জনপ্রিয় লেখক নয়, লোকপ্রিয় সাহিত্য খুঁজবে মান্দাস
Kolkata International Book Fair 2024: প্রকাশকের কাজই হচ্ছে পাঠকের মনকে বোঝার চেষ্টা করা। আর সে কাজটা মোটেও সহজ নয়। আমরা যাঁরা টাকা নিয়ে বই করি না অর্থাৎ নিজেরাই কনটেন্ট বাছি, তাদের পক্ষে এই কাজটা আরওই কঠিন।
এই কলকাতার ভিতর যে রয়েছে আরেকটা কলকাতা, তার বেশ মালুম পাওয়া যায় বইমেলা এলেই। আর সে কলকাতা বইপ্রেমীর। বইমেলা মানে ধুলো, বইমেলা মানে ভিড়, এ সবের বাইরে গিয়েও এই বইমেলা যেন বাঙালির আত্মার আত্মীয়টি। বই ঘিরে এ হেন পার্বণ, এমন উন্মাদনা পৃথিবীর আর কোথাও মেলে কিনা সন্দেহ। কলকাতা মানে যদি হলুদ ট্যাক্সি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চুড়ো কিংবা শ্যামবাজারের ঘোড়সওয়ার নেতাজি হয়, তাহলে সেই শহরের সেসব দৃশ্যকল্পমালার মধ্যে বইমেলা থাকাটাও বাঞ্ছনীয়। ছোটোবড় স্টল, বইমেলার কাগুজে মানচিত্র, সেই মানচিত্রে চোখ রেখে পছন্দের বই আর প্রকাশনার খোঁজ, লেখক-পাঠক সমাবেশ আর বই! রাশি রাশি বই ভরে ওঠা হাতে, ব্যাগে, মনে। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার এই বইপার্বণে সামিল অজস্র ছোটোবড় পাবলিশার্স। তাতে আনন্দ, দে'জ, পত্রভারতী, দেবসাহিত্যের মতো পুরনো ও বিশালাকার প্রকাশনাগুলি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে নতুন প্রকাশকেরাও। খুব বেশিদিন প্রকাশনার জগতে আত্মপ্রকাশ করেনি মান্দাস। কিন্তু এরমধ্যেই পাঠকমহলের কাছে বেশ আদৃত তারা। পাশাপাশি প্রকাশনার দুনিয়াতেও মৌলিক ছাপ রাখতে পেরেছে তাঁরা। বইমেলার ব্যস্ত হাওয়া ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে গিয়েছে মান্দাসকেও। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই মান্দাস প্রকাশনার কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের। তারই মধ্যে একটু ফুরসত বের করে কথা বললেন ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে। কথোপকথনে সোহিনী দাস।
বইমেলা তো আর বেশি দেরি নেই! প্রস্তুতি কতদূর? কতটা ব্যস্ততা এখন?
সত্যি কথা বলতে বইমেলা সামনে এলে যে কোনও প্রকাশকেরই নাভিশ্বাস উঠতে থাকে। এখন একেবারেই সেই পরিস্থিতি। মান্দাসের সমস্ত সদস্যেরই এখন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। ছাপাখানা, বাঁধাইখানা এসবে ছোটাছুটি তো লেগেই রয়েছে। যতগুলি টাইটেল এবার বইমেলার জন্য বাছা হয়েছে, সেসব এখন ছাপতে গেছে। সেসব কবে প্রকাশের মুখ দেখবে, সেসব নিয়ে একটা চাপা উত্তেজনা, ভয় সবই রয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের কিছু বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানও চলছে। এই তো সদ্য একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয়ে গেল প্রতিক্ষণে। সামনেই আরও দু'টি বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান রয়েছে প্রেস ক্লাবে। সব মিলিয়ে তুঙ্গে প্রস্তুতি।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
এবারের বইমেলায় মোট কতগুলি নতুন বই উপহার দিচ্ছে মান্দাস?
এবছর মান্দাস থেকে প্রায় ৩০টি নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে আমাদের ব্যপারটা ঠিক বইমেলার বই নয়। সারাবছর ধরে বই হয় আমাদের। বইমেলার পর থেকে শুরু হয় সেই গুনতি আগের বইমেলায় যে যে কাজ আমরা দেখাতে পেরেছি, তার পর থেকে যে যে বই হয়েছে, সেগুলিই আমাদের বইমেলার বই। আমাদের বইয়ের একটা বড় জোরের জায়গা কিন্তু ননফিকশন। ফিকশন যে একেবারেই নেই, তা নয়। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই ননফিকশনের প্রতি একটু বেশিই ঝুঁকে মান্দাস। আমাদের যেমন জুড়ে রয়েছে কালিনারি অর্থাৎ রসনা সাহিত্যের উপর আমাদের একটা জোর রয়েছে। সেখানে যেমন রয়েছে রেসিপির বই, তেমনই রয়েছে রন্ধনের সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতি, স্মৃতিকথার মতো বইগুলি। ইতিমধ্যেই আমাদের এখান থেকে প্রকাশিত 'সাধুর হেঁশেল' বইটি বেস্টসেলার হয়েছে। বইটির লেখক সোমব্রত সরকার। আহার্য ও সাধনা নিয়ে এই বই। বাউল-ফকিররা বিভিন্ন আখরায় আখরায় কী খান, কীভাবে হয় তাঁদের রান্না, তাঁদের সেই খাবারদাবারের সঙ্গে সাধনার সম্পর্কটা ঠিক কেমন, সেই নিয়ে লিখেছেন সোমব্রত। ইতিমধ্যেই পাঠকমহলে বেশ আদৃত হয়েছে বইটি।
ননফিকশনের মধ্যে আরও একটি বিভাগ আমাদের অনুবাদ সাহিত্য। আর সেই ধারায় এবারের বইমেলায় বিশেষ আকর্ষণ 'আমারও কিছু বলার ছিল' নামে একটি বই। সিদ্দালিঙ্গাইয়া নামে এক দলিত কন্নড় কবির আত্মকথার অনুবাদ। দলিত অন্ত্যজ জীবনে কবির সংগ্রাম, বেড়ে ওঠা, সেই সমস্ত বিষয়আশয়ই ধরা দেবে এই বইয়ের মধ্যে। বইটি সম্পাদনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান মৃন্ময় প্রামাণিক। ওঁর ছাত্রছাত্রীরাই অনুবাদের কাজটা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন মৃন্ময় নিজে। মান্দাস থেকে এ বছরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বই অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়ের 'ভালোবাসার কারক প্রকরণ'। ঘটনাচক্রে লেখাগুলি ইনস্ক্রিপ্টেই ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল। সেটি নিয়েই এ বছর বই করেছে মান্দাস। 'দেশ আমার জমি আমার' নামে আরও একটি বই এবার আমাদের বিশেষ আকর্ষণ। গদর একজন বিপ্লবী গায়ক। মাইক্রোফোন ছাড়াই গান গেয়ে এক লাখ দর্শক জড়ো করতে পারতেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। বইটির ভুমিকা লিখেছেন গৌতম ঘোষ।
আরও একটি মজার বই বেরিয়েছে এবার। সেটি লিখছেন সাংবাদিক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। এই বইটির নাম 'বিশিষ্টজনেদের বিবাহে বিভ্রাট বিবাহে বিপ্লব'। সেই তালিকাটাও কিন্তু আকর্ষনীয়। সেখানে যেমন আসছে বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিয়ের গল্প, তেমনই আসছে কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতির বিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে ভাঙন লাগার গল্প। সেভাবেই আরও একটি পর্বে আসছে জিন্নার বিয়ের গল্প, কোথাও বা এসেছে ঠাকুরবাড়ির পরম্পরা ভেঙে রথীন-প্রতিমার বিয়ের কাহিনি। সব মিলিয়ে এই বই যে পাঠকের ভালো লাগবেই, তা আঁচ করাই যায়। তাছাড়া এবারের বইমেলায় আসছে 'পল ক্লি-র ডায়েরি'-র দ্বিতীয় খণ্ড। প্রথম খণ্ডটি আগেই বেরিয়েছে মান্দাস। মোট চারটি খণ্ডে বইটি বের করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর ২০২৪ বইমেলাতেই পাঠকরা পেয়ে যাচ্ছেন দ্বিতীয় খণ্ডটি। এই বইটির ভাষান্তর করেছেন শুভেন্দু সরকার।
তালিকা শুনে জানার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল আরও, আর কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আসতে চলেছে ২০২৪ বইমেলায়?
আরও একটা আশ্চর্য বই আসতে চলেছে এই বইমেলাতেই। অবশ্য তাকে ফিকশন বলব না ননফিকশন, বুঝতে পারছি না। আমরা একে বলছি দৃশ্যআখ্যান অর্থাৎ গ্রাফিক নভেল। বইটির নাম 'যেখানে পাখিরা গাহে না গান'। মরিচঝাঁপি গণহত্যার এই দৃশ্যআখ্যানটির এই বইটির প্রণেতা সৌম্যশঙ্কর বসু। সৌম্য আদতে একজন ফটোগ্রাফার। ১৯৭৯ সালে সেই মরিচঝাঁপি গণহত্যা মামলায় প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ ভাবে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। যাঁরা ওই ঘটনার যারা সাক্ষী, যাঁদের স্মৃতিতে আজও জীবন্ত ভয়ঙ্কর সেই হত্যাকাণ্ড, ২০২০ সালে তাঁদের খুঁজে বের করেছেন সৌম্য সারা ভারত থেকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মরিচঝাঁপিতে গিয়ে বেশ কিছু পুরনো তথ্য এবং ছবিও সংগ্রহ করেছেন তিনি। তার উপরেই তৈরি হয়েছে বইটি। জার্মান আর্ট পেপারে চার কালারে ছাপা হয়েছে বইটি। এটি মান্দাসের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে চলেছে বলে মনে করছি আমরা।
আরও একটি বই বেরোতে চলেছে এই বইমেলায়। বইটির বিজ্ঞাপন আসতে না আসতেই বইটি নিয়ে যে খোঁজ পড়েছে, তাতে আমাদের সন্দেহ নেই এই বইটিও অন্যতম একটি বেস্টসেলার হতে চলেছে। এমন কাজ এর আগে বাংলায় সম্ভবত হয়নি। দেশভাগ নিয়ে অনেক বই আছে। কিন্তু সেগুলি সবই ওপার বাংলা থেকে এ পার বাংলায় চলে আসা মানুষের গল্প। কিন্তু যাঁরা এপার বাংলা থেকে চলে যেতে বাধ্য হলেন ওই বাংলায়! তাঁদের কথা এতদিন অনালোকিতই থেকে গিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। এবার তাঁদের কথা বলতে আসছে 'দাঙ্গা, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সময়: পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ'। এমন বেশ কয়েকজনের স্মৃতিকথা এবং দেশভাগের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে। তার মধ্যে রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল কাফির একটি প্রবন্ধও। এই সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক মৃদুল হক।
বইমেলা বা বলুন বা সারাবছরের বিক্রিবাটা, কী ধরনের বইয়ের বাজার বেশি মান্দাসের? কী মনে হয়?
বইমেলার একটু আগে আগেই নতুন যে কটি বই আমাদের বেরিয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে অনেক বইয়েরই কিন্তু বাজারে ইতিমধ্যেই বেশ ভালো কাটতি। তার মধ্যে যেমন রয়েছে 'বিশিষ্টজনেদের বিবাহে বিভ্রাট বিবাহে বিপ্লব'তেমনই ভালো বিক্রি হচ্ছে 'সাধুর হেঁশেল' বা 'ভালোবাসার কারক প্রকরণ'-এর মতো বই। সৌম্যশঙ্কর বসুর 'যেখানে পাখিরা গাহে না গান' বইটির দাম ১২০০ টাকা। দু'দিন আগেই এক ব্যক্তি দশ কপি অর্ডার দিয়ে গিয়েছেন বইটির। 'ছোটোদের শঙ্খমেলা' নামে একটি ছোটদের আবৃত্তিযোগ্য কবিতা ও গদ্যের সংকলন রয়েছে আমাদের, সে বইয়েরও বিশাল কাটতি। বইটি পাঁচশো কপি ছাপা হয়েছে, এর মধ্যেই তিনশো কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। 'প্রফুল্ল রসায়নী' নামে একটি বই প্রকাশ পেয়েছে ক'দিন আগেই। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা ওই বইটিও ভালো বিক্রি হচ্ছে। অব্রাহ্মণ পুরোহিত নামে একটি বই রয়েছে আমাদের। সেটি একেবারেই গবেষণাধর্মী একটি বই। কুড়মি, লোধার মতো বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থানের উপাসক যাঁরা, তাঁদের উপর একটি কাজ। সুশীলকুমার বর্মনের লেখা। সেটিও কিন্তু খুবই ভালো বিক্রি হচ্ছে। শর্মিলা বসু ঠাকুরের লেখা 'রান্নার রূপকথা' বইটিও ভালো বিক্রি হয়েছে। ফলে কোনও এক ধরনের বইয়েরই বাজার কাটতি বেশি বললে কিন্তু ভুল বলা হবে। বিভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন ধরনের বই-ই কিন্তু পাঠক পছন্দ করছেন, কিনছেন।
পেপারব্যাক না হার্ডকভার- কোনদিকে ঝুঁকে মান্দাস?
কোনওটা নিয়েই কোনওরকম ছুৎমার্গ নেই মান্দাসের। তবে মানতে বাঁধা নেই, হার্ডকভারের থেকে পেপারব্যাকের সংখ্যা কিঞ্চিৎ কম। এখনও পর্যন্ত আমাদের বহু প্রকাশিত বই-ই পেপারব্যাক। এবারের বইমেলাতেও বেশ কিছু পেপারব্যাক নিয়ে আসছে মান্দাস। বিশিষ্টজনেদের বিবাহে বিভ্রাট বিবাহে বিপ্লব' বইটি পেপারব্যাক, 'প্রফুল্ল রসায়নী' পেপারব্যাক, তারপর ধরুন ঋজুরেখ চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস রয়েছে, 'আকরিক আলো-অন্ধকার'- এটিও পেপারব্যাক। জয় গোস্বামীর দু'টি কবিতার বই 'কঙ্কাল' এবং 'ঘাতক'- দু'টিই পেপারব্যাক। তাছাড়া পৃথ্বী বসুর কবিতার বই 'ক্লান্ত উটের চলাচল'-ও পেপারব্যাকেই ছাপা হয়েছে। আরও একটি জরুরি বই আসছে আমাদের এবারের বইমেলায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ দিনগুলো নিয়ে একটি ননফিকশন। বইটির নাম 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু' - এটিও কিন্তু পেপারব্যাক। বইটি লিখেছেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু পেপারব্যাক সংখ্যায় কম কেন? কী মনে হয় পাঠক এখনও পেপারব্যাককে তেমন গুরুত্ব দেয় না?
দেখুন, আমাদের পেপারব্যাক করার ক্ষেত্রে দুটো ভাবনা কাজ করে। ইংরেজিতে যেমন হয়, তার পেপারব্যাকও হয়, হার্ড কভারও হয়। কিন্তু বাংলায় তো অত সংখ্যক বইছাপা হয় না। এখন তো পিওডি প্রকাশকে চারপাশ ভরে গেছে। পিওডি মানে প্রিন্ট অব ডিম্যান্ড। এক এক জন প্রকাশক দেড়শো-দু'শো টাইটেল প্রকাশ করছে বইমেলায়। অথচ এক এক জন লেখকের কুড়ি-তিরিশটা করে বই ছাপছে।
আপনারা পিওডি ছাপেন না?
না, মান্দাস এখনও পর্যন্ত পিওডি করেনি। ভবিষ্যতেও পরিকল্পনা নেই তেমন কিছুর। আমাদের ন্যূনতম প্রিন্ট রান ৩০০, ম্যাক্সিমাম ৫০০ বা ১০০০। এই ছকেই মোটামুটি কাজ করে মান্দাস। বইয়ের চরিত্র দেখে মূলত আমরা ঠিক করি সেটা পেপারব্যাক হবে না হার্ডকভার। যেমন ধরুন, প্রফুল্ল রসায়নী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়েই মনে হয়েছিল, এটার পেপারব্যাক খুব ভালো হবে। হার্ডকভার করলে থিম্যাটিকালি খুব একটা জমত না বইটা। তার পর এটা তো সত্যি, পেপারব্যাক ছাপলে বইয়ের দামটা একটু কম রাখা যায়। কারণ এখনও প্রকাশনার সব চেয়ে বেশি খরচ যায় কিন্তু বাঁধাইয়েই। ফলে পেপারব্যাক করলে অনেক বেশি পাঠকের হাতে বইটা পৌঁছে দেওয়ার একটা অতিরিক্ত সুযোগ থাকে। সাধারণত পিওডি যারা করেন, তাঁরা পেপারব্যাক বেশি করেন। কারণ সেক্ষেত্রে তাঁরা প্রযুক্তিগত কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্ত আমাদের ক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা বিশেষ নেই। ফলে যে বইটা আমাদের কাছে যেভাবে ধরা দেয়, তার বিষয়ভাবনা যা দাবি করে, তার উপরে আমরা বাঁধাইয়ের ধরন নির্বাচন করি। সারা বছর এতগুলো পেপারব্যাক হবে বা এতগুলো হার্ডবাইন্ডিং হবে, এমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা হয় না মান্দাসে।
পাঠকের চাহিদা না বিষয়, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন জায়গাটাকে বেশি গুরুত্ব দেয় মান্দাস?
প্রকাশকের কাজই হচ্ছে পাঠকের মনকে বোঝার চেষ্টা করা। আর সে কাজটা মোটেও সহজ নয়। আমরা যাঁরা টাকা নিয়ে বই করি না অর্থাৎ নিজেরাই কনটেন্ট বাছি, তাদের পক্ষে এই কাজটা আরওই কঠিন। প্রতিটা প্রকাশনাসংস্থারই তো একটা নির্দিষ্ট রাজনীতি থাকে। সেই রাজনীতির সঙ্গে সেই কনটেন্টকে যেতে হয়। তার পরে সেটাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করি। যেমন ধরা যাক এই 'সাধুর হেঁশেল' বইটি। সেটিকে যে পাঠক পছন্দ করবেন, তা আমরা কাজটা হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম। কারণ এরকম কাজ এর আগে বাংলায় হয়নি। আমরা তো নিজেরাও পাঠক। আমাদের কাছে যখন একটা পাণ্ডুলিপি আসে, তখন আমরা দেখার চেষ্টা করি, সেই পাণ্ডুলিপিতে দম কতটা! দম মানে শুধু বিক্রির দম নয়, কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেমন এই সিদ্দালিঙ্গাইয়ার অনুবাদ বা অব্রাহ্মণ পুরোহিত, কিংবা ধরা যাক 'এই যেখানে পাখিরা গাহে না গান' — এই কাজগুলো করতে গিয়ে আমরা ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। সৌম্যশঙ্কর বসু-র এই বইটায় আমাদের প্রচুর অর্থলগ্নি রয়েছে। কিন্তু সৌম্যবাবু একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। গোটা বিশ্বজুড়ো ওর বিভিন্ন কাজের প্রদর্শনী হচ্ছে। প্রান্তিক, ব্রাত্যজন এবং উদ্বাস্তুদের নিয়েই ওঁর কাজ। আর এই উদ্বাস্তু পরিস্থিতি বা অন্ত্যজদের উপরে ধারাবাহিক অত্যাচার, নিপীড়নের যে ইতিহাস, তার নেপথ্যে যে সব রঙের রাজনীতিরই খেলা। এই ক্ষমতাগুলোকে চিহ্নিত করে ওঁর কাজ। আমাদের রাজনৈতিক ভাষ্যকে কোথাও তুলে ধরে ওঁর সেই ভাষা। ফলে বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারগুলো তো কাজ করেই।
বড় বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলির ধরাবাঁধা লেখক থাকে, যাকে বলা যায় হাউজরাইটার! মান্দাসের ক্ষেত্রে তেমন লেখক কারা?
না, তেমন ধারাবাঁধা হাউজ রাইটার আমাদের আছে বললে ভুল হবে। প্রকাশনার জগতে মান্দাস তেমন পুরনো নয়। ২০২২ সালের অক্ষয়তৃতীয়ার দিনে পথচলা শুরু করেছিলাম আমরা। হাউজরাইটারের কনসেপ্টে মান্দাসে এখনও তেমন না থাকলেও অনেকেই ধারাবাহিক ভাবে মান্দাসে লিখেছেন, যুক্ত থেকেছেন আমাদের সঙ্গে। অনির্বাণ বসুর বই আমরা করছি। এর আগে ধানসিড়ি, আজকাল থেকে আমার হাতেই বেরিয়েছে ওঁর বই। অনির্বাণ ছাড়াও সাদিক হোসেন, অলোকপর্ণা বা কণিষ্ক ভট্টাচার্যের মতো অনেক তরুণ লেখকদের বই নিয়েই কাজ করছে মান্দাস।
জনপ্রিয় বই, জনপ্রিয় লেখক এই তথাকথিত ধারণার বাইরে গিয়েই কি তবে কাজ করতে চাইছে মান্দাস?
একেবারেই। প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয় লেখক আমার কোনওদিনই লক্ষ্য ছিল না তেমন করে। বরং তার চেয়ে লোকপ্রিয় টেক্সটটুকু আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাধুর হেঁশেলের মতো বইয়ের লেখকের নাম আপনি ভুলে যাবেন হয়তো, লেখাটা মনে থেকে যাবে। আমার লক্ষ্য সেটুকুই।
এই বইমেলায় কী প্রত্যাশা?
বইমেলায় প্রত্যাশা মানুষ আসুক। অনেক মানুষ আসুক, তাঁরা দেখুক আমাদের নতুন কাজগুলো হাতে নিয়ে। বইমেলা মানে তো একটা যোগাযোগের জায়গা। পাঠকের সঙ্গে প্রকাশকের, পাঠকের সঙ্গে লেখকের। এই বইমেলায় পাঠক, লেখক, প্রকাশক দেখা হোক, আড্ডা হোক। ভালো ব্যবসা হোক। এটুকুই চাওয়ার।
আরও পড়ুন:‘মনের মতো চরিত্র পেলে তবেই সিরিয়ালে ফিরব’: সুদীপ্তা চক্রবর্তী
আজকের নতুন প্রজন্ম যাঁরা, তাঁরা কতটা মান্দাসমুখী বলে মনে হয়?
মান্দাস তো প্রথম থেকেই তরুণ প্রজন্মমুখী। মান্দাসের যে কোর টিম, তাঁরা প্রত্যেকেই তরুণ। বহু তরুণ কবি-লেখকেরই বই করেছে মান্দাস। এ বছর প্রগতি বৈরাগীর কবিতার বই বেরিয়েছে মান্দাস থেকে। দেবহূতি সরকারের কর্মমঙ্গল বেরোচ্ছে। এরা দুজনেই তরুণ কবি। ফলে মান্দাসের একটা ঝোঁকই রয়েছে তরুণদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার। তাই বলে প্রবীণদের বাদ দিয়ে নয়। তাঁদের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে চায় মান্দাস। আমরা শংকরলাল ভট্টাচার্যেরও বইও আমরা করেছি গত বছর। তরুণটা সর্বদাই মান্দাসমুখী, কারণ কলেজস্ট্রিটে মান্দাসের বিপণীতে প্রায় রোজই তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসে। নিন্দুকরা যতই বলুক, তরুণ প্রজন্ম বইবিমুখ, আমরা একেবারেই তা মনে করি না। বরং মান্দাসের বই তরুণেরা পড়ে। এই বইমেলাতেও সেই ছবিটা বদলাবে না বলেই প্রত্যাশা।