নিঃশব্দে কোটি কোটি কৃষকের কাঁধে যে জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া হল

"কৃষকরা দেশের অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই কৃষক ভগবানের পরেই তাকিয়ে থাকেন সরকারের দিকে। আমাদের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যাতে ওনারা ভালো থাকেন। আমি সমস্ত রাজ্য সরকারগুলিকে বলছি, আপনাদের যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, আপনারা সেটা যদি ঠিক মতো কার্যকর করেন তাহলে আমাদের এবং আমাদের কৃষক ভাইদের স্বপ্ন পূরণ হবে। ২০২২ সালে ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উদযাপন করবে। আমি কথা দিচ্ছি, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করব।"

- নরেন্দ্র মোদি, বরেলি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬।

ছয় বছর, কিসান র‌্যালি এবং গত পয়লা ফেব্রুয়ারিতে পেশ হওয়া বাজেটের মধ্যের ব্যবধান। এই ছয় বছরে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দেশ দেখেছে নজিরবিহীন আন্দোলন, তা নাসিক থেকে মুম্বই পর্যন্ত দশ হাজার কৃষকের পদযাত্রাই হোক, বা দেশের রাজধানীর সীমান্তে মাসের পর মাস ধরে কৃষকদের অবস্থান বিক্ষোভ। শুধু তাই নয়, এই সরকারকে মাথা ঝোঁকাতেও বাধ্য করেছেন কৃষকরা। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছে সরকার।

এবারের বাজেটে তাই সবার নজর ছিল কৃষির দিকে। সরকার কি প্রতিশোধ নেবে নাকি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে কৃষকদের ঝুলি উপুড় করে উপহার দিয়ে খুশি করবে? আসুন আগে ছোট্ট করে দেখে নি বাজেটে কৃষকরা কি পেলেন?

আগামী অর্থ বছরে কৃষকদের সস্তায় সুদে ভর্তুকি দিয়ে ১৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ বিলির ঘোষণা করা হল। এমএসপির জন্যে বরাদ্দ হল ২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা, গত বছরের থেকে এগারো হাজার কোটি কম। দেশে রাসায়নিক কীটনাশক-মুক্ত প্রাকৃতিক চাষের ওপর জোর দেওয়া হবে। প্রথম দফায় গঙ্গা নদীর দু’ধারে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় চাষিদের জমিতে এই প্রাকৃতিক চাষে জোর দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন-জীবনযাপনে ছোট্ট বদল, আমার আপনার থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচেন জাপানিরা

কৃষিকাজে আরও সুবিধার জন্য কিষাণ ড্রোন ব্যবহার করে শস্য চাষের এলাকার মূল্যায়ন, ভূমির খতিয়ানের ডিজিটাইজেশন, কীটনাশক ছড়ানোর মতো কাজ করা হবে।

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি পাঠ্যক্রমে বদল আনা হবে। এর ফলে পড়ুয়ারা আধুনিক এবং জিরো বাজেট কৃষির ব্যপারে জানতে পারবেন।

তৈলবীজ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে প্রকল্প আনবে সরকার। দেশেই যাতে বেশি পরিমাণে তৈলবীজ উৎপাদন করা যায়, তার ব্যবস্থা করা হবে।

এবার  কৃষিতে ব্যবহার হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ নিয়ে সরকার কী ভাবছে দেখা যাক।

সরকার বলছেন, রাসায়নিক মুক্ত কীটনাশক ও সারের ব্যবহারে তারা জোর দিতে চান। সেই কারণেই কি ইউরিয়ার ওপর ভর্তুকি সতেরো শতাংশ কমে ৬৩২২২.৩২ কোটি হয়ে গেলো? এনপিকে সারেও ৩৫ শতাংশ বরাদ্দ কমে ভর্তুকি দাঁড়ালো ৪২ হাজার কোটি টাকায়।

এমন সময়ে সারে ভর্তুকি কমালেন সরকার যখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম চড়া এবং সেই কারণে নিয়মিত যোগান পাচ্ছেন না চাষিরা। ইন্টিগ্রেটেড ফার্টিলাইজার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের দেওয়া তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে আমাদের দেশের চাষিরা সারের অভাবে চরম বিপদে পড়েছেন। এমন কি, বুন্দেলখন্ড অঞ্চলে পাঁচ কৃষক সারের অভাবে ঠিক ভাবে চাষ করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন বলেও খবর এসেছে। সার ঠিক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন-শুধুই কি প্রার্থী তালিকা ‘ফাঁস’? প্রশান্তকিশোর-মমতার তিক্ততার আসল কারণটা কী?

আমরা এই বিষয়ে কথা বলেছি সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা রানার্স সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নীলাঞ্জন মিশ্রর সঙ্গে। আমরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম সারের ভর্তুকি কমে যাওয়া, এবং তার ফলে কৃষকরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে? নীলাঞ্জন বলেন, "আমি শুরুতেই একটা কথা বলতে চাই। গোটা দেশ জুড়েই এই ইউরিয়া এক বড় কালপ্রিট। মাটির কার্বন নাইট্রোজেন অনুপাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং মাটিতে যতো বেশি কার্বন থাকবে তত ভাল। এই অনুপাতের কথা না ভেবে যথেচ্ছ ইউরিয়ার ব্যবহার কাজের কথা নয়। জমির প্রকৃতি বোঝা প্রয়োজন, প্রয়োজন বোঝা কত টুকু রাসায়নিক সার দিলে যথেষ্ট। এবার কিছু জিনিষ বুঝতে হবে। এই রাসায়নিক নির্ভরতা তো একদিনে গড়ে ওঠেনি, আর সরকার আজ বলছেন রাসায়নিক এর প্রভাব কমাতে হবে, কিন্তু তার জন্যে পরিকাঠামো কোথায়? আজ দেশের বেশিরভাগ কৃষক রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। সেই সাথে তারা মূল্যবৃদ্ধির শিকার। একেই তাদের দেনার শেষ নেই, বীজের দাম বেশি, কীটনাশকের দাম বেশি, এখন যদি সারের দাম ও বারে, তাহলে আরো বেশি কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নেবেন।"

এছাড়াও, আজ সারের দাম বেড়ে গেলে কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে, তার বোঝা আসবে সাধারণ মানুষের ওপর, এবং আরো খারাপ বিষয় হল, আমাদের দেশে বেশিরভাগ কৃষক সঠিক দাম পাচ্ছেন না। শুধু রাসায়নিক সারের ভর্তুকি বরাদ্দ কমেনি, কমেছে প্রধানমন্ত্রীর আশা, এমআইএস এবং পিএসএস এবং মনরেগা প্রকল্পেও। ২০১৪ ও ২০১৫-র খরার ধাক্কা এখনও পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেননি কৃষকরা। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন খোলা বাজারের প্রতিযোগিতার দিকে কৃষকদের আরও বেশি করে ‘এগিয়ে দেওয়ার’ কথা বলেছেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধিতে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে খুবই সামান্য, সুতরাং অনুদানের দ্রুত সম্প্রসারণের আশা নেই। শুষ্ক অঞ্চলে সেচের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা’ এই বছর অনুল্লিখিত আছে, গত বছরের বরাদ্দ চার হাজার কোটি টাকার অর্ধেক ও খরচ হয়নি।

কৃষিখাতে বরাদ্দ চলতি বছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ ছিল ১.৩৯ লক্ষ কোটি। আগামী অর্থবর্ষের জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১.৪৩ কোটি। মূল্যবৃদ্ধির চড়া হারের সামনে এইটুকু বৃদ্ধি ঠিক কী ভাবে কৃষকদের হাল ফেরাবে তা কারোর জানা নেই।

নীলাঞ্জন আরো বলছিলেন, অনেকেই চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন, নতুনরাও কৃষিতে আগ্রহী নন। কেনই বা হবেন? চাষবাস চূড়ান্ত অলাভজনক হয়ে উঠছে, শয়ে শয়ে কৃষক আত্মহত্যা করছেন। আপনি কখনও এমন পেশা বাছবেন যাতে মানুষ খালি কষ্ট পায়? মৃত্যু বেছে নিতে হয়? সরকারের দাক্ষিণের ভরসায় বেঁচে থাকতে হয়? না হচ্ছে পরিকাঠামোর উন্নতি, না হচ্ছে বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি, ড্রোন ওড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সেই পরিষেবা দেশের প্রান্তিক চাষিরা কী ভাবে পাবেন তার কোনো দিশা দেওয়া হচ্ছেনা। কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ও খুব একটা উন্নতি হয়েছে বা হওয়ার আশা দেখা দিচ্ছে এমনটাও বলা যাবেনা 

সুতরাং আপনাকে আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। কোন জাদুবলে সরকার কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করেন তা দেখার জন্যে।

More Articles