ভারতের ব্রহ্মাস্ত্র সুদর্শন চক্র! পাক হামলা রোধে কীভাবে কাজ করে এই S-400?

S-400 missile system: S-400 ট্রায়াম্ফ (নেটো নাম SA-21 Growler) হলো বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও কার্যকর বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

এক শ্রান্ত বিকেলের নিস্তব্ধতা ভেঙে যখন পহেলগাঁওয়ের মাটিতে একের পর এক গুলিবর্ষণ ঘটতে শুরু করল, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এই হামলা শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন জঙ্গি আক্রমণ নয়, বরং এক বৃহৎ সামরিক মঞ্চের সূচনা। দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগাঁও উপত্যকায় নিছক ছুটি কাটাতে আসা নিরীহ নাগরিকরা যখন আতঙ্কে প্রাণ হাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, ঠিক তখনই ভারত বুঝে নেয়— এটি নিছক সীমান্ত লঙ্ঘন নয়, এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত পাকিস্তানের পরিকল্পিত আক্রমণের সূচনামাত্র। নিরস্ত্র পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো এই গণহত্যার পর শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও উঠেছিল একটাই প্রশ্ন—কতকাল ভারত সহ্য করবে পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ জঙ্গি সংগঠনগুলোর এহেন উন্মত্ততা? এরপরই ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে— ‘অপারেশন সিঁদুর’।

অপারেশন সিঁদুর ছিল ভারতীয় সেনার এক কৌশলগত পাল্টা প্রতিক্রিয়া, যেখানে নেতৃত্ব দেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। এই অভিযানের নামকরণে যেমন ছিল নিহত পুরুষ পর্যটকদের স্ত্রীদের জন্য প্রতীকী বার্তা, তেমনই অন্যদিকে পাকিস্তানের দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ভেঙে ভারতীয় সাম্য ও সংহতির আদর্শকে সামনে আনার বার্তাও। এই অপারেশনে একাধিক সীমান্তবর্তী এলাকা, পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামো এবং ঘাঁটিগুলি নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে ধ্বংস করা হয়। কেবলমাত্র সামরিক পাল্টা-আঘাত নয়, এই অপারেশন ছিল প্রতিবেশীকে এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া।

এই প্রতিক্রিয়া পর্বে আরও এক নাটকীয় পালাবদল ঘটে যখন পাকিস্তান রাতের অন্ধকারে ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১৫টি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমানহানা চালায়। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর লক্ষ্য ছিল— অবন্তীপোরা, শ্রীনগর, জম্মু, পাঠানকোট, অমৃতসর, কাপুরথলা, জলন্ধর, লুধিয়ানা, আদমপুর, ভাটিণ্ডা, চণ্ডীগড়, নাল, ফালোদি, উত্তরলাই ও ভূজের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক ঘাঁটি। এটি নিছক প্রতিশোধ নয়, এক ধরনের বেপরোয়া আগ্রাসন ছিল যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই আকাশে জ্বলে ওঠে ভারতের সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা অস্ত্র— রাশিয়ান প্রযুক্তি নির্ভর এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ।

আরও পড়ুন- সিঁদুরে ধ্বংস জৈশ প্রতিষ্ঠাতার পরিবার! মুছে গেল মাসুদ আজাহারের নামও?

‘সুদর্শন চক্র’ নামে ভারতীয় বায়ুসেনার অন্তর্ভুক্ত এই এস-৪০০ ব্যবস্থা ছিল যেন এক বর্ম, যা শত্রুপক্ষের বিমান, ড্রোন, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইলের আক্রমণ থেকে দেশের আকাশসীমাকে রক্ষা করে। পাকিস্তানের এয়ার স্ট্রাইক প্রতিহত করতে এটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, তা ভারতীয় প্রতিরক্ষার এক নতুন যুগের সূচক। অতি অল্প সময়ে এটি মোতায়েন করা যায়, যেকোনও অবস্থানে দ্রুত সরানো যায়। পাশাপাশি, ৬০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত নজরদারি ক্ষমতা ও ৪০০ কিমি দূর থেকে শত্রু লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার ক্ষমতা—এস-৪০০-কে এক অনন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবেও প্রতিষ্ঠা করে।

S-400: এক আধুনিক বর্ম

S-400 ট্রায়াম্ফ (নেটো নাম SA-21 Growler) হলো বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও কার্যকর বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। রাশিয়ার আলমাজ সেন্ট্রাল ডিজাইন ব্যুরো এটি তৈরি করে এবং ২০০৭ সালে এটি রুশ সেনাবাহিনীর হাতে আসে। এই ব্যবস্থা এমন এক প্রযুক্তিগত কৌশলের মূর্তরূপ, যা একযোগে ৩৬টি শত্রু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং ৩০০টিরও বেশি লক্ষ্য নিশানায় রাখতে সক্ষম।

ভারতে আগমন ও কৌশলগত তাৎপর্য

২০১৬ সালের ব্রিকস সম্মেলনের সময় ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ৫টি রেজিমেন্ট কেনার জন্য আন্তঃসরকারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং ভারত এই S-400 সুদর্শন চক্র মিসাইল কেনে। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পরেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র CAATSA আইনের আওতায় নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল, কারণ ভারত তাদের Patriot PAC-3-এর বদলে রাশিয়ার S-400 বেছে নিয়েছিল। তবুও ভারত তার কৌশলগত স্বার্থে অটল থেকে এই প্রযুক্তি অধিগ্রহণ করে। এই মুহূর্তে ভারতের তিনটি স্কোয়াড্রন সক্রিয় এবং বাকি দু'টি ২০২৬ সালের মধ্যে এসে পৌঁছবে।

প্রতিরোধের রাতে S-400-এর ভূমিকা

পাকিস্তানের আকাশ থেকে ছোড়া ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইল, ফাইটার জেট এবং ড্রোনকে প্রতিহত করতে সিঁদুর অভিযানের ঠিক পরের রাতে ব্যবহৃত হয় S-400। বহুক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস হয়েছিল ভারতের আকাশসীমায় ঢোকার আগেই। সিস্টেমের 92N2E ‘Grave Stone’ ট্র্যাকিং রাডার এবং 96L6 ‘Cheese Board’ সার্ভেইলেন্স রাডার ৬০০ কিমি দূর থেকেও লক্ষ্য শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এর মোবাইল লঞ্চার ও কমান্ড সেন্টার মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে মোতায়েন হতে পারে।

ক্ষেপণাস্ত্রের স্তরবিন্যাস

S-400 চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে:

40N6: ৪০০ কিমি পর্যন্ত দূরত্বে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম। উচ্চমানের স্ট্র্যাটেজিক টার্গেট ধ্বংসে ব্যবহৃত।

48N6: মাঝারি পাল্লার (২৫০ কিমি) ক্ষেপণাস্ত্র।

9M96E এবং 9M96E2: স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (৪০–১২০ কিমি) যা দ্রুতগামী লক্ষ্যবস্তু যেমন ফাইটার জেট বা PGM-কে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ঘণ্টায় প্রায় ১৭,০০০ কিলোমিটার গতিতে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যেতে পারে এবং ১০ মিটার থেকে ৩০ কিমি উচ্চতায় যেকোনও লক্ষ্যকে আঘাত করতে পারে। এমনকী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকেও আঘাত করে প্রতিহত করতে পারে এই সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র।

ইলেকট্রনিক যুদ্ধেও শক্তিশালী এই রণসজ্জা

S-400 শুধু গোলাবারুদেই নয়, ইলেকট্রনিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাতেও সজ্জিত। এই S-400 সিস্টেমের সঙ্গে ব্যবহার করা রাডারগুলি ইলেকট্রনিক জ্যামিং প্রতিরোধী। স্টেলথ প্রযুক্তি চিহ্নিত করার ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ শত্রুর প্রযুক্তিগত ফাঁকি সত্ত্বেও এই সিস্টেম কার্যকর।

কৌশলগত বার্তা

ভারতের এই প্রতিরোধ কেবলমাত্র প্রতিশোধ বা আত্মরক্ষার প্রকাশ ছিল না, বরং একটি বার্তা যে —যুদ্ধক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির নির্ভরতা এবং প্রস্তুতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পাকিস্তানের লাহোর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে ‘নিউট্রালাইজ’ করে ভারত একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়— যদি ভারতের উপর আঘাত আসে, প্রতিক্রিয়া হবে সুসংহত, প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং সিদ্ধান্তমূলক।

আরও পড়ুন-পাকিস্তানের ‘জিহাদি জেনারেল’! কতখানি ক্রূর সেনা প্রধান মুনির?

এক নতুন সামরিক-নৈতিক অধ্যায়ের সূচনা

পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের S-400 ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার শুধু প্রতিরক্ষা নয়, এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধও বটে। শত্রুর পরিকল্পনার অনেক আগেই তা শনাক্ত করা, প্রতিরোধ গঠন করা এবং সীমান্ত অতিক্রম না করেই আকাশেই তা বিনাশ করে দেওয়া—এ যেন ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা, যেখানে প্রতিরক্ষা অস্ত্র হয়ে উঠেছে আক্রমণ প্রতিরোধের কৌশলগত ভাষা।

এই ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এক নতুন দোলাচলের মুখোমুখি। যুদ্ধ এখন আর কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের সংঘর্ষে সীমাবদ্ধ নয়; এটি কূটনৈতিক টেবিল, সাইবার জগৎ, মিডিয়া মনস্তত্ত্ব এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কুশলী প্রতিযোগিতা। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাম্প্রতিক এই উন্নয়ন শুধু পাকিস্তান নয়, চিন সহ সমগ্র দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

ভারতের এই প্রতিরক্ষামূলক বলয়, যেখানে উচ্চতর প্রযুক্তি, মানবিক নেতৃত্ব এবং কৌশলগত দৃঢ়তা একত্রিত হয়েছে, তা ভবিষ্যতের জাতীয় নিরাপত্তা মডেলের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। আজকের ভারত শুধু আঘাত সইতে সক্ষম নয়—সে জানে, কবে, কোথায়, কতটা এবং কীভাবে জবাব দিতে হয়।

More Articles