হিজাব না পরলেই মানসিক হাসপাতালে! মেয়েদের যে নতুন ভয়াবহ শাস্তি দিচ্ছে ইরান
Iran Women Protest: তেহরানের একটি আদালত হিজাব না পরার কারণে একজন মহিলার দুই মাসের জেল আর ছয় মাসের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার 'সাজা' দিয়েছে
যার বিরুদ্ধে অত্যাচার, যার উপর শোষণ, তাকেই কারাগারে তোলার নোংরা অভ্যাসকে 'ভিক্টিম ব্লেমিং' নামে ডাকি আমরা। তবে শুধু 'ব্লেম-গেম' নয় বিষয়টি। প্রতিবাদীদের একেবারে নিকেশ করে দেওয়ার পন্থাটিও আজকাল সেকেলে। এখন আরও অভিনব উপায়ে, আরও ক্রুর উপায়ে চলে হেনস্থা। ইরান আবার ফুঁসছে। আবার ইরানের কঠোর ইসলামিক পোশাকবিধির বেড়াজাল দেখে বিশ্ব শিউরে উঠছে। আহু দারিয়াই নামের এক মহিলাকে হেনস্থা করা হচ্ছিল 'সঠিক' পোশাক না পরার জন্য। প্রতিবাদে তিনি সমস্ত পোশাক খুলে শুধু অন্তর্বাসে ঘুরে বেড়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বোরখা-হিজাবে ঢাকা এক ক্যাম্পাসে অন্তর্বাসে আহু দারিয়াইয়ের ছবি এখন ভাইরাল! তবে তারপর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি। আহু দারিয়াই 'মিসিং'! প্রতিবছর এভাবে 'মিসিং' হয়ে যান বহু নারীই। কোথায় হারিয়ে যান তারা? ইরানে এই প্রতিবাদী, 'অবাধ্য' মহিলাদের এখন ঠাঁই হচ্ছে মানসিক হাসপাতালে। যারাই প্রতিবাদে মুখর, রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন! অতএব ধরে নিয়ে যাও মানসিক হাসপাতালে! আহু দারিয়াইকেও নাকি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে 'অবাধ্য' হয়েছিলেন মাহশা আমিনিও। অভিযোগ, তাঁর মৃত্যু হয় পুলিশের মারে। এই ঘটনার পর বহু মহিলা, প্রতিবাদে হিজাব পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইরানি অভিনেত্রী আফসানেহ বায়েগান বারবার ইনস্টাগ্রামে খোলা চুলের ছবি পোস্ট করেছেন। হিজাব ছাড়াই প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ৬১ বছরের বায়েগানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এবং 'অ্যান্টি ফ্যামিলি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের' চিকিৎসার জন্য সপ্তাহে একবার মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরানের প্রথম সিনেমা তারকাদের একজন এবং ইরানি টেলিভিশনের একজন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব বায়েগান। তবে বায়েগানের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। ইরানের বিচারকরা কিছুকাল আগেই বলেছেন, ইরানি অভিনেত্রী আজাদেহ সামাদি 'অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার'-এ 'ভুগছেন'! কারণ? কারণ তিনি কোনও এক শেষকৃত্যে হিজাবের পরিবর্তে টুপি পরেছিলেন। সামাদিকেও সাপ্তাহিক মানসিক হাসপাতালে থেরাপি করানোর নিদান দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- বোরখা-বিশ্বে অন্তর্বাসে বিরোধিতা! তারপরই কোথায় হারিয়ে গেলেন প্রতিবাদী ইরানি মহিলা?
গত জুলাইয়ের শুরুতেই, তেহরানের একটি আদালত হিজাব না পরার কারণে একজন মহিলার দুই মাসের জেল আর ছয় মাসের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার 'সাজা' দিয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি নাকি এমন এক সংক্রামক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিতে ভুগছেন যা যৌন প্রতিবন্ধকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলাদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার জন্য বাধ্য করার মতো সাজা ক্রমেই বাড়ছে ইরানে। দেশের বিচার বিভাগীয় প্রধান, গোলাম-হোসেন মোহসেনি ইজেইকে পাঠানো একটি খোলা চিঠিতে গত ২৩ জুলাই, চারটি মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার সভাপতিরা প্রশাসনকে 'মনস্তাত্ত্বিক শোষণ'-এর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তারা বলছেন, "মানসিক রোগ নির্ণয় করা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব, বিচারকদের নয়।" শুধু মহিলা নয়, ছোট শিশুদেরও রেহাই নেই। মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ যখন তুঙ্গে, তখন স্কুলছাত্রদের রাস্তায়, স্কুলে আটক করা হয়েছিল। তারপর তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল যেখানে তাদের 'আবার শিক্ষিত' করে 'অসামাজিক আচরণ' প্রতিহত করা হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী ইউসেফ নুরি নিজেই তা স্বীকার করেছিলেন।
পোশাক বিধি না মানলেই মোটা টাকা জরিমানা, মেয়েদের হিজাব ছাড়া গাড়ি চালাতে দেখা গেলে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে, যানবাহন বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, এমনকী বিভিন্ন কোম্পানিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে যাতে মেয়েদের চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যে মহিলারা পোশাক বিধি মানছেন না তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না, যে দোকান তাঁদের খাবার বিক্রি করছে সেই খাবারের দোকানগুলি বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিছুকাল আগে, তেহরান প্রদেশের একটি আদালত হিজাব ছাড়া গাড়ি চালানো এক মহিলাকে মর্গে মৃতদেহ পরিষ্কার করার সাজা দেয়, একমাসের।
গত জুলাইয়ের শেষের দিকে ইরানের সংসদে পেশ করা একটি বিলে যেসব মহিলা মাথায় হিজাব পরতে অস্বীকার করবেন তাদের জন্য আরও কঠোর শাস্তির প্রস্তাব আনা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে মহিলারা তাদের নাগরিক অধিকার, কাজের অধিকার হারাতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই বিলে নতুন এক 'অপরাধ'-কে সামনে আনা হচ্ছে। বোরখা-হিজাব ছাড়া নিজেকে 'প্রদর্শন' করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ!
আরও পড়ুন- হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে, ইরান পাহলভি রাজবংশের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ১৯৭৯ সালের ৭ জানুয়ারি পারস্যের সাম্রাজ্যের পতন ঘটে আর ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক ইরানের জন্ম হয়। পারস্যের স্বৈরাচারী ও সুলতানবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরে উদার ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্ম হবে আশা ছিল। অথচ, ইরান সাম্রাজ্যবাদী একনায়কতন্ত্র থেকে চলে গেল ইসলামিক ধর্মতন্ত্রের দিকে। সৈয়দ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনির শাসনে গণতান্ত্রিক ভোটদানের অধিকার পর্যন্ত খর্ব হয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের আইন অনুসারে, খোমেইনি মেয়েদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করে তোলেন। ইরানে ক্রমেই পুরুষদের থেকে 'নিকৃষ্ট' বলে বিবেচিত হতে থাকেন মহিলারা। নিজেদের অধিকার এবং লিঙ্গসাম্যের জন্য লড়াই করলেই বলা হয়, সেই মহিলারা মানসিক রোগে আক্রান্ত।
তথ্য বলছে, ইরানে ২৫% মহিলা ভয়, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আত্মহত্যা সহ মানসিক অসুখে আক্রান্ত। এই দমবন্ধকর ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসনের জীবনযাপনের কারণেই মেয়েদের তীব্র হতাশা গ্রাস করেছে। সাহার খোদায়ারির কথা মনে আছে? লুকিয়ে নিজের প্রিয় ফুটবল দলের ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে গেছিলেন। ধরা পড়ে যান। গ্রেফতার হওয়ার পরে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
ইরান সরকার 'ইয়ুথ পপুলেশন অ্যান্ড প্রোটেকশোন অফ দ্য ফ্যামিলি' নামে নতুন এক আইন প্রবর্তন করেছে যাতে মহিলাদের গর্ভধারণকাল সম্পূর্ণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ গর্ভনিরোধ এবং ভ্যাসেকটমি নিষিদ্ধ। একমাত্র মহিলার জীবন ঝুঁকির মুখে থাকলে কেবল টিউবেকটমির অনুমতি রয়েছে। বিয়ের আইনি বয়স ১৩ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে! ইরানে সমকামী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, এবং সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের উপর হিংসা বাড়ছে, ধরা পড়লেই কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড৷ ইরানিরা এই ভয়ে ভয়ে বাঁচায় ক্লান্ত! মেয়েরা নিজেদের স্বাধীনতাকে অধিকারকে পদদলিত হতে দেখে ক্লান্ত। ভয় দেখিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টা করেছে ইরান সরকার, তবুও রোজ রোজ বিক্ষোভ বাড়ছে। তবে, তাতে মাহশা, দারিয়াইদের মতো মেয়েরা শেষও হয়ে যাচ্ছেন। একদিন সূর্য উঠবে বলে, প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে হাজারো নক্ষত্র!