পায়রা, ঘোড়া থেকে পোস্ট অফিস! ভারতের ডাকব্যবস্থা যে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এল
India Post: আজকের ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার সূচনা কীভাবে হয়েছিল?
নিউ দিল্লির জাতীয় রেল জাদুঘরে একটি চিঠি দেখা যায়। পরাধীন ভারতের রেল আধিকারিকদের উদ্দেশ্যে এক বাঙালির লেখা সেই চিঠির শুরুটা ছিল এইরকম-
ডিয়ার স্যার,
আই অ্যাম এরাইভ বাই প্যাসেঞ্জার ট্রেন আহমেদপুর অ্যান্ড মাই বেলি ইজ টু মাচ সোয়েলিং উইথ জ্যাকফ্রুট।
বিপদে পড়ে লেখা সেই চিঠির ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ভাষা পড়লে অনেকেই মুচকি হেসে ফেলে। বহু মানুষ ছাপা অক্ষরে এবং তার থেকেও অনেক বেশি মানুষ নেটমাধ্যমে এই চিঠি পড়েছেন। অখিলচন্দ্র সেনের লেখা এই চিঠি আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হয়। যদিও আসলে এই চিঠি এক বিশাল পরিবর্তন এনেছিল। এই চিঠির ফলেই ট্রেনের মধ্যে সব শ্রেণির যাত্রীদের জন্য শৌচাগার নির্মাণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নিজের অসুবিধা এবং অভিমান একটা কাগজের টুকরোতে লিখে অখিলচন্দ্র সেন যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যর একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: স্টিম ইঞ্জিন নয়, বরং বলদ দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলায় ট্রেন চলাচল
প্রাচীন ভারতে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর সময় প্রথম সংগঠিত ডাক ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই সময়ে পায়রার পায়ে ছোট কাগজের টুকরোতে দরকারি তথ্য বিভিন্ন এলাকায় আদানপ্রদান করা হতো। সম্রাট অশোকের শাসনকালেও এই পদ্ধতিতে তথ্য আদানপ্রদান করা হতো। পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাসকের আমলে ঘোড়ার পিঠে অথবা পায়ে হেঁটে চিঠি পৌঁছনো ডাকবাহকদের কথা জানা যায়। সেই সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাকবাহকরা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চিঠি পৌঁছে দিত।
১৫৪১ সালে শের শাহ বাংলা থেকে সিন্ধু প্রদেশ অবধি প্রায় দু'হাজার মাইল দূরত্বের মধ্যে ঘোড়ার পিঠে ডাক পরিবহণের সূচনা করেছিলেন। এই সময়ের ডাকব্যবস্থার একটি নেতিবাচক দিক ছিল পোস্ট অফিসের অভাব। ১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতীয় ডাক ব্যবস্থা সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে সেই সময়ের বড় শহরগুলিতে পোস্ট অফিস তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ অনুসারে, ১৭৭৪ সালের মার্চ মাসের ৩১ তারিখ কলকাতায় প্রথম পোস্ট অফিস তৈরি হয়েছিল। কলকাতার মতোই ১৭৮৬ সালে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) এবং ১৭৯৪ সালে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বই) শহরে পোস্ট অফিস স্থাপিত হয়। এইভাবেই আজকের ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। ক্রমে ১৮৭৯-'৮০ সালে পোস্টকার্ড এবং মানি অর্ডারের প্রচলন শুরু হয়।
ডাকব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে চিঠি মানুষের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে কুশল বিনিময়, পরিবারের কাছে টাকা পাঠানো থেকে লুকিয়ে প্রেম, সর্বত্রই চিঠির আনাগোনা শুরু হয়েছিল। ১৮৮৬ সাল নাগাদ স্ট্যাম্প বিক্রি শুরু হয়েছিল এবং একই সঙ্গে বহু মানুষ এক নতুন শখ খুঁজে পেয়েছিল। বিভিন্ন রকমের, বিশেষত দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্প জোগাড় করা এবং জমানোর শখ। এই স্ট্যাম্প জমানোর শখ মানুষের রোজকার জীবন থেকে এগিয়ে গিয়ে সাহিত্যের পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল। বহু বাংলা গল্প বিশেষত, গোয়েন্দা গল্পে স্ট্যাম্প খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন এলাকায় চিঠি পাঠানোর জন্য রেলপথ ব্যবহার করার ফলে ডাকব্যবস্থা উন্নততর হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পরে দেশের সঙ্গে ডাকব্যবস্থা এবং পোস্ট অফিসের বিভিন্ন পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে স্পিড পোস্টের প্রচলন শুরু হয়েছিল। বর্তমানে পোস্ট অফিসের যে গুটিকয়েক পরিষেবা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে, তার মধ্যে স্পিড পোস্ট অন্যতম।
বর্তমান সময় বহু ক্ষেত্রে ডাকব্যবস্থা এবং পোস্ট অফিসের বেহাল দশার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাওয়া যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করলেও ডাক ব্যবস্থা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কাগজের চিঠির জায়গা নিয়েছে ইমেইল। তার গতির সঙ্গে আমাদের কাগজের চিঠি এঁটে উঠতে পারেনি। কুশল বিনিময় করার জন্য রয়েছে মুঠোফোন। কয়েকটা বোতাম টিপে মন খুলে কথা বলা সম্ভব, তাই পোস্টকার্ডের সীমাবদ্ধ জায়গায় লিখতে মানুষ নারাজ। প্রেম-আলাপের জন্য আজ হাতে লেখা চিঠি একপ্রকার বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। চিঠি পাঠানোর ঝামেলা সহ্য না করে, ধরা পড়ার ভয় না করে মুঠোফোনের মাধ্যমে নিশ্চিন্তে মনের কথা বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিছু হাতে গোনা মানুষ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষের শখ করে জমানো ডাক টিকিটের অ্যালবামে ধুলো জমেছে। রাস্তার ধারের ডাকবাক্স সময়ের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে। তার মধ্যে কখনও নতুন পরিকল্পনা এনে, আবার কখনও গঙ্গাজল বেচে পোস্ট অফিস বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। তারই মাঝে প্রতি বছর চুপিসারে প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে ৯ অক্টোবর 'বিশ্ব ডাক দিবস' এবং সেই উপলক্ষে ১০ অক্টোবর জাতীয় ডাক দিবস পালিত হয়।