মৃত্যুর পরে ফিরে আসা, বর্ধমানের রাজার গল্পের সঙ্গে হুবহু মিল আছে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর

বর্ধমানের রাজপরিবারের তিনশো বছরের রাজত্বকালের ইতিহাসের সঙ্গে অনেক উত্থান-পতন, বংশমর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা, রাজ্যশাসন, দান-ধ্যান-মহিমা এবং সেইসঙ্গে হিংসা, ষড়যন্ত্র, পরকীয়া– নানারকম কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে। তিনশো বছর ধরে প্রায় কুড়ি জন রাজা বা জমিদার সতেরো-আঠারো পুরুষ ধরে রাজত্ব করে গিয়েছেন।

বর্ধমানের রাজপরিবারের যতজন রাজা রাজত্ব করে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র অবশ্যই মহারাজা তেজচাঁদ। তাঁর চরিত্রে একাধারে ভাল-মন্দ দু’টি দিকই বিদ্যমান ছিল। খামখেয়ালি, উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, যৌবন মদমত্ত রাজা বলা যায় তাঁকে– আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন প্রজাবৎসলও বটে। তাঁর সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, তিনি সাপে কামড়ানোর ওষুধ জানতেন। কিন্তু শ্রীপ্রণয়চাঁদের মতে, পারিবারিক ইতিহাসে নাকি এর সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। যাই হোক, বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ।

মহারাজা তেজচাঁদের ৮ জন মহিষী ছিলেন। রাজপরিবারে তাঁদের কী ভূমিকা ছিল– স্বাভাবিকভাবে মনে হতেই পারে। জানা যায়, তেজচাঁদের সঙ্গে তাঁর প্রথমা, দ্বিতীয়া এবং তৃতীয়া পত্নীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল একই দিনে। এখানেই শেষ নয়, জানা যায়, চতুর্থ বিবাহ সম্পন্ন হয় প্রথম তিনটি বিবাহের এক সপ্তাহের মধ্যেই। এই বিবাহের প্রেক্ষাপটও অত্যন্ত চমকপ্রদ। বর্ধমানের রাজপরিবারে এই ঘটনা অস্বাভাবিক, কারণ রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বিবাহ হত পাত্র ও পাত্রীর করকুষ্ঠির মিল দেখে। মহারাজা তেজচাঁদের এই তিন রানির সঙ্গে বিবাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার আগে আরও এক জায়গায় করকুষ্ঠির গণনাকার্য চলার সময়েই এই তিন বিবাহ একসঙ্গে সমাধা হয়।ওদিকে করকুষ্ঠিতে যোটক মিল হওয়ার ফলে পাত্রীর পিতা বর্ধমান রওনা হয়ে যান। এরপর তিনি রাজবাড়িতে এসে জানতে পারেন, আগের দিন তিনজন কন্যার সঙ্গে রাজার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। রাগে-দুঃখে অপমানিত বোধ হওয়া পাত্রীর পিতা আদালতে মহারাজের নামে মামলা করেন। সুতরাং, বাধ্য হয়েই এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি চতুর্থ বিবাহ সম্পন্ন করেন।

এরপর পঞ্চম পত্নী হিসেবে পাণিগ্রহণ করেন পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারীকে। কমলকুমারী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। শোনা যায়, তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়েই মহারাজা এই বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য,পাঁচ-পাঁচটি রানির কোনও সন্তানাদি হল না। বংশ লোপ পাওয়ার ভয়ে মহারাজা ষষ্ঠ বার বিবাহ করলেন নানকী দেবীকে। একমাত্র এই নানকী দেবীই মহারাজাকে বংশরক্ষার জন্য একটি পুত্রসন্তানের মুখ দেখালেন। ১৭৯১সালের ২৪ অক্টোবর নানকী দেবীর গর্ভে জন্মাল প্রতাপচাঁদ।

এই প্রতাপচাঁদকে ঘিরেই বর্ধমানের রাজপরিবারে ঘটেছিল ঐতিহাসিক মামলা-মোকদ্দমা। গৌতম ভদ্রর ‘জাল রাজার কথা: বর্ধমানের প্রতাপচাঁদ’ বইতে এর উল্লেখ পাওয়া যাবে। কমলকুমারী এবং তাঁর দাদা পরাণচাঁদ কাপুরের প্রবল লোভ ছিল মহারাজের সম্পত্তির ওপর। খুব অল্প বয়সে প্রতাপচাঁদ মাতৃহারা হন;নানকী দেবী গত হওয়ার পর মহারাজার একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রতাপচাঁদ অল্প বয়সেই (১৮১৩ সালে) রাজ্পাট দেখাশোনা শুরু করলেন। কারণ তেজচাঁদ তখন বৃদ্ধ হয়েছেন। এদিকে সম্পত্তি দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পর থেকেই প্রতাপচাঁদের সঙ্গে ক্রমশ কমলকুমারী দেবী এবং পরাণচাঁদের বিরোধিতা জমে উঠতে থাকে।প্রতাপচাঁদ খুব ছোট বয়স থেকেই সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গ পছন্দ করতেন। রাজত্ব চালানো তাঁর ভাল লাগত না। জমা-খরচের হিসাবে তার মন বসত না। একবার বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান।তবুও প্রায় আট বছর তিনি জমিদারির দেখাশোনা করেন। তিনি বারবার বলতেন, তাঁকে কোনও এক সন্ন্যাসী নিদান দিয়েছেন যে, ১৪-বছর অজ্ঞাতবাসে থাকতে হবে। যাই হোক, এইভাবেই আট বছর চলার পর হঠাৎ একদিন (সালটা ছিল ১৮২১) তিনি তাঁর তৈরি হামামে (স্নানঘর) স্নানে ঢুকলেন। কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি হামাম থেকে বের হলেন না। যখন বেরলেন, তখন তাঁর চোখ রক্তবর্ণ, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় মহারাজা প্রতাপচাঁদ কালনায় গঙ্গাতীরে হাওয়া বদলের জন্য এলেন। সঙ্গে প্রতাপের দুই স্ত্রী আনন্দকুমারী ও প্যারীকুমারী। হঠাৎ একদিন রাত্রে প্রতাপচাঁদ সেই অজানা জ্বরে মারা গেলেন। সেদিন ছিল ঝড়জলের রাত। তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে শ্মশানযাত্রীরা মৃতদেহ ফেলে চলে যায় এবং ঝড়বৃষ্টি কমলে এসে দেখে মৃতদেহ নেই। লোকমুখে প্রচারিত হয় যে, প্রতাপচাঁদ সাঁতার কেটে নৌকায় উঠে পালিয়ে গিয়েছেন।

শুধু বৃদ্ধ মহারাজা তেজচাঁদ বললেন, প্রতাপচাঁদ ফিরে আসবে, সে বেঁচে আছে।

এর মধ্যে ১৮৩২ সালে মহারাজা তেজচাঁদ দেহ রাখলেন। এরপর ঠিক ১৪ বছর বাদে, ১৮৩৫ সালে, একজন সন্ন্যাসীকে দেখা গেল বর্ধমানের গোলাপবাগের গাছতলায়। একমুখ দাড়ি, পরনে গেরুয়া বসন। তাঁকে ঘিরে ভিড় জমতে থাকল। সকলেই বলতে লাগল, ইনি 'ছোটকুমার'।


ক্রমে ক্রমে সেই কথা রাজবাড়িতে পৌঁছে গেল। এরপর আর এক ইতিহাস। এ যেন ঠিক ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি। হুবহু একইরকম ঘটনা।

যাই হোক সন্ন্যাসী নিজেও দাবি করেন, তিনি ছোটকুমার। অনেক প্রমাণও দেন। কিন্তু কমলকুমারী এবং পরানচাঁদ কাপুর আদালতের দ্বারস্থ হলেন এবং তার ফলে সন্ন্যাসী গ্রেফতার হলেন। একসময় বঙ্গরাজনীতি তাঁকে নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। তাঁর নামে ফৌজদারি মামলা হয়েছিল। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। এই মামলা চলেছিল দীর্ঘদিন।

প্রতাপচাঁদ মারা যান ১৮২১ সালে এবং তাঁর স্মৃতি-রক্ষার্থে ১৮৪৯ সালে প্রতাপেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। 'জাল' সন্ন্যাসী মামলা যদিও বিতর্কিত বিষয়, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, প্রতাপচাঁদ মারা যাওয়ার প্রায় ২৮  বছর বাদে এই স্মৃতি মন্দির বানানো হল কেন? তিনি মৃত– এটা জনমানসে সুদৃঢ় করার জন্য? ওই সন্ন্যাসী আসলে কে? শেষ পর্যন্ত তাঁর কী হল? এইসব প্রশ্ন রহস্যে ঘেরা।

যাই হোক, প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি অদ্ভুত সুন্দর। টেরাকোটার কারুকার্যমণ্ডিত। মন্দিরের অন্দরে প্রতাপেশ্বর শিবলিঙ্গটি অসাধারণ। মন্দিরের সামনে একটি কামান রাখা আছে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দির।

[তথ্যসূত্র: হিমাংশু দত্ত ও সৌমেন জানা]

More Articles