ঋণে ডুবে থাকা টাটা গোষ্ঠীকে বাঁচিয়েছিল এটি! ভারতের অজানা ইতিহাসের শরিক জুবিলি ডায়মন্ড
History of Jubilee Diamond Tata : কিন্তু জানলে অবাক হবেন, ভারতের আধুনিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই বিশেষ হিরেটি।
বলিউড হোক বা হলিউড, হিরে চুরির বিভিন্ন কাহিনি উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়। শুধু চুরিই বা কেন, পৃথিবীর ইতিহাসের নানা অধ্যায় ঘুরলেই উঠে আসবে বিভিন্ন সব হিরের কাহিনি। একেকটার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে রহস্য, কোনওটা আবার ওই দেশের ইতিহাসের অংশীদার। যেমন ভারতের কথাই ধরুন। প্রাচীন সময় ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল, এই দেশের রাস্তায় রাস্তায় নাকি এমন অজস্র হিরে, জহরত, সোনাদানা ছড়ানো থাকে। সেই মণিমুক্তোখচিত কাহিনি এখন অতীত। অবশ্য ভারতের হিরের কথা বললেই সবার আগে নাম চলে আসে কোহিনূরের কথা। তার ঔজ্জ্বল্য, কে তার মালিক, এই নিয়ে চায়ের আড্ডা গরম হয়েছে নানা সময়। যাই হোক না কেন, এই দেশের ধনদৌলতের কথা কোহিনূরে এসেই শেষ হবে, এমনটাই দস্তুর।
তবে আজ যে হিরের কথা বলব, সে কোহিনূরের থেকে একেবারে আলাদা। হিসেব করে দেখলে, তার থেকেও বেশি মূল্যবান! বলা হয়, এটি নাকি বিশ্বের বৃহৎ হিরেগুলির তালিকায় এটি ছয় নম্বরে। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত জুবিলি ডায়মন্ডকে নিয়ে। ২৪৫.৩৫ ক্যারেটের এই হিরের দিকে তাকালেই চোখে ধাঁধাঁ লেগে যাবে। যেখানে কোহিনূর মাত্র ১০৫.৬ ক্যারেটের। কিন্তু ইতিহাস তাকে বিখ্যাত করেছে। অজানাই থেকে গিয়েছে জুবিলি ডায়মন্ডের কাহিনি। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, ভারতের আধুনিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই বিশেষ হিরেটি। আজকের ভারতের এমন রূপের পেছনে এর অবদান অস্বীকার করতে পারেন না কোনও ঐতিহাসিকই। কেন? সেই গল্পের সঙ্গে মিশে আছে ভারতের শিল্প বিপ্লব, এবং ঐতিহ্যশালী টাটা গোষ্ঠী।
আরও পড়ুন : কোনও পুরুষই সামলাতে পারেননি কোহিনূর! কোন মন্ত্রে ‘অভিশপ্ত’ হিরের নতুন মালিক হচ্ছেন ক্যামিলা!
যাত্রার শুরুটা
উনবিংশ শতকের আগে অবধি গোটা বিশ্বের কাছে ভারত আর ব্রাজিল ছিল হিরের যোগানদার। এই দুটি দেশের খনি থেকেই উঠে আসত একের পর এক মূল্যবান রত্নখণ্ড। সমস্ত ছবিটা বদলে গেল ১৮৬০-র দশকে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় হিরের খনি আবিষ্কৃত হল। তারপর থেকে রত্ন আর হিরের ইতিহাসে এক আলাদা উচ্চতায় চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানকারই জাগেরসফন্টেনের খনি থেকে ১৮৯৫ সালে পাওয়া গিয়েছিল এই জুবিলি ডায়মন্ড। যার চমক আর আকার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পালিশ করার আগে এটি ছিল প্রায় ৬৫০ ক্যারেটের। প্রথমে অবশ্য এর নাম ‘জুবিলি’ ছিল না। জাগেরসফন্টেন খনি অঞ্চলের অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস উইলিয়াম রেইটসের সম্মানে এর নাম দেওয়া হয় ‘রেইটস ডায়মন্ড’।
এরইমধ্যে চলে এল ১৮৯৭ সাল। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের ৬০ বছর অর্থাৎ প্ল্যাটিনাম জুবিলির উদযাপন শুরু হল। ঠিক হল, এই রেইটস ডায়মন্ডটি রানিকে উপহার দেওয়া হবে। সেইমতো করা হল নতুন নামকরণ – ‘জুবিলি ডায়মন্ড’। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই হিরে রানির কাছে পৌঁছল না। সেই জায়গায় তৎকালীন পর্তুগালের রাজা প্রথম কার্লোস তাঁর স্ত্রীর জন্য এই হিরে কিনে নিলেন। অবশ্য নামটি একটি থেকে গেল, জুবিলি ডায়মন্ড।
রাজার ঘর থেকে টাটার প্রাসাদে
সাল ১৯০০। নতুন একটা শতাব্দী, নতুন কিছু স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের হাত ধরেই শুরু হল পথচলা। ওই বছরই প্যারিসে আয়োজিত হল বিরাট প্রদর্শনী। আর সেখানেই জায়গা পেল জুবিলি ডায়মন্ড। তার রূপের আলোয় রীতিমতো বিমোহিত হয়ে যান সবাই। গোটা বিশ্ব থেকে নামী মানুষেরা এই প্রদর্শনীতে এসেছিলেন। সেখানে হাজির ছিলেন আরও একজন, স্যার দোরাবজি টাটা। ভারতের টাটা গোষ্ঠীর জয়যাত্রা তখন একটু একটু করে শুরু হয়েছে। সেই সময়ই প্যারিসের সেই প্রদর্শনী থেকে জুবিলি ডায়মন্ডটি কিনে নেন দোরাবজি টাটা। উপহার দিলেন নিজের জীবনসঙ্গিনী, প্রিয় মানুষটিকে। তিনি লেডি মেহেরবাই টাটা।
আরও পড়ুন : কোহিনুরের দ্বিগুণ বড় হিরে ছিল তাঁর দখলে! আম্বানি-আদানির বৈভব ম্লান করে দেবে এই ইতিহাস
অদ্ভুতভাবে, এরপরই একটু একটু করে নিজেদের সাম্রাজ্য আরও বড় করতে শুরু করল টাটা। ভারতে তখন কেবল তাদেরই স্বপ্ন, দেশ একটু একটু করে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা নিচ্ছে। ১৯০৩ সালে মুম্বইতে খুলে গেল দ্য তাজমহল হোটেল, ঠিক চারবছর পর ১৯০৭ সালে তৈরি হল টাটা স্টিল বা টিসকো (TISCO)। ১৯১০ সালে তৈরি হল টাটা পাওয়ার। একটু একটু করে দেশের শিল্পের মানচিত্রটা মজবুত হচ্ছিল তাদের হাত ধরে। আর যার শরিক ছিলেন স্যার দোরাবজি ও লেডি মেহেরবাই টাটা।
একটু একটু করে এই দম্পতির নাম গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ল টাটা গোষ্ঠীর চমৎকারের বর্ণনা। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছেন, দুজনে সংগ্রহ করেছেন বহু মূল্যবান জিনিস। সেখানে ছিল ঐতিহ্যশালী অনেক সামগ্রীও। সঙ্গে ছিল জুবিলি ডায়মন্ড। যা আগলে রাখতেন লেডি মেহেরবাই। তিনি নিজেও সেই সময় নারীদের নিয়ে বিভিন্ন কাজ করছিলেন। বোম্বে প্রেসিডেন্সি উওমেন কাউন্সিল এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর উওমেনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মেহেরবাই টাটাকে সম্মানিত করেছিলেন খোদ ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ।
টাটাদের হঠাৎ পতন ও ত্রাতা জুবিলি ডায়মন্ড
কিন্তু সময় সবার একরকম যায় না। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য হাসে, তেমনই ঝলমলে দিনেও চলে আসতে পারে নিকষ কালো মেঘ। ঠিক সেই জিনিসটাই হল দোরাবজি টাটার সঙ্গে। ১৯২৪ সাল। সেই সময় থেকে গোটা ভারতে জনপ্রিয় হতে শুরু করল জাপান থেকে আসা লোহা। গোটা বাজার ছেয়ে গেল এতে। তুলনায় সস্তা এই জাপানি লোহাই কিনতে শুরু করলেন সবাই। মাঝসমুদ্রে ডুবতে শুরু করল টাটা সাম্রাজ্য। টাটা স্টিলের অবস্থা তখন তথৈবচ। কী করবেন, কীভাবে সংস্থাকে বাঁচাবেন, এটাই রাতদিন ভাবতে লাগলেন স্যার দোরাবজি টাটা। মাথার ওপর প্রায় দুই কোটি টাকার দেনা! আজকের দিনে যার পরিমাণ চিন্তারও বাইরে। অবস্থা এমন হল যে, টাটা স্টিল কোম্পানিটি বন্ধ করে দেওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
সেই সময়ই এগিয়ে এলেন লেডি মেহেরবাই টাটা। হাতে ধরা মহা মূল্যবান জুবিলি ডায়মন্ড। খুব প্রিয় ছিল এটি। কিন্তু এখন সাম্রাজ্য বাঁচুক, দেশ বাঁচুক। ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় (এখন এসবিআই) এই জুবিলি হিরে সহ আরও বেশকিছু মূল্যবান গয়না বন্ধক রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। হাতে এল বিরাট অঙ্কের টাকা। একটু একটু করে ফের ঘুরে দাঁড়াল টাটা গোষ্ঠী। আজকের এই বিশাল সাম্রাজ্য দেখলে মনে হবে সেই দুঃসহ দিনের কথা!
১৯৩০-এর দশকে পরপর মারা যান লেডি মেহেরবাই টাটা ও স্যার দোরাবজি টাটা। দুজনেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর এই জুবিলি ডায়মন্ড বিক্রি করে দেওয়া হয়। যে টাকা আসে, তা দিয়ে তৈরি করা হয় আরও একটি প্রতিষ্ঠান। আজ গোটা ভারত যাকে চেনে ‘টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল’ হিসেবে। আপাতত মৌয়াওয়াড কালেকশনের অধীনে রয়েছে জুবিলি ডায়মন্ড। কিন্তু তার ইতিহাস এখনও লেগে আছে প্রতিটা খাঁজে, ঠিকরে বেরনো প্রতিটা আলোয়।