রুপোর মুদ্রা থেকে কীভাবে জানা যায় ভারতীয় নারীদের সামাজিক ইতিহাস?

Ancient silver coins of India : সাতবাহন বংশীয় আধিকারিকদের স্ত্রীরা স্বামীদের মতো একই প্রশাসনিক পদবি ধারণ করতেন এবং বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতেন।

সাতবাহন বংশীয় রানি নগনিকার নামাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ ঘটনা! এটিই ছিল প্রথম কোনো ভারতীয় রানির নামাঙ্কিত মুদ্রা! এই মুদ্রায় নগনিকার নাম তাঁর স্বামী রাজা সাতকর্ণীর নামের ওপরে ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত, এই নিদর্শন প্রাচীন ভারতের নারীর ক্ষমতায়নের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এটাই প্রমাণ করে নগনিকা ছিলেন সম্রাজ্ঞী।ভারতের নানেঘাট অঞ্চলের কাছে জুনার এলাকায় গুহায় খোদিত শিলালিপিতে এ-ধরনের মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। শিলালিপি অনুসারে বিভিন্ন যজ্ঞ উপলক্ষ্যে মুদ্রা তৈরি হত। ওই শিলিলিপি অনুসারে, রাজা সাতকর্ণীর আদেশে সম্ভবত অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষ্যে রাজা সাতকর্ণী ও রানি নগনিকার নামে মুদ্রা তৈরি করা হয়।

নগনিকা ছিলেন নানেঘাট শিলালেখর (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের মধ্যবর্তী)রচয়িতা। এই শিলালেখে সাতবাহন বংশীয় সাতকর্ণী রাজার স্ত্রী নগনিকা প্রশাসকরূপে উল্লিখিত হয়েছেন। সাতবাহন বংশের উত্তরাধিকার ক্রমে তৃতীয় রাজা হলেন সাতকর্ণী। এই শিলালেখে সাতকর্ণী 'দক্ষিণাপথের প্রভু'-রূপে উল্লিখিত হয়েছেন। জর্জ ব্যুহলারের মতে, নানেঘাট শিলালিপি পশ্চিম ভারতের সর্বপ্রাচীন নিদর্শনগুলোর অন্যতম। ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত এই শিলালেখটিতে নগনিকা ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে অনেক তথ্যবহুল বিবৃতি পাওয়া যায়। এখানে বৈদিক দেবতা যম, ইন্দ্র, চন্দ্র এবং সূর্যের উল্লেখ আছে। তাছাড়া এই শিলালেখে সংকর্ষণ ও বাসুদেবের উল্লেখ বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য প্রকাশ করে। এতে গণেশের সুন্দর গুহামন্দিরের কথা পাওয়া যায়। এই শিলালেখটি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করে।

প্রাচীন রুপোর মুদ্রা

নানেঘাট শিলালেখ থেকে জানা যায় নগনিকা বেশ কয়েকটি যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন, যে-যজ্ঞগুলো ধর্ম শাস্ত্রিক নিয়মের ব্যতিক্রমীরূপে লক্ষিত হয়। কারণ সে-যুগে নারীর একাকী যজ্ঞ সম্পাদনের অধিকার ছিল না। সাতবাহন বংশীয় আধিকারিকদের স্ত্রীরা স্বামীদের মতো একই প্রশাসনিক পদবি ধারণ করতেন এবং বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতেন। 'মহাসেনাপত্নী' ও 'মহাতলবারি', এই দুটি পদবির দৃষ্টান্ত থেকে বিষয়টি প্রকাশ পায়। এই শিলালেখ থেকে একজন মহিলা দ্বাররক্ষীর দ্বারা ভূমির পরিমাপ খসড়ার দৃষ্টান্তের কথা জানা যায়। এই প্রমাণসমূহ সাতবাহন বংশের রাজত্বকালে নারীদের অধিকারের বিষয়টি সূচিত করে।

আরও পড়ুন-

কৃষ্ণনগরের মনসামূর্তির ভেতর যেভাবে বেঁচে রয়েছে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি

নানাঘাট শিলালেখতে উল্লিখিত আছে যে, প্রাচীন বাণিজ্যপথ, যেটি কল্যাণ থেকে জুন্নার পর্যন্ত প্রসারিত ছিল, তাকেই নানেঘাট বলা হত। এই পথে সাতবাহনবংশীয়রা শুল্ক সংগ্রহ করতেন। বাণিজ্যিক বন্দরের মাধ্যমে রোমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করায় সাতবাহনবংশীয়দের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বাণিজ্যিক পথ সুগম হয়।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বৈবাহিক সূত্র ধরে সাতবাহনদের শাসনক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছিল এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। নগনিকা যে-বংশের কন্যা ছিলেন, তাঁরা যোদ্ধা হিসাবে মহারাষ্ট্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন। অতএব এই বিবাহ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সাতবাহন বংশের রাজারা স্বনামের পূর্বে মায়ের নাম যুক্ত করতেন। যেমন, গৌতমী পুত্র সাতকর্ণী। এরকম আর একটি দৃষ্টান্ত, বশিষ্টি পুত্র শ্রীপুলমাবি। এই উদাহরণগুলিও প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে নারীর ক্ষমতায়নকে সূচিত করে।

আরও পড়ুন-

ভারতের প্রাচীন ‘পচিসি’ থেকেই লুডো খেলার উৎপত্তি?

লিচ্ছবি রাজদুহিতা কুমারাদেবী প্রথম চন্দ্রগুপ্তকে বিবাহ করেছিলেন। কুমারাদেবীর প্রশাসনিক ক্ষমতা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। গুপ্তযুগের শিলালেখগুলিতে কুমারাদেবী ব্যতীত অন্য কোনো রানির পিতৃবংশের উল্লেখ পাওয়া যায় না। লিচ্ছবির সঙ্গে গুপ্তরাজাদের সুসম্পর্ক ও যোগাযোগের কারণে কুমারাদেবীর সঙ্গে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বিবাহটি ছিল সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ।

গুপ্তযুগে প্রাপ্ত বিভিন্ন মুদ্রার মধ্যে এক ধরনের ব্যতিক্রমী মুদ্রা পাওয়া যায়, যেটা হল রাজা-রানির নাম লেখা মুদ্রা (King-Queen type of coin)। মহারাজাধিরাজা চন্দ্রগুপ্ত প্রথম নিজের নামের সঙ্গে তাঁর রানি কুমারাদেবীর নামও অঙ্কিত করে এই মুদ্রা প্রচলন করেন। কোনো-কোনো ঐতিহাসিকদের মতে সমুদ্রগুপ্ত পিতা-মাতার প্রতি সম্মানার্থে স্বর্ণমুদ্রায় পিতা ও মাতার প্রতিকৃতি মুদ্রিত করেছিলেন, যেখানে দু-জনকে যৌথ শাসকরূপে দেখা যায়। এই মুদ্রায় কুমারাদেবীর নামটি প্রথম চন্দ্রগুপ্তের নাম দ্বারা অধিকৃত স্থানের সমপরিমাণ স্থান অধিকার করে আছে। মুদ্রার একপাশে দেখা যায় সুসজ্জিত রাজকীয় বেশে রাজা রানি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন এবং রাজা রানিকে আংটি বা সিঁদুরদানি ধরনের কিছু একটা প্রদান করছেন। মুদ্রার অপর পিঠে অঙ্কিত আছে সিংহের ওপর এক দেবীর ছবি ও লিচ্ছবি নামটি, যা গুপ্তদের শাসন ও ক্ষমতা প্রসারে লিচ্ছবির প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ.এস.আলতেকারের মতে, সম্ভবত রাজা-রানি দুজনে যৌথভাবে সাম্রাজ্য চালাতেন, তাই মুদ্রায়ও দু-জনকে সমগুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর বই 'Coinage of the Gupta Empire' এ-বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এই বিয়ের মাধ্যমেই চন্দ্রগুপ্ত 'মহারাজাধিরাজা' হয়ে উঠেন।

ধ্রুবদেবী ছিলেন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রানি এবং প্রথম কুমারগুপ্তের মা। কিছু ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি সম্ভবত 'ধ্রুবস্বামিনী' নামেও পরিচিত ছিলেন। বিশাখ দত্তের 'দেবীচন্দ্রগুপ্তম্' গ্রন্থে উল্লিখিত হয় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্ত্রী ধ্রুবদেবীও একজন সম্রাজ্ঞী ছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ধ্রুবদেবী গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন তাঁর সাহস ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার জন্য। তিনি কোনো প্রসাশনিক পদে না-থেকেও গুপ্ত রাজবংশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরোক্ষভাবে হলেও প্রভাবিত করতেন। প্রথম কুমার গুপ্তের বিলসাদ স্তম্ভলিপিতে মহাদেবী ধ্রুবদেবী এবং বৈশালীর টেরাকোটা শীলমোহরে মহাদেবী ধ্রুবস্বামিণীর উল্লেখ রয়েছে।

More Articles