হাজার বছর পুরনো কাপিসনিক সভ্যতার নতুন ইতিহাস প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কীভাবে খুঁজে পেলেন?

Cupisnique Civilization : ইনকাদের বহু আগে পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলীয় উপত্যকাগুলিতে কাপিসনিক সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালের চাভিন সভ্যতার সঙ্গে তাদের ধর্মীয় ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল। সম্প্রতি, প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখান থেকেই আবিষ্কার করেছেন, ইনকা সভ্যতারও প্রায় দুই সহস্রাব্দ আগের এক বিস্মৃত ইতিহাস-চিহ্ন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখানে খুঁজে পেয়েছেন প্রায় তিন হাজার বছর পুরনো চোদ্দটি কঙ্কাল। প্রাচীন কাপিসনিক সংস্কৃতিতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। চকমপ্রদ তথ্য হল, গবেষকরা ধারণা করছেন এই কঙ্কালগুলি সেই নরবলির শিকার। এই আবিষ্কার,  পেরুর প্রাক-হিস্পানিক সভ্যতাগুলির নৃশংস সামাজিক প্রথাগুলি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন তথ্যের দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-

খেজুর গাছে ঝুলে আছে ফাঁকা হাঁড়ি, কোথায় গেলেন বাংলার শিউলিরা?

প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরি তানতালিয়ানের নেতৃত্বে খননকারী দলটি লিমা থেকে প্রায় ৬৭৫ কিলোমিটার উত্তরে, লা লিবার্তাদ অঞ্চলের একটি সৈকতের কাছে এই কঙ্কালগুলি আবিষ্কার করে। উদ্ধারস্থানটি একটি প্রাচীন মন্দিরের নিকটবর্তী অঞ্ছলেই অবস্থিত। উল্লেখ্য, মনে করা হচ্ছে এই প্রাচীন মন্দিরটি ছিল কাপিসনিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়কেন্দ্র। ইতিহাস অনুযায়ী, এই সংস্কৃতি আনুমানিক ১৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এই অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল।

বলি দেওয়া মানুষের করোটি

প্রশ্ন হল, প্রত্নতাত্ত্বিকরা বুঝছেন কী করে যে কঙ্কালগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলিপ্রথার নৃশংস আচরণ? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেহগুলিকে যেভাবে কবর দেওয়া হয়েছে, তাতে বলিপ্রথার একটা সূত্রচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন, কিছু কঙ্কালকে বালির ঢিবির মধ্যে সাধারণ গর্তে উপুড় করে শোয়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং মৃতদেহের সঙ্গে কোনও মূল্যবান সামগ্রী বা আনুষ্ঠানিক উপহারের চিহ্নমাত্র ছিল না, যা অন্যান্য সাধারণ কবরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. তানতালিয়ান বলেছেন,

এই ব্যক্তিদের কবর দেওয়ার পদ্ধতিটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক। তাদের জীবনে তারা যে ধরনের আঘাত ও হিংস্রতার শিকার হয়েছিল এবং মৃত্যুর পরও যে-নৃশংসতার ছাপ তাদের দেহে রয়ে গেছে, তা সাধারণ নয়। মৃতদেহগুলির অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণগুলি থেকে এটি স্পষ্ট যে এটি এক ধরনের পরিকল্পিত নরংকা

বলা বাহুল্য, এই আবিষ্কার কাপিসনিক জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে নতুন ধারণার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে ঐতিহাসিকদের।

উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল

ইনকাদের বহু আগে পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলীয় উপত্যকাগুলিতে কাপিসনিক সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালের চাভিন সভ্যতার সঙ্গে তাদের ধর্মীয় ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি ইঙ্গিত দেয় যে এই সংস্কৃতিগুলিতে নরবলি ছিল ধর্মীয় আচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বলিপ্রথার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল সভ্যতার কৃষিচক্র, দেবতাদের উপাসনা এবং সে-সময়ের ব্যক্তিদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া বা ঈশ্বরের ক্রোধ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে এই ধরনের নৃশংস প্রথা পালন করা হত বলেও মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন-

আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক, শতবর্ষ পেরিয়েও যে রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে ‘মৃতের শহর’

মাচু পিচু এবং নাজকা লাইনের মতো বিস্ময়কর স্থানগুলি ছাড়াও পেরুর মাটি বহু প্রাচীন সভ্যতার উত্থান-পতনের সাক্ষী। লা লিবার্তাদ অঞ্চলে এই আবিষ্কারটি পেরুর সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক তালিকায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যুক্ত করল। প্রসঙ্গত, এই অঞ্চলে এর আগেও বিভিন্ন প্রাক-কলম্বিয়ান সংস্কৃতি, যেমন মোচে এবং চিমু সভ্যতার মধ্যেও একই ধরনের বলিদান প্রথার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে, প্রত্নতত্ত্ববিদ গ্যাব্রিয়েল প্রিয়েতোর নেতৃত্বে একটি দল চিমু সভ্যতার অন্তর্গত হুয়ানচাকিতো-লাস ইয়ামাস নামক স্থানে এক আশ্চর্য আবিষ্কার করেন। তাঁরা সেখানে প্রায় দু-শোটি লামা এবং একশো চল্লিশটি শিশুর দেহাবশেষ খুঁজে পান। বলা বাহুল্য এরাও বলিপ্রথারই শিকার। এবং এই আবিষ্কার আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম শিশু বলিদানের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।এরপরে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জানা যায় যে, মোচে সভ্যতার মানুষেরা তাদের অভিজাত পরিবারের সদস্যদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় নিকটাত্মীয়, এমনকি কিশোর-কিশোরীদেরও বলি দিত।

কাপিসনিক সভ্যতার এই বলিপ্রথার আবিষ্কার শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি প্রাচীন আন্দিয়ান সভ্যতাগুলির অন্ধকার দিকটিকেও তুলে ধরে। এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে ক্ষমতা, ধর্ম এবং প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নামে মানুষ কতটা নৃশংস হতে পারে। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে, মাটির নিচ থেকে উঠে আসা এই কঙ্কালগুলি এক নীরব অথচ জোরালো ভাষায় তাদের সময়ের গল্প বলে চলেছে, যা আমাদের বর্তমানকে অতীতের আয়নায় নতুন করে দেখতে শেখায়।

More Articles