদের দ্রব্য বেশি কার্যকরী’।
আরও পড়ুন:কেবল রামদেবই নন, মেয়েদের নিয়ে বারবার অশালীন মন্তব্য করেছেন এই ধর্মগুরুরা
সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে পতঞ্জলিকে মঙ্গলবার তুমুল ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে ১৯৫৪ সালের ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকশনাল অ্যাডভারটাইজমেন্ট)-এ উল্লেখ থাকা অসুস্থতা বা রোগের জন্য যে দ্রব্য তৈরি করা হয় বা বাজারে বিক্রি করা হয়, সেগুলির বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিতে হবে। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের উপর সরসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেইসঙ্গে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডের আচার্য বালাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি করেছে শীর্ষ আদালত। তবে রামদেবের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা হয়নি। কারণ পতঞ্জলির তরফে সওয়াল করা হয় যে সংস্থার কোনও পদে নেই রামদেব। রামদেব নিজে গা বাঁচালেও রামদেব-ঘনিষ্ঠতার জন্য কিন্তু সুপ্রিম-তোপের মুখে পড়েছে কেন্দ্রের বিজেপির সরকার। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষন, কেন্দ্রীয় সরকারের পতঞ্জলির প্রতি এই সমর্থন কার্যত গোটা দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই বিজ্ঞাপনগুলো বিভ্রান্তিকর জানার পরেও কেন কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ করেনি , সে নিয়েও তীব্র ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এ ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপের বিষয়ে জানিয়ে কেন্দ্র সরকারকে একটি হলফনামা জমা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।