ভাংয়ের নেশায় ভাংচুরে ধর্মপালন

Holi 2025: ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার রঙ কেমন? লাখ লাখ শূন্যপদে নিয়োগ না হওয়া কোটি কোটি বেকারের উৎকণ্ঠার রঙ?

অফিসে ওভারটাইম, বসের ঝাড়, নিত্যদিনের ট্রেন লেট, ইএমআইয়ের টেনশন। বাড়ি ফিরে টিভি ডিবেটে একঘেয়ে হিন্দু-মুসলমান, হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে জাল ইতিহাস, বন্ধুদের ধর্মের ষাঁড় হয়ে ওঠা— এসব থেকে কোথাও পালানোর ফুরসত নেই। দমবন্ধ চারপাশে সুর বেজে ওঠে,

"বেরঙ সি হ্যায় বড়ি জিন্দেগি
কুছ রঙ তো..."

সত্যিই যদি জীবনে এমন রঙের অভাব হয় তবে গো অ্যাজ ইউ লাইকে একবেলা অমুক নেতাটির মতো হয়ে যাওয়া যায়৷ এত রঙ আর কোথায়? যেমন নেতা তেমনই বাহারি আদর্শ৷ 'দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না' বলতে বলতে কেউ কেউ এই ডালে ওই ডালে ঘুরে বেড়ান৷ কখন কোন দলে আছেন বলা মুশকিল, কিন্তু কোন্দলে আছেন! না, কোনও মানুষকে বিশেষ প্রজাতির সরীসৃপের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না৷ হাজার হোক মানুষ তো! তায় দেশোদ্ধারে নেমেছেন।

কারও কোনও বিশেষ ক্ষমতা থাকলে সেটার প্রশংসা করাই সমীচীন হবে৷ এঁরা আশ্চর্য সুপারপাওয়ার নিয়ে জন্মেছেন৷ মার্ভেল কমিকসে এঁদের জায়গা হলে ‘গিরগিটিমানব’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হতেন৷

কেউ কেউ এতবার রঙ বদলেছেন যে তাঁদের রামধনু নেতা বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ কেউ হাফ নেতা, হাফ অভিনেতা। সাদা-কালোয়, মন্দ-ভালোয় তাঁদের কোনটা সত্যি, কোনটা নাটক বোঝা দায়। এতটাই আদর্শবান যে গণতন্ত্রের বাজারে নাদুসনুদুস গুজরাতি ফেরিওয়ালার হাঁকে বিকিয়ে যান! "লাল-নীল-সবুজ কোনটা চাই?" যেটার কাটতি ভালো, সেই রঙে রাঙিয়ে নেওয়ার এই অভিযোজন ক্ষমতা এঁদের দেশপ্রেমের আদর্শ সৈনিক করে তোলে। তখন পেট্রোলের দাম নিয়ে প্রশ্ন করলেই সহনাগরিককে বলে দিতে পারেন, "পাকিস্তানে যাও।"

কিংবা ধরুন সেই সাংবাদিক, যিনি আশ্চর্য ক্ষমতা পেয়েছেন৷ ইনকিলাব বললেই যাঁর চেতনার রঙ টকটকে লাল হয়ে যেত, এখন হাম্বা বললেই রঙ গেরুয়া! ভাষ্য বদলে যায় রঙ বদলে যাওয়ার মাধ্যমেই৷ তাহলে কী বুঝলেন মশাই? ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ রঙবদল৷ রঙের মাঝেই লুকিয়ে আছে সব রংঢং! বাইরে সবুজ ভিতরে স্মৃতিমেদুর লাল৷ বাইরে বনেদি লাল ভিতরে তীব্র জাতীয়তাবাদী গেরুয়া। এমন কত শত কালার কম্বিনেশন৷ কত সম্ভাবনার সমীকরণ।

আরও পড়ুন-শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব আস্ত এক ব্যাধি এখন

এই যে মশাই! আপনার প্রাক্তনের কথাই ধরুন, তিনি যে এমন রঙ দেখাবেন কখনও ভেবেছিলেন৷ যাঁর চোখে তাকালে ফুটে উঠত কত রঙের ফুল, দুনিয়াটাকে আশ্চর্য সুন্দর লাগত— এখন আপনার জীবন সাদাকালো টিভিস্ক্রিন হয়ে গেছে। তাই বলে দুক্ষু করবেন না মশাই, জীবনে রঙ চেনানোর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধন্যবাদ দিন। মনে রাখবেন, "রঙের আমি রঙের তুমি রঙ দিয়ে যায় চেনা।" সময়ে রঙ না বুঝলেই ফেঁসেছেন কত্তা। এখন মানুষ চিনতে হয় রঙ দেখে! আচ্ছা, এসব ছেঁদো কথা ছেড়ে আসল কথায় ফেরা যাক, কারণ এখানে উন্নয়ন মানে নীলসাদা লেপে দেওয়া, অব্যবস্থা ঢাকার শেষ আশ্রয় গেরুয়া। সংখ্যালঘুকে ল্যাজে খেলানোর রঙ ভোটের আগে টুপি-দাড়ির মাঝে একটু সবুজের ভাইচারা! সাম্প্রদায়িক নেতা রঙ বদলে নিলেই টুপি পরে সুশীলবাবু।

কিছু দেখনদারি বিপ্লবের বহিঃপ্রকাশও লাল। গ্রামে গ্রামে জনসংযোগ? জরুরি ইস্যু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া? সে বাস্তবতার রঙ বড় করুণ৷ পলাশ ফোটার সঙ্গে বিপ্লব জুড়ে দিয়ে সময়ের ভরসায় বসে থাকা। মরশুম শেষে জনতার চোখে শেষ পর্যন্ত সর্ষেফুলই জোটে। শ্রমিক-মজদুরের রক্ত ঘাম করা পরিশ্রমের সঠিক মজুরি, ফসলের ন্যায্য দাম জুটবে— মলিন নিশানের দিকে তাকিয়ে কেউ তো এখনও স্বপ্ন দেখেন।

রঙের রাজনীতি না হয় হলো, রঙের অর্থনীতি বোঝেন? মানে কিছু বেচতে হবে তাই তো! দিন, গেরুয়া সেন্টিমেন্ট উস্কে দিন৷ একটু ভ্রান্ত দেশপ্রেমের রঙ ছেটান। সেনাদের সিয়াচেনে পাহারা দেওয়ার ব্যাপারটা মেশান। দেখবেন তেল থেকে রেল, সব সহজে বিকিয়ে যাবে৷ গেরুয়ার জাদু যোগ থেকে ভোগ, সবেতেই কার্যকর। তখন বাবাজির টুথপেস্টে আমিষ থাকলেও ‘কুছ পরোয়া নেহি’। স্বদেশি প্রোডাক্টে ভেজালের খবরেও ‘সব চাঙ্গাসি৷’ বন থেকে পাহাড়, সব হাওয়া৷

নতুন হাওয়ায় বদলা নয় বদলের স্লোগানে একদিন সুশাসনের সবুজ লেপে দেওয়া হয়েছিল বাংলায়। এখন সেই রঙে রঙবাজিই বেশি৷ দুর্নীতির রঙও নানারকম৷ কয়লা কালো, শিক্ষাও অন্ধকারে৷ দুর্নীতির চাল-ডাল-চাকরি-গরু সব কিছুই নিজ নিজ রঙে অনন্য৷ এমনকী খেলা-মেলা-মোচ্ছবের বঙ্গদেশে বিদ্বজ্জনের রঙ চাটুকারিতা। প্রতিবাদীর পিঠে পুলিশের লাঠির রঙ— সে তো আইনেরই শাসন।

সেবার এক কাণ্ড হয়েছিল মাইরি! কালো টাকা খুঁজতে গিয়ে নোটবাতিল। নোট বদলাতে গিয়ে পঞ্চাশের উপর লোক মোক্ষলাভ করল। সেখানেও কত রঙ। বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান, নানা প্রদেশের৷ তাঁদের আত্মত্যাগের রঙ ভুলিয়ে দিয়েছে ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমির ফাঁকা আওয়াজ। মার্কেটে নতুন নোট আমদানি হলো। তারপর গোলাপি দুই হাজারের নোটের এত জালিয়াতি হতে লাগল যে নোট তুলে নিতে হয়েছে সরকারকে। না এল কালোধন, অর্থনীতির ব্যর্থনীতিতে পাবলিক এখন হারাধন!

বিশ্বগুরু হওয়ার স্বপ্নে জিরিয়ে নিচ্ছিলুম। কারা দেখি সুর তুলেছে, "শুধু গেরুয়াই থাকবে।" সুর তো নয়, হুঙ্কার! এই হুকুমে বাজার শুধুই কমলালেবু আর গাজরময়৷ কুমড়ো আছে কিছু। বাকি সব সবজি উধাও!

গৃহিণীদের মাথায় হাত! এখন কী রাঁধা হবে? নাগপুরি কমলালেবুর কোপ্তা!

গেরুয়ামোড়া এমন চৌকিদারির স্বপ্নসাম্রাজ্যে রবি ঠাকুরের কবিতা এডিট করে লেখা হয়েছে, "ওরে গেরুয়া, ওরে আমার কাঁচা।"

স্বপ্ন ভেঙে দেখলুম, না এখনও হয়নি। কিন্তু চেষ্টা তো চলছেই।

আরও পড়ুন-বেড়া ভাঙার কথা বলে বৃন্দাবনের বিধবা দোল

অমৃতকালে বাবাদের বাড়বাড়ন্ত। অমুক আখড়া, তমুক ধাম। বোকা বানানো, মহৎ কাম! বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি রাখেনি সরকার৷ ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেকারত্বের গুঞ্জন চারিদিকে৷ গোবলয়ের এক চাকুরিপ্রার্থী ভেবেছিল রাম মন্দির হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তেমনই তো নাগপুরি পাঁজিতে লেখা ছিল। অনেক চেষ্টার পর যখন কিছুই হলো না, চাকুরিপ্রার্থী গেল বাবার আখড়ায়। বেশ ব্যথিত হয়ে জানাল, "বাবাজি কিছুতেই চাকরি হচ্ছে না, কী করি?"

বাবাজি ত্রিকালঅজ্ঞ, কিন্তু বিজ্ঞ সেজে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুই কী রঙের জাঙ্গিয়া পরিস?"

"বাবা, নীল রঙের৷"

"তুই এবার থেকে অমুক রঙের চাড্ডি পরবি, দেখবি বেকারত্ব আর বেকারত্ব মনে হবে না। খুব চাপ হলে মোড়ের মাথায় জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম বলে চেঁচাবি। উপশম হবে।"

এও এক আশ্চর্য রঙের খেলা। ঠিকঠাক মন্ত্র দিয়ে হিপনোটাইজ করে দিলে মানুষ সব ভুলে যায়৷ সোচ্চারে বলে, ‘আধা রোটি খায়েঙ্গে…’

আচ্ছা ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার রঙ কেমন? লাখ লাখ শূন্যপদে নিয়োগ না হওয়া কোটি কোটি বেকারের উৎকণ্ঠার রঙ? জাতপাতের কারণে পিটিয়ে মারা যুবকের লাশের রঙ কি শেষ পর্যন্ত নীল হয়ে যায়? রাষ্ট্র জানে! খোঁজ রাখে?

নগ্ন বাস্তবের তুলিতে এই ভারত ভূখণ্ডের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে বিক্ষিপ্ত রঙ। অপুষ্টি, অভুক্ত থাকা কিংবা মূল্যবৃদ্ধি! ধর্ষণের অপরাধীকে বেকসুর খালাস করে গেরুয়া তিলকে বরণ করা! জুমলার রঙ, রাষ্ট্রের কোণঠাসা করার রঙ? স্মার্ট সিটি, বুলেট ট্রেন, স্বচ্ছ গঙ্গার গল্প শুনিয়ে শাসক যে সর্বত্র ভেদাভেদের রঙ দেখায় সেই রংতামাশাই কি আমাদের ভবিষ্যত?

বিনা চিকিৎসায় মৃত শিশুর মায়ের কান্নার রঙে যে জলছবি, তার ঢেকে দেয় মিডিয়ার রঙচঙে প্রোপাগান্ডা। মিথ্যের জমকালো ন্যারেটিভ রঙে সত্যি ঢেকে দেওয়া। এও পোষ্যদের প্রাইমটাইমে নিত্য হোলি খেলা।

আচ্ছা, ঘৃণার রঙটাই বা যেন কেমন? বিদ্বেষপন্থীরাই ভালো জানে৷ রাস্তাঘাটে-বাসে-ট্রেনে অনেকের চোখে এখন ঘৃণার চশমা৷ বর্ণান্ধতা ভালোবাসার রঙ চিনতে দেয় না। রঙ দিয়ে মানুষের ভাগবাঁটোয়ারা অনেকটা এগিয়েছে৷ এর মধ্যে আরও একটা ইতিবাচক খবর! শুনলুম, দোলের দিন সংখ্যালঘুর ধর্মস্থল ঢাকা হয়েছে নানা রঙের ত্রিপলে। শুধু এতেই ক্ষান্ত হওয়া যায়নি। রঙ ছিটিয়ে মসিজিদের সামনে হল্লা, আস্ফালন। ভাংয়ের নেশায় ভাংচুরে ধর্মপালন। অভূতপূর্ব সম্প্রীতির নিদর্শন৷ একটু অন্যভাবে বলা, "বুরা না মানো, হোলি হ্যায়৷" শ্যাম কি আমার এভাবেই হোলি খেলতেন? পুরাণ কী বলছে?

কাণ্ড দেখে নজরুল ইসলাম গেয়ে উঠছেন,

"আজি মনে মনে লাগে হরি
আজি বনে বনে জাগে হরি।"

এত ভক্তি-ভালোবাসা বিদ্রুপের মতো শোনাচ্ছে কেন!

More Articles