আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা, বীরভূমের সোনালি খাতুনকে যেভাবে বাংলাদেশে ঘাড়ধাক্কা
সোনালির পরিবারের অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করানোর সময় তাঁদের চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। বন্দুক তাক করে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, ফিরলেই গুলি করা হবে।
আট মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে বাংলাদেশি সন্দেহে প্রথমে আটক তারপর ঘাড়ধাক্কা। চোখে কাপড় বেঁধে রাতের অন্ধকারে সোজা বাংলাদেশ। বীরভূমের পাইকর গ্রামের মেয়ে সোনালি খাতুন কি সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারবেন? মিসক্যারেজ হবে না তো? জীবনপ্রান্তে উপনীত সোনালির হতদরিদ্র বাবা ভাদু শেখ পাইকরের ভাঙাঘরের দাওয়ায় বসে এই প্রশ্নগুলির সঙ্গেই লড়াই করছেন।
৩০ বছর দিল্লিতে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন ভাদু শেখ। বয়সজনিত কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। তাই ফিরে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে, বীরভূমের পাইকরে। তবে দিল্লিতেই বসবাস করছিলেন তাঁর মেয়ে সোনালি খাতুন। দিল্লিরই বাসিন্দা দানিশ শেখের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামী স্ত্রী থাকতেন দিল্লির রোহিনী এলাকার ২৬ সেক্টরে।
সোনালি খাতুনের বাবা-মা
গত ১৮ জুন দিল্লির কে.এন কাটজু মার্গ থানার পুলিশ তাঁদের আটক করে। ভারতীয় নাগরিকের পরিচয়পত্র দেখালেও পুলিশ তাঁদের বাংলাদেশি সন্দেহে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। তারপর মেহেদি সীমান্ত দিয়ে ‘ঘাড়ধাক্কা’ দেওয়া হয় বাংলাদেশে। সোনালির পরিবারের অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করানোর সময় তাঁদের চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। বন্দুক তাক করে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, ফিরলেই গুলি করা হবে। এক কাপড়েই বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় সোনালি খাতুন, দানিশ শেখ (২৯ বছর বয়স) এবং তাঁদের আট বছরের ছেলে সাবির শেখকে।
আরও পড়ুন- মুম্বই থেকে খেদিয়ে বাংলাদেশ! কী ভাবে ঘরে ফিরলেন নাজিমুদ্দিন?
শুধু সোনালির পরিবারই নয়, একই সঙ্গে খেদানো হয়েছে পাইকরেরই বাসিন্দা, সোনালির বান্ধবী সুইটি বিবিকে (৩৩ বছর বয়স)। সুইটির স্বামী অকালপ্রয়াত। তাঁর সঙ্গে রয়েছে দুই সন্তান ১৬ বছর বয়সি কুরবান শেখ ও ৫ বছর বয়সি ইমান। বীরভূমের পাইকরে সুইটির মা একা মেয়ের অপেক্ষায় পল অনুপল জেগে আছেন।
বাংলাদেশের রাজশাহি অঞ্চলে স্থানীয়দের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সোনালিরা। এরপর মেয়েকে দেশে ফেরাতে সোনালির পরিবার যোগাযোগ করে পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সঙ্গে। বাংলাদেশে স্থানীয়দের দ্বারা দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে সোনালিদের। তাঁর পরিবারের আশঙ্কা, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এইভাবে দিনের পর দিন দুশ্চিন্তায়, অপুষ্টিতে ভুগে সুস্থ থাকতে পারবে তো? এইভাবে চলতে থাকলে সোনালির মিসক্যারেজ হওয়ার ভয় পাচ্ছে তাঁর পরিবার। সোনালির মা জ্যোৎস্না বিবি বলেন, “মেয়েটা ঈদে এল না। বোধহয় নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পাব না আর।”
আরও পড়ুন- কালিয়াচকের পরিযায়ী শ্রমিক আমির শেখকে যেভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হল
ইনস্ক্রিপ্টকে সোনালির বাবা জানিয়েছেন, “দিল্লিতে ৩০ বছর আছি। কোনওদিন এমন ঘটনা ঘটবে ভাবতে পারিনি।” ঈদের সময় সোনালির পরিবার গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিল। তাঁর এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তাঁরা। একদিকে অন্তঃসত্ত্বা সোনালির দেশে ফেরার লড়াই, অন্যদিকে মায়ের অপেক্ষায় সীমান্তের এপারে প্রহর গোনা তাঁর একরত্তি সন্তান ও পরিবারের।
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের আরিফ শেখ ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, সোনালিদের পরিবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা প্রথমে আইনি কাগজ সংগ্রহ করেন। ১৯৫২ সালের দলিল আছে সোনালির পরিবারের। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক প্রজন্ম ধরে বীরভূমের পাইকরে বাস করছেন ভদু শেখরা। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চের সাহায্যে হাইকোর্টে মামলা করেছেন ভদু শেখ। চেষ্টা চলছে সোনালিদের বাংলাদেশে থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গা সমস্যার মধ্যেই উপ্ত ছিল বাঙালি নিপীড়নের বীজ
কেন সোনালিরা বীরভূম ছেড়ে এত দূরদূরান্তে কাজে যান? স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামে তেমন জমি নেই। অন্যের জমিতে ভাগচাষী হিসেবে কাজ করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তাতে সংসার চলে না। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন একশো দিনের কাজ বন্ধ। ফলে গ্রামের পর গ্রাম খালি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের জন্যে গ্রামে বিঁড়ি বাঁধার কাজ আছে। এক হাজার বিঁড়ি বাঁধলে ২০০-২৫০ টাকা পাওয়া যায়। আর এক হাজার বিঁড়ি বাঁধতে সময় লাগে পাঁচ দিন। অর্থাৎ দিনে ৪০ টাকা আয়। ফলে ভদ্রস্থ ভাবে বাঁচার আশায় বিপদ মাথায় পাড়ি দিতে হয় ভিনরাজ্যে।
গত কয়েক মাসে ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক নিগ্রহের ঘটনা শোরগোল ফেলেছে। সেই তালিকায় উঠে এসেছে সোনালি খাতুনের পরিবারও। এখনও তাঁরা বাংলাদেশেই রয়েছেন। পর্যায়ক্রমিক এই ঘটনার আঁচ পড়েছে বঙ্গ-রাজনীতিতেও। তবে, সমস্ত রাজনৈতিক আকচাআকচির বাইরে গিয়ে দেখলে ধরা পড়বে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক বেহাল দশা আর নিজের দেশে বেনগরিক আখ্যার অপমান। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সোনালির মতো মায়েদের হেনস্থার ভয়চিত্র দেখিয়ে ভোটবাক্স ভরিয়ে আখের গোছানোর রাজনীতিকেরা কি আদৌ তাঁদের নিরাপদ বাসস্থান ও কর্মসংস্থান দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন?

Whatsapp
