রোশনাইয়ের আনন্দ নয়, মনখারাপের দীপাবলি মাটির প্রদীপের কারিগরদের
Kali Puja 2022: কেমন আছেন প্রদীপের কারিগররা?
সন্ধ্যা হলেই প্রদীপের আলো ছড়াবে চারদিকে। প্রত্যেক মুহূর্তের অন্ধকার মুছে আলোর উৎসবে মাতবে রাজ্য। দেশ। বিশ্ব। কিন্তু যে কৃত্রিম আলো প্রথম জ্বালিয়েছিল! যে মাটির প্রদীপের আঁচড়ে জুড়িয়েছিল অন্ধকার। তার খবর কী? কেমন আছেন প্রদীপের কারিগররা? কালীপুজো আর হাল আমলের দীপাবলি উৎসবের আবহে আমরা সেই মাটির শিল্পের নেপথ্য নায়কদের খোঁজ নিতে পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রদীপ-গ্রামে।
যে প্রদীপ গাঁয়ের অবস্থান চালতাবেড়িয়ায়। বারাসত-বনগাঁগামী যশোর রোডের পাশেই রয়েছে এই গ্রাম। যেখানে প্রায় সকলেই জড়িয়ে মাটির শিল্পের সঙ্গে। প্রদীপের সঙ্গে। যা রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় প্রদীপের গ্রাম।
করোনা গিয়েছে। খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে সবটা। কিন্তু আজও ভালো নেই ওঁরা। করোনার ভয়াল থাবায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, তা এখনও দিচ্ছে যন্ত্রণা। যার যাঁতাকলে এখনও ধুঁকছে একের পর পরিবার। তাই প্রদীপ আছে, শিল্প আছে, শিল্পী আছেন কিন্তু বিক্রি কই! এই প্রশ্নের আবহেই এখনও চিন্তায় ওঁরা।
আরও পড়ুন: হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে
ওই অঞ্চলের পালপাড়াজুড়ে প্রায় ৫০-এর বেশি পরিবারের বাস। ছোট থেকে বড় প্রায় সকলেই জড়িত মাটির কাজের সঙ্গে। পুজো আসার অনেক আগে থেকেই শুরু হয় কাজ। মাটি আনা, মাটি মাখা, বিভিন্ন মাপের, নকশার ছাঁচে ফেলে সেই মাটিতেই ফুটিয়ে তোলা নানা রূপ। তারপর তা শুকিয়ে নিয়ে কাঠের আগুনে পোড়ানো। এই পদ্ধতির পরেই নির্দিষ্ট মাটির জিনিসে রঙের প্রলেপ। তারও রয়েছে একাধিক ভাগ। প্রথমে সাদা। তারপর প্রদীপ বা মাটির অন্যান্য শিল্প অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্রলেপ দেওয়া।
কালীপুজো এলেই এই কাজ আগেও চলত রমরমিয়ে। দুর্গা পুজো দেখারও সময় থাকত না ওঁদের। কিন্তু এখন পরিবর্তন হয়েছে পরিস্থিতির। এক ধাক্কায় হাল খারাপ হয়েছে ব্যবসার। ধুঁকছে শিল্প। যেটুকু যা ছিল, সবটা প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে বৈদ্যুতিন আলো, বহুল প্রচলিত চায়নার জিনিস! কেন এই অবস্থা, কেন এখনও অন্ধকারে প্রদীপের গ্রাম! কী বলছেন ওঁরা?
সমীর পাল। পালপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা। শিল্পী। ঠাকুরদার আমল থেকে এই কাজে জড়িত। এক সময় থাকতেন ওপার বাংলায়। এপারে এসে তিনিও ছোট থেকেই শুরু করলেন কাজ। সমীরের কথায়, "আজ থেকে ধরুন ৫ বছর আগে। লোকে প্রদীপের পিছনে ছুটতেন। এখন অবস্থা শেষ! এবারও হাল খুব একটা ভালো নেই। বয়স হয়েছে, কম কাজ করি। কিন্তু ভয় লাগে এই পরম্পরা এই শিল্প আমার ছোটরা আর রাখবে কি!'' সমীরের ভাই রাখাল পাল। তাঁর মতে, ''আগের বছরের হিসেবে এবার একটু বেড়েছে বিক্রি। তবে এত জিনিস নষ্ট হয় এখন, খারাপ লাগে।''
আর এক পরিবারে বাস প্রীতম পালের। যুবক প্রীতম ছোট থেকেই প্রদীপের কাজে যুক্ত। তিনি বলেন, ''ভালো লাগে কাজটা করতে। কিন্তু কী করব তাই ভাবি, আদৌ টিকবে তো!'' প্রীতমদের সঙ্গেই কাজ করেন লতারানি হালদার। তাঁর মতে, ''আমাদেরও দুর্দিন। কাজ নেই। বিক্রি তেমন নেই। একটা সময় তো সবাই মিলে এই কাজ করেই পেট চালিয়ে নিতাম।'' পালপাড়ার কাছে থাকেন দাস পরিবারের কয়েকজন। তাঁরাও জড়িত এই কাজেই। অপূর্ব দাস বললেন, ''বিক্রি কেমন বেড়েছে বলুন তো! ধরা যাক, আগে ৫০০ টাকার মাল বিক্রি করতাম। এখন বেড়ে ৭০০ হল। কিন্তু আদতে সেই অবস্থা একই।'' অপূর্বর কথায়, "এখন বিক্রি করতে হয় খোলা বাজারে। যা আগে এখানে হত না। করোনা বদলে দিয়েছে সব।"
পূর্ণিমা পাল। তিনিও বহুকাল যাবৎ এই কাজে জড়িত। তিনি বলছেন, "কম দামে মাল বিক্রি করে লাভ থাকে না একদম। শয়ে শয়ে প্রদীপ বানিয়ে অনেক সময় ক্ষতি রেখেই বিক্রি করে দিই। খরচ খানিকটা তোলার জন্য।''
চম্পা সেন একটি কারখানায় প্রদীপ বানান ওই অঞ্চলেই। তিনি বলছেন, ''প্রচুর মাটি আসত আগে, এখন কম আসে। আমাদেরও কাজ কমেছে। বুঝতে পারি আর বেশিদিন হয়তো থাকবেই না!"
আসলে ভালো নেই প্রদীপ গ্রাম। আলোর দ্বীপের স্বপ্ন বোনার মধ্যেই আজও লুকিয়ে রেখেছে অন্ধকার। যে সংকট আসছিল আগে থেকেই, সেই সংকটের করোনাকালে তীব্র গতিতে বেড়ে ওঠা, আরও খারাপ করেছে পরিস্থিতি। যা মেটেনি এখনও। শুধুই ভালো থাকার চেষ্টা চলছে নিরন্তর!