কেন এত বিখ্যাত প্যালেস্তাইনের সাদা-কালো স্কার্ফ! কেফিয়াহর বিশেষ প্রতীকের অর্থ অবাক করবে
Keffiyeh Scarf of Palestine : কেফিয়াহ বা কুফিয়া আসলে একটি বর্গাকার আকৃতির সুতির কাপড়। আরব বিশ্বের অনেক জায়গারই মানুষ এই চেক প্যাটার্নের স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকেন।
প্যালেস্তাইন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক অঞ্চল। জীবনের দাম নেই, শিশুদের ভবিষ্যৎ নেই। ঠাসাঠাসি ভিড় করে থাকেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। একমাসের উপর হয়ে গেল সেখানে যুদ্ধ চলছে। ১৪ হাজার মানুষ মরে গেছে, অধিকাংশই শিশু। হামাস নামে এক জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিকেশ করতে চেয়ে প্রতিশোধমূলক যুদ্ধে আসলে গাজাকেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইজরায়েল। এইটুকু এখন খবর, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে জানেন সবাই। কিন্তু প্যালেস্তাইন মানে শুধু এটুকুই না। হ্যাঁ, যুদ্ধ প্যালেস্তাইনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। মিশে রয়েছে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে সুস্থভাবে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। রয়েছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠা স্বপ্ন। প্যালেস্তিনিয় মানুষদের রোজের যাপনেই রয়েছে প্রবল প্রতিরোধের ঘ্রাণ। প্যালেস্তাইনকে চিনতে গেলে তাই এর মাটিকে চিনতে হবে, চিনতে হবে এর শিকড়কে, এর প্রতীককে। প্যালেস্তাইনের একটি নির্দিষ্ট জিনিস অনেকেই হামেশাই দেখেন, একটি সাদা কালো স্কার্ফ। বিখ্যাত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফতের কথা মনে করুন। এই স্কার্ফ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত প্রতীক যেন। প্যালেস্তাইনের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে রয়েছে এই প্রতীক, কেন?
ফিলিস্তিনি ভাষায় এই স্কার্ফকে বলে কেফিয়াহ। বিশ্বব্যাপী যত যত দেশে, শহরে বিক্ষোভকারীরা গাজায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন সকলেই এই প্রতীকী কালো-সাদা ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ ব্যবহার করেছে। অনেক বিক্ষোভকারীরা বড় বড় চাবি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অনেকে জলপাই নিয়ে এসেছেন। আসলে এই সব প্রতীকই ফিলিস্তিনিদের প্রতীক, ভিন্ন ভিন্ন পথে প্যালেস্তাইনেরই প্রতিনিধিত্ব করে এই স্কার্ফ, চাবি বা জলপাই। ফিলিস্তিনিদের আত্মপরিচয় এবং ইজরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক এগুলি।
কেফিয়াহ বা কুফিয়া আসলে একটি বর্গাকার আকৃতির সুতির কাপড়। আরব বিশ্বের অনেক জায়গারই মানুষ এই চেক প্যাটার্নের স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকেন। অনেকেরই এই প্রসঙ্গে সলমান খানের কথা মনে পড়তে পারে। একটি কালো-সাদা চেক স্কার্ফ দিয়ে মাঝে মাঝেই নায়কের চরিত্রটিকে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেই স্কার্ফের সঙ্গে ফারাক রয়েছে প্যালেস্তিনিও কেফিয়াহের। ফিলিস্তিনি পুরুষ এবং মহিলারা যে সাদা-কালো কেফিয়াহ পরেন তা স্ব-নিয়ন্ত্রণ, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতীক।
আরও পড়ুন- ইজরায়েল গাজা যুদ্ধে ভারত কী চায়? উত্তর লুকিয়ে ৭৩ বছর আগের এই ঘটনায়…
এই স্কার্ফে জলপাই-পাতার নকশা করা থাকে। অধ্যবসায়, শক্তি এবং সহনশীলতার প্রতীক এই পাতা। এই স্কার্ফেই মাছের জালের মতো জে চেক নকশা থাকে তা ফিলিস্তিনি জেলে এবং ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে এখানকার মানুষের সংযোগকেই তুলে ধরে। বোল্ড প্যাটার্নগুলি ফিলিস্তিনের বাণিজ্য পথের প্রতীক।
কেফিয়াহ পোশাকটি মূলত সূর্যের চড়া রোদ থেকে বাঁচতে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষরাই ব্যবহার করত। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের সময় এই কেফিয়াহ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই কেফিয়াহ প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফতের এক ব্যক্তিগত প্রতীকও হয়ে ওঠে। ইয়াসির আরাফত এই স্কার্ফটিকে ত্রিভুজ আকারে ভাঁজ করে কাঁধের উপর দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতেন।
সেই কেফিয়াহই এখন ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব প্রতীক। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সারা বিশ্বের মানুষই এই স্কার্ফ ব্যবহার করেন। ঐতিহ্যগতভাবে ফিলিস্তিনি কৃষকরাই আগে এই স্কার্ফ পরতেন। অটোমান আমলে কেফিয়াহ পরতেন গ্রামীণ মানুষই, শহুরে মানুষরা পরতেন টারবুশ।
কালো এবং সাদা কেফিয়াহ ১৯৩০-এর আরব বিদ্রোহের সময় ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৩৮ সালে কেফিয়াহের জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছয়। শহুরে মানুষও টারবুশের বদলে কেফিয়াহ পরতে শুরু করেন। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্যই ছিল, ঐক্য তৈরি করা যাতে বিদ্রোহীরা যখন শহরে প্রবেশ করছে, সকলেই এক দেখতে হয়ে ওঠে।
১৯৬০-এর দশকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ ইয়াসির আরাফত কেফিয়াহকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। কালো-সাদা ফিশনেট প্যাটার্নের কেফিয়াহই আরাফতের প্রতীক হয়ে ওঠে। সবসময় এই কেফিয়াহ পরতেন ইয়াসির। প্রবল ঠান্ডায় কেবল রাশিয়ান-স্টাইলের উশাঙ্কা টুপি পরতেন তিনি। আরাফাত কেফিয়াহ পরতেন ফিউশন স্টাইলে। প্রথম দিকে, ফিলিস্তিনের দাবি করা ভূখণ্ডের রূপরেখার সঙ্গে মিল রেখে খানিকটা ত্রিভুজের আকারে সাজিয়ে শুধুমাত্র ডান কাঁধে স্কার্ফ রাখতেন ইয়াসির।
আরও পড়ুন- ইজরায়েলের ডানপন্থী সরকার প্যালেস্তাইনের হামাস, দুইয়ের পতন চাই
কেফিয়াহ পরতেন লীলা খালেদও। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিনের সশস্ত্র শাখার সদস্য লীলা। TWA ফ্লাইট 840 এবং ডসন'স ফিল্ড হাইজ্যাকিংয়ের পর খালেদের বেশ কিছু ছবি সংবাদপত্রে আসে। এই ছবিগুলিতে প্রায়ই খালেদকে একজন মুসলিম মহিলার হিজাবের মতো করে কেফিয়াহ পরতে দেখা যায়। বিষয়টি সেই সময় ছিল ছক ভাঙা। সাধারণত কেফিয়াহ আরব পুরুষদেরই পরতে দেখা যেত। খালেদ তাঁকে নিজের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট করে তোলেন। ঐতিহ্যগত কালো এবং সাদা কেফিয়াহ ফাতাহ-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। পরে, লাল এবং সাদা কেফিয়াহ ব্যবহার করতেন পিএফএলপি-র মতো ফিলিস্তিনি মার্কসবাদীরাও।
২০০৬ সালে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী, হোসে লুইস রদ্রিগেজ জাপাতেরো ইজরায়েলের কঠোর সমালোচনা করে একটি বক্তৃতা দেন। তারপর দর্শকদের কাছ থেকে একটি কেফিয়াহ নিয়ে তা পরেন। সেই সময় এই ঘটনাটি বিশ্ব রাজনীতিতে ভীষণ হইচই ফেলে। এরপর টপশপ, এএসওএস, সিসিলি কোপেনহেগেন, বোহো বা ইজরায়েলি ব্র্যান্ড ডোডো বার অর-এর মতো ব্র্যান্ডের ফ্যাশনে কেফিয়াহ প্রিন্টটি বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, ফিলিস্তিনি পরিচয়ের এই প্রতীকটি এখন মূলত চিন থেকে আমদানি করা হয়। ২০০০-এর দশকে স্কার্ফের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে চিন এই বাজার ধরতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনিদেরই এই ব্যবসা থেকে বের করে দেয়। পাঁচ দশক ধরে, ইয়াসির হিরবাউই ছিলেন একমাত্র ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ প্রস্তুতকারক। হেবরনের হিরবাউই টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে ১৬ টি তাঁতে কেফিয়াহ তৈরি হতো। ১৯৯০ সালে এই ১৬ টি তাঁতে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ টি কেফিয়া তৈরি হতো। ২০১০ সাল নাগাদ, মাত্র ২টি তাঁত ব্যবহার করা হতো, প্রতি সপ্তাহে মাত্র ৩০০ কেফিয়াহ তৈরি করা হতো। হিরবাউই সুতির কেফিয়াহ বানাত, চিন কিন্তু তা করে না।