ভারত-পাক সংঘর্ষে সংবাদ মাধ্যমের সার্কাস প্রদর্শনী
Indian Fake News on Media: ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র এতটাই ডালপালা মেলেছে যে সন্ত্রাসের বলি মিলিটারি কর্নেলের স্ত্রী যখন মুসলিম বিরোধিতার প্রতিবাদ করেছেন তখন তাঁকে উচ্চারণ অযোগ্য ভাষায় ট্রোল করা হয়েছে।
"যুদ্ধে সবার প্রথম মৃত্যু হয় সত্যের"— এই বহু প্রচলিত আপ্তবাক্যের আরেকটি তরতাজা উদাহরণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদীদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং তার পরবর্তীতে ভারত-পাক সংঘর্ষের (যুদ্ধ বলছি না কারণ দু'পক্ষের কেউই কখনও একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি) সময় ভারতীয় মিডিয়ার লজ্জাজনক মিথ্যাচার ও ঘৃণা ছড়ানোর অভূতপূর্ব সার্কাস দেখে। এমনিতেই মিডিয়ার স্বাধীনতা সূচকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে অহরহ প্রচারিত ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১, তার উপর এবারের এই পারফরম্যান্স সারা বিশ্বের কাছে ভারতীয় টিভি মিডিয়াকে বিশ্বাসযোগ্যতাহীন হাস্যকর উপাদানে পরিণত করে ফেলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই অকল্পনীয় মিথ্যাচার ও কুৎসার সমালোচনা করে বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যা জগৎসভায় ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। ভারতীয় টিভি মিডিয়া তাদের নাটুকে উপস্থাপনা, চিৎকৃত উচ্চারণ, দেশভক্তির নামে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য, সরকারের প্ররোচনায় গণশত্রু নির্মাণ— ইত্যাদি কারণে গোদি মিডিয়া নামে কলঙ্কিত, তবে এবার যা হলো তার তুলনা বিরল। আমরা দেখলাম, ২৪×৭ প্রত্যেকটা টিভি স্টুডিওতে রাজনৈতিক দলের ভাষ্যকারের পাশাপাশি স্বঘোষিত সামরিক বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সেনাবাহিনীর নানা মাপের প্রাক্তন কর্তা নিয়ে গঠিত এক নতুন প্রজাতি যারা বলেন কম, চিৎকার করেন বেশি। এখানে তারা নিজেরাই 'সত্য' নির্মাণ করেন, নিজেরাই সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট (যা দেশের স্বার্থে অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়) বর্ণনা করেন এমনকী আগামী ঘণ্টায় কী ঘটতে চলেছে, তার আগাম বিবরণও প্রস্তুত করেন। এই ধারাবাহিক 'নৌটঙ্কি'দের স্বাভাবিকভাবেই বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের প্রাক্তন অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব কৃষ্ণান সুদ 'TRP Commander' আখ্যা দিয়েছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সীমান্তের অপর পারেও ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিউজ চ্যানেলগুলো একইভাবে মিথ্যাকে আশ্রয় করে তাদের ন্যারেটিভ প্রস্তুত করেছে এবং একইভাবে সারা পৃথিবীতে সমালোচিত হচ্ছে।
এবারের ভারতীয় টিভি মিডিয়ার হুক্কা- হুয়া, রণহুঙ্কার, স্টুডিও যুদ্ধের পরিষ্কার দুটো পর্ব রয়েছে। পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসবাদী হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তারা যেহেতু ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান তাই একে প্রথম থেকেই একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা বলে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। অথচ সেই কাশ্মীরের মানুষদের (যারা প্রায় সবাই ধর্মপরিচয়ে মুসলমান) সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি বিরোধ, এমনকী নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পর্যটকদের বাঁচানোর চেষ্টাকে কখনই মূল ধারার মিডিয়ায় সামনে আনা হয়নি। বরং এই ধর্মীয় ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারতাবাদ ও বহুত্বের মতাদর্শে বিশ্বাস করা সমস্ত মানুষদের 'সেকু- মাকু- নকশাল' আখ্যা দিয়ে মানুষের কাছে তাদের গণশত্রুতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা হয়েছে। যুদ্ধ বিরোধিতা করার যে কোনও চেষ্টাকে দেশদ্রোহিতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র এতটাই ডালপালা মেলেছে যে সন্ত্রাসের বলি মিলিটারি কর্নেলের স্ত্রী যখন মুসলিম বিরোধিতার প্রতিবাদ করেছেন তখন তাঁকে উচ্চারণ অযোগ্য ভাষায় ট্রোল করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৮ মে-এর মধ্যে ভারতে ঘৃণাজনিত অপরাধের সংখ্যা ১৮৪, এর মধ্যে শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে খুনের অভিযোগও রয়েছে।
আরও পড়ুন- মিডিয়ার স্বাধীনতা দমনকারী শাসকদের জনতা ক্ষমা করেনি
দ্বিতীয় পর্বটি আরও বেশি ফিল্মি ও হাস্যকর। অপারেশন সিঁদুরের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিযান চালানোর সময় ভারতীয় মিডিয়ার বালখিল্য আচরণ যা এক বড় অংশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। একদিকে মক ড্রিলের ঘোষণা, বিমানবন্দর বন্ধের ঘোষণা, তড়িঘড়ি আইপিএলের ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়া ও সীমান্তের অঞ্চলগুলোতে টোটাল ব্ল্যাক আউটের বাস্তবতা, অন্যদিকে সরকারি নির্দেশের পরোয়া না করে স্টুডিওতে যুদ্ধের 'রঙ্গারঙ্গ কারিক্রম'। এই ধারাবাহিক মিথ্যাচারের নমুনাগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে—
* রণতরী বিক্রান্ত দ্বারা করাচি বন্দর ধ্বংস
* লাহোর শহরকে বোমারু বিমান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া
* পাক সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মুনিরের পদত্যাগ, গ্রেফতারি ও নতুন সেনাধ্যক্ষের যোগদান
* ইসলামাবাদে ভারতীয় সেনার প্রবেশ এবং পাক প্রধানমন্ত্রীর বাঙ্কারে আত্মগোপন
* এর সঙ্গে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর দখল তো আছেই।
বলার বিষয় হলো, এই মিথ্যাচারগুলো না করলেও এই সংঘর্ষে ভারতের সেনা যে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে তা পৃথিবীর কাছে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। এই মিথ্যাচারগুলো কেন পরিকল্পিত ছিল তা বোঝা যায় যখন দেখি, উপরিউক্ত আজগুবি দাবিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া বিমানবন্দরের দুর্ঘটনা, গাজা স্ট্রিপের সংঘর্ষ ও বোমাবর্ষণের পুরনো ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত ফেক নিউজের প্রধান কারবারি ছিল মূলত সংঘ পরিবারের আইটি সেল, এবার সমস্ত সর্বভারতীয় এবং আঞ্চলিক মিডিয়া এই নোংরা খেলায় সামিল হলো। অথচ একথা কারও অজানা নয় যে, প্রযুক্তির এই উন্নতির যুগে 'ফ্যাক্ট চেক' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা নিরুপণ করা সম্ভব। এই উন্মাদনা তৈরির অন্যতম কারণ কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও এই মিথ্যাচারকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের টিআরপি যেনতেন প্রকারে বৃদ্ধি।
যুদ্ধ বা সামরিক সংঘর্ষকে 'স্পেকটাকল্' বানিয়ে তা পরিবেশন করার ইতিহাস নতুন নয়। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপণন করে একইসঙ্গে তা থেকে মুনাফা কামানো ও সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে জনমত তৈরি করা যায় তা আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করি উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মার্কিন চ্যানেল সিএএএন-এর মাধ্যমে। এর আগে যুদ্ধের বা সংঘর্ষের খবরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অনেক বেশি। এদেশে এই ধরনের সংঘর্ষের আংশিক লাইভ কভারেজ প্রথম আমরা দেখি ১৯৯৩ সালে কাশ্মীরের হজরতবাল ধর্মস্থানে সেনাবাহিনী ও একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর সংঘর্ষের সময়। কারগিল যুদ্ধের সময় সেই লাইভ কভারেজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ২৬/১১-এর সময় মুম্বইয়ের তাজহোটেলের সামনে থেকে কভারেজ নিয়ে বিতর্ক বাঁধে। পুলিশ বাহিনীর আপত্তিতে লাইভ কভারেজ বন্ধ হয় কারণ সেই বিবরণী অভিযানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কিন্তু মোদি জমানায় এই ধরনের সংঘর্ষে টিভি চ্যানেলগুলোকে 'ফ্রি-অ্যাক্সেস' দেওয়া শুরু হয় কারণ মনে করা হয়, সরকারের বশম্বদ চ্যানেলগুলো তথ্যযুদ্ধ তৈরি করে সরকারকে সাহায্য করবে। আমরা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিককে প্রবল বন্যা প্রমাণ করতে এক গোড়ালি জলের মধ্যে সাঁতরাতে দেখেছি, গ্রীষ্মের দাবদাহ প্রমাণ করতে পুকুরে ঝাঁপাতে দেখেছি কিন্তু যুদ্ধ উন্মাদনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করার ব্যানার লাগিয়ে এইমাত্রায় কখনও মিথ্যার বেসাতি করতে দেখিনি।
আরও পড়ুন- কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব? কেন শশী থারুরকে সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিল কেন্দ্র?
এবারে গোদি মিডিয়ার আচরণ শেষ বিচারে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় দাবি করে মিডিয়ার দায়িত্বশীল আচরণ, কারণ এটা একটা আন্তর্জাতিক বিষয় ও পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কিন্তু এই পর্বে সরকারের ঘোষিত নীতির পরোয়া না করেই এই মিডিয়া হাউসগুলো নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ জায়গায় গেছে যে, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রককে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে: 'Do not trust or share unverified information. For accurate update, refer to official government sources'। সামরিক বাহিনী টুইট করে বলেছে, অসমর্থিত কোনও খবর প্রকাশ করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজকের দিনে দীর্ঘ যুদ্ধ চালানো যে কোনও দেশের পক্ষেই বিপদজনক। ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান মনোজ নারভানে আমাদের সঠিকভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, যুদ্ধ কোনও বলিউডি সিনেমা নয় যা দেশবাসীকে ড্রইংরুমে বিনোদন দেবে। এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দুই দেশ সংঘর্ষ বিরতি করলে বিষয়টা গোদি মিডিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হয়নি। তাই আজও সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে চলছে হাজার জল্পনা। এই চিৎকৃত উত্তেজনা কীভাবে আমাদের দেশকে বিপদে ফেলছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো এক টিভি চ্যানেলের আলোচনায় এক স্বঘোষিত সামরিক বিশেষজ্ঞ ইরানের বিদেশমন্ত্রীকে 'শুয়র কা আওলাদ' (son of a pig) আখ্যা দেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে ইরানের তীব্র প্রতিবাদে বিদেশমন্ত্রক ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। সন্ত্রাসবাদ ও সংঘর্ষের জন্য এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে দোষী ঠাওরানোর খেলায় এক বিজেপি মন্ত্রী সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কুরেশিকে সন্ত্রাসবাদীদের বোন আখ্যা দেন এবং বলেন এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিয়েছেন। এমনকী ভারত সরকারের পক্ষে যিনি সংঘর্ষ বিরতির ঘোষণা দেন, সেই বিদেশমন্ত্রী ও তাঁর কন্যাকে এমন ট্রোল করা হয় যে তাঁরা তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট 'প্রাইভেট' করতে বাধ্য হন। পাকিস্তানের গোলায় নিহত উরি সেক্টরের একজন শিক্ষক মহম্মদ ইকবাল মিডিয়ার সৌজন্যে হয়ে যান পাক উগ্রবাদী। এসব দেখে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বিজেপি নেতা অরুণ শৌরি সম্প্রতি করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন: 'The Indian media destroyed our credibility'।
এবারে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ভুয়ো খবরকে বন্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারের অপরিসীম ব্যর্থতা। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো শুধুমাত্র ফ্যাক্ট চেক প্রযুক্তি চালু করে ক্ষান্ত থেকেছে। অবশ্য তাদের আগেই অলট নিউজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই মিথ্যার বেসাতিকে চিহ্নিত করে দেয়। নৈতিকতাহীন, কুৎসিত, কদর্য এই চ্যানেলগুলোর বিষয়ে প্রেস ক্লাবগুলি হিরন্ময় নীরবতা পালন করেছে। সরকার সেই সমস্ত বিকল্প প্রচার মাধ্যমের কণ্ঠস্বরকে রূদ্ধ করতে চেয়েছে যারা গোদি মিডিয়ার এই রাষ্ট্রগীতে সামিল হয়নি। দ্য ওয়ার, মক্তব ইন্ডিয়া, কাশ্মীর টাইমস এমনই কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এই উন্মাদনার মধ্যেও প্রিন্ট মিডিয়া কিছুটা হলেও দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। এই পর্বে সবচেয়ে যন্ত্রণার হলো সোশ্যাল মিডিয়া ও টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যেকার ভেদরেখা মুছে যাওয়া। এই লড়াইক্ষ্যাপা মিডিয়া যেভাবে ভারতীয় মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করল, তা এক কুৎসিত উদাহরণ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে।