হুগলি নদীর নীচে টানেল দিয়ে একশো বছর আগেই ছুটত কলকাতার টিউব রেল

সুসেন: পরাধীন ভারতে জন্ম নেওয়া এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃতি দিলে আর বছর চারেক পরেই শতবর্ষ উদযাপন করতে পারত কলকাতা টিউব রেলওয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, কার্যত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলওয়ের পথে একেবারে হুগলি নদীর নীচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এই টিউব রেলওয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন স্যার হার্লি হিউ ডারলিম্পল হে। নাইট উপাধি পাওয়া এই প্রখ্যাত বাস্তু প্রয়ুক্তিবিদের কাছে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২১ সালে, কলকাতার জন্য একটি টিউব রেলওয়ে-র পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ আসে ভারতীয় রেল বোর্ডের তরফে। ইতিহাসের গতিপথে যে পরিকল্পনা একশো বছর পেরিয়ে বাস্তবায়িত হল।

হুগলি নদীর নীচে টানেল দিয়ে একশো বছর আগেই ছুটত কলকাতার টিউব রেল

চিত্রঋণ : Google

তাঁর ওই পরিকল্পনা যে যথাযথ ছিল তার প্রমাণ, অবশেষে টিউব রেলওয়ে তৈরি না হলেও ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশনের বিদ্যুৎ সংযোগবাহী তার কলকাতা থেকে হাওড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য হুগলি নদীর নীচ দিয়েই একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করেন ডারসিম্পল হে। গোটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি ওই ধরণের সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হয় ১৯৩১ সালে। আবহাওযার পরিবর্তন, বর্ষাকালের সমস্যা, নদীর জোয়ার-ভাঁটা আর দক্ষ শ্রমিকের অভাবের মত প্রবল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ওই সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ করা যথেষ্টই কঠিন ছিল। নিজের পরিকল্পনা আর প্রযুক্তিগত বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই সে কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন স্যার হার্লি।

জানা দরকার, পরাধীন ভারতের বাকি সব শহরকে বাদ দিয়ে কলকাতাতেই কেন টিউব রেলওয়ের পরিকল্পনা করলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পরিস্থিতি তো অনুকূল ছিল না। কারণ নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল কলকাতা। যার জন্য দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯১১ সালে। তাহলে দশ বছর বাদে এই শহরের জন্য ব্রিটিশদের এত আগ্রহের কারণ? কলকাতার ইতিহাস গবেষক অশোক মুখোপাধ্যায়ের কথায়, এর মূল কারণ তখনও পর্যন্ত শিল্প-বানিজ্যে দেশের প্রানকেন্দ্র ছিল শহর কলকাতা। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এর প্রাক্তন মুখ্য গ্রন্থাগারিক অশোকবাবু জানাচ্ছেন, অর্থনৈতিক গুরুত্বে সেই সময়ের শহর কলকাতার ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছিল যে লন্ডন মেট্রোর ধাঁচেই একটি টিউব রেলওয়ের পরিকল্পনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

ঠিক কি ভাবে উঠেছিল ওই প্রস্তাব? ১৯১৯ সালে সিমলায় ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্ভবত স্যার ডবলু ই ক্রাম প্রস্তাবিত ওই কমিটি কলকাতা শহরের জন্য একটি মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরির প্রস্তাব করে। অবশ্য সেই কমিটিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে মোট ১৪ বার বৈঠকে বলতে হয়েছিল। টিউব রেলওয়ের পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে হুগলি নদীর নীচ দিয়ে টানেল তৈরির প্রাথমিক ভাবনাচিন্তাও ছিল সেই প্রস্তাবে। কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, "আমরা মনে করি, যে শহরতলির যাত্রীদের তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করার জন্য শহরতলির স্টেশন এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্রের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ প্রয়োজন। ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে থেকে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে পূর্ব ও পশ্চিম টিউব রেলপথের গঠনের মাধ্যমে শুধুমাত্র সেই প্রয়োজনীয়তা সন্তোষজনকভাবে পূরণ করা যেতে পারে।" একদিকে ইস্ট-বেঙ্গল রেলওয়ে-র আওতাভুক্ত পূর্ব কলকাতা বাগমারি আর অন্যদিকে হাওড়ার বেনারস রোডে ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সালকিয়া স্টেশনকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল ওই প্রস্তাবে। আনুমানিক ১০.৪ কিলোমিটার লম্বা ওই রেলপথের দৈর্ঘ্য এখনকার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর তুলনায় মাত্র চার কিলোমিটার কম।

টিউব রেলওয়ে তৈরি তো হবে, কিন্তু বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন আর রূপায়নের দায়িত্ব কাকে দেওয়া যায়? ওই বিষয়ে আলোচনার শুরুতেই উঠে আসে হার্লি হিউ ডারলিম্পল হে-র নাম। জন্মসূত্রে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। ১৮৬১ সালে পরাধীন ভারতের রাওয়ালপিন্ডি অথবা মতান্তরে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় জন্ম হয় ডারলিম্পল হে-র। অবশ্য তার পরে পড়াশোনা আর কাজকর্মের বেশির ভাগটাই ব্রিটেনে। ১৮৯৪ সাল থেকে বেকারলু, হ্যাম্পস্টিড আর পিকাডেলি সার্কাস টিউব স্টেশনের যাবতীয় পরিকল্পনা ও রূপায়েনের দায়িত্ব ছিল তাঁরই হাতে। বিখাত পিকাডেলি সার্কাস টিউব স্টেশনও তাঁরই পরিকল্পনায় তৈরি। ভারতীয় রেল বোর্ডের মাধ্যমে কলকাতায় টিউব রেলওয়ে তৈরির দায়িত্ব পেয়ে প্রথমে বিস্তারিত সমীক্ষার পর যে ন নীল নকশা তিনি তৈরি করেন তাতে বাগমারি ও সালকিয়ার মধ্যে মোট নয়টি স্টেশনের কথা ভাবা হয়। একশো বছর আগে তৈরি ডারলিম্পল হে-র ওই পর্যালোচনা রিপোর্টে জানানো হয় পূর্ব-পশ্চিমে টিউব রেলওয়ের মত শহরের উত্তর-দক্ষিণকে সংযোগ স্থাপনকারী আরও একটি মেট্রো রেলপথ তৈরি প্রয়োজন। যে ভাবনার বাস্তবায়নে এখন লাখ-লাখ কলকাতাবাসীর দৈনন্দিন যাতায়াতের চাহিদা মেটাচ্ছে আজকের কবি সুভাষ-দক্ষিণেশ্বর মেট্রো রেলপথ।

ফিরে যাওয়া যাক একশো বছর আগে। ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের কমিটি প্রস্তাবিত টিউব রেল তৈরির সময়সীমা ধার্য্য করা হয় ১৯২৫-২৬ সাল। ১৯২১ সালে তাঁর কাছে সার্ভে রিপোর্ট পাওয়ার পর তাঁর নীল নকশা তৈরি করেন ডারলিম্পল হে। অবশ্য সার্ভের কাজের সময় তিনি লন্ডন মেট্রোর কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট অগিলভিকে ভারতে পাঠান স্যার হিউ। নজরকাড়া ওই প্রকল্পের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল, ৩৫, ২৬, ১৫৪ পাউন্ড। প্রকল্প রূপায়নের জন্য যে বিপুল খরচ লাগবে তা জেনে ভারতীয় রেল বোর্ডের তরফে একটি ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গোটা বিষয়টির বানিজ্যিক সম্ভাবনা বোঝার জন্য। কারণ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের কমিটি যেহেতু কর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ওই টিউব রেলের সুপারিশ করে সে কারণে রেল বোর্ডের পক্ষে খুব বেশি ট্রেন ভাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল না। বাগমারি থেকে সালকিয়ায় যাতায়াতের জন্য ভাড়া ধার্য্য করা হয়েছিল তিন আনা। আর গোল বা্ঁধল সেখানেই। ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থাটি জানিয়ে দিল ওই ভাড়ায় প্রকল্পটিকে বানিজ্যিকভাবে সফল করা সম্ভব নয়। এই রিপোর্ট আসার পরেই ফাইলবন্দি হয়ে যায় দেশের প্রথম টিউব রেল প্রকল্পের প্রস্তাব। ছয় দশক পরে স্যার হার্লির প্রস্তাবিত দ্বিতীয় যাত্রপথে চালু হয় কলকাতা মেট্রো। আর ২০২৫-২৬ সালে দেশে মেট্রোর রেলের একশো বছর উদযাপনের সম্ভাবনা অধরাই থেকে যায়।

প্রায় একশো বছর আগে এই কলকাতাতেই তৈরি হত দেশের প্রথম টিউব রেল। তাও আবার হুগলি নদীর নীচে টানেল তৈরি করে। পরিকল্পনাটি তৈরি করেন পরাধীন ভারতে জন্ম নেওয়া এক ব্রিটিশ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শেষে তিন আনা ভাড়ার গেরোয় আটকে গেল সেই প্রকল্প।

তথ্যসূত্র- Journal of the Institution of Civil Engineers, The Telegraph, 23.08.2014, The Times of India, 05.02.2020

বিশেষজ্ঞের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া

More Articles