কখনো গুপ্তচর কখনো দুর্গের উচ্চতামাপক যেভাবে ঘুড়ি ব্যবহার হত অতীতে
History of Kite : বিশ্ব জুড়ে ঘুড়ি শুধু একটি খেলা নয়, বরং এটি বহু মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রাচীন ইতিহাসবিদরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ঘুড়ির উৎপত্তি হয়েছিল চিনে। প্রথম দিকে, ঘুড়ি ছিল বাঁশের পাতলা কাঠামো ও রেশম বা কাগজের আচ্ছাদনে তৈরি, যা দেখতে সরল হলেও ছিল বহুমুখী কাজে ব্যবহারযোগ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে দূরবর্তী সেনাদের কাছে সংকেত পাঠানো, দুর্গের উচ্চতা বা সমুদ্রপথের দূরত্ব মাপা, এমনকি আবহাওয়ার দিক ও বাতাসের গতি নির্ধারণের জন্যও ঘুড়ি ব্যবহার করা হত। চিনা সম্রাটদের আমলে ঘুড়ি কখনও গুপ্তচরবৃত্তির হাতিয়ার, কখনও শত্রুকে ভীত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সিল্ক রোড ও সমুদ্রপথ ধরে চিনা ব্যবসায়ী ও নাবিকরা শুধু রেশম, মশলা বা কাগজই নয়—ঘুড়ি তৈরির কৌশল ও খেলার আনন্দও দূরদেশে নিয়ে যেতেন।
ঘুড়ি প্রথমে ছড়িয়ে পড়ে কোরিয়া, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, যেখানে স্থানীয়রা নিজেদের পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিল্পকলা মিশিয়ে ঘুড়িকে নতুন রূপ দেন। জাপানে সমুরাই প্রতীক আঁকা 'তাকো', থাইল্যান্ডে রাজকীয় প্রতিযোগিতার 'পাকপাও', আর মালয়েশিয়ায় চাঁদের মতো নকশা করা 'ওয়াউ বুলান'—সবই চিনা ঘুড়ির সাংস্কৃতিক অভিযোজন। এরপর আরববণিক ও মুসলিম ভ্রমণকারীরা ঘুড়ি-র সঙ্গে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় পরিচয় করিয়ে দেন।
আরও পড়ুন-
আগুন-ধোঁয়ার কুণ্ডলী ও দুই ফুটবলার! কীভাবে জন্ম নিল পৃথিবী বিখ্যাত এই ছবি?
মধ্যযুগে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এশিয়ায় এসে প্রথম ঘুড়ির সঙ্গে পরিচিত হন, যা পরবর্তী সময়ে তাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও ব্যবহৃত হয়। এ-কথার এক বিখ্যাত উদাহরণ হল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিদ্যুতের পরীক্ষা। উপনিবেশ বিস্তারের যুগে ঘুড়ি ভারত, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ক্রমেই স্থানীয় উৎসব, কৃষি-ঋতু ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে।

চিনের ড্রাগন ঘুড়ি
কলকাতার আকাশে প্রথম ঘুড়ি জায়গা করে নেয় নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের হাত ধরেই। তাঁর আমলে কলকাতার আকাশে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ির দেখা মিলত। কানকাওয়া, চং, তুলকুল, ইত্যাদি। অন্যদিকে কলকাতায় তখন মাথাচাড়া দিচ্ছে বাবু সংস্কৃতি। বাবুরাও ফুর্তি করার জন্য ও নিজেদের প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামতেন। কলকাতার বাবু সংস্কৃতি ক্রমেই রপ্ত করতে শুরু করে নবাবিয়ানার বিভিন্ন রীতিনীতি। আর সেগুলোই দিন-দিন তাঁদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। ঘুড়ির গায়ে লাগানো হত হরেক রকমের টাকা, কখনও পাঁচ, কখনও-বা দশ কখনও-বা তারও বেশি! ঘুড়ির সঙ্গে টাকা ওড়ানোর এই রীতি বাবুয়ানায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের ঘুড়ি উৎসব
গুয়াতেমালার সুমপাঙ্গো শহরে প্রতিবছর 'ফেস্টিভাল দে বারিলেতেস গিগান্তেস' বা দৈত্যাকার ঘুড়ির উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা মূলত Día de Los Muertos (মৃতদের দিবস)-এর অংশ। এখানে বিশাল, বর্ণিল কাগজ ও বাঁশের তৈরি ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে প্রয়াত আত্মীয়দের স্মরণ করা হয় এবং সামাজিক বার্তা প্রচার করা হয়। এই ঘুড়িগুলো কখনও-কখনও ৬০ ফুট প্রস্থেরও বেশি হয় এবং তৈরিতে লাগে দীর্ঘ মাস কিংবা বছর। রাশিয়ার মস্কো শহরে 'মটলি স্কাই' কাইট ফেস্টিভ্যাল বসন্তকালে পুকুরের ধারে আয়োজন করা হয়। এখানে আকাশে উড়ে বেড়ায় বিশালাকার প্রাণীর (হাঙ্গর, হাতি, বাঘ) আকারের ঘুড়ি —যা স্থানীয় শিল্পীদের সৃজনশীলতার এক দৃষ্টান্ত। সঙ্গে থাকে কাইট-ওয়ার্কশপ, খাবারের স্টল এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-
রূপান্তরকামী মহিলারা ক্রিকেট খেললে মহিলাদের অধিকার কমে যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় একেবারেই অনন্য 'উইন্ডলেস কাইট ফেস্টিভ্যাল', যেখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয় ঘরের ভেতরে, অর্থাৎ একেবারেই বাতাস ছাড়াই! এখানে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষ প্রযুক্তি এবং নকশা ব্যবহার করে ঘুড়ি উড়িয়ে দেখান, যা দর্শকদের জন্য এক অভিনব অভিজ্ঞতা। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুড়ি শুধুমাত্র বিনোদন নয়—এটি এক আধ্যাত্মিক প্রতীক। এখানে ঘুড়ির নকশায় স্থানীয় পুরাণ, দেবতা ও প্রাকৃতিক উপাদানের চিহ্ন থাকে। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন ও সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। রাজস্থানে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে জয়পুর ও যোধপুর শহরের আকাশ ভরে যায় রঙিন ঘুড়িতে। চলে প্রতিযোগিতাও, সেই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ এক বিশেষ গৌরবের বিষয়। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ঈদ ও স্বাধীনতা দিবসের সময় ঘুড়ি ওড়ানো একটি জনপ্রিয় প্রথা, বিশেষত পুরনো শহরাঞ্চলগুলিতে।

রাজস্থানের রঙিন ঘুড়ি ভরা আকাশ
ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এই কার্যকলাপ মানুষের আবেগ, মনোযোগ ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় দৃষ্টি, হাতের নড়াচড়া এবং বাতাসের প্রবাহের প্রতি সচেতন মনোযোগ মস্তিষ্কে ইন্দ্রিয়-চালনার সমন্বয়কে বাড়িয়ে দেয়, যা শরীর ও মনের সমন্বয়কেও উন্নত করে এবং কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমায়। আকাশে ভেসে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মানুষ এক ধরনের মুক্তির অনুভূতি পায়। মাটিতে দাঁড়িয়েও সে যেন আকাশকে স্পর্শ করতে পারছে। এই সময় আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিন নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা আনন্দ ও প্রশান্তিকে বাড়িয়ে তোলে। অনেক দেশে ঘুড়ি থেরাপি (kite therapy) ব্যবহৃত হয় বিষণ্নতা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ও শৈশবের ট্রমা কাটিয়ে তোলার জন্য। এ হল এক ধরনের ভিজ্যুয়াল মেডিটেশন। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, জাপান ও গুয়াতেমালার মতো দেশে ঘুড়ি উৎসব কেবল আনন্দের উপলক্ষ নয়, বরং প্রজন্মান্তরে শিল্পকলা, লোককথা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যম। মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল ইয়ুং-এর মতে, ঘুড়ি মানুষের অবচেতনে 'মুক্তির মধ্যে নিরাপত্তার' প্রতীক—যেখানে সুতো মানে সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণ, আর আকাশ মানে স্বাধীনতা ও সম্ভাবনা। তাই ঘুড়ি ওড়ানো আসলে বিনোদন, থেরাপি, সামাজিকতা এবং গভীর প্রতীকী অর্থের এক অনন্য সমন্বয়।

ম্যাকাও পাখির অবয়বে বিরাটাকার ঘুড়ি
ইতিহাসে ঘুড়ি কেবল উৎসব বা বিনোদনের মাধ্যমই নয়, বহু সময়ে ঘুড়ি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক বার্তার শক্তিশালী হাতিয়ার। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গাজার 'গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন' আন্দোলনে ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীরা ইসরায়েলি সীমান্তে আগুন লাগানো ঘুড়ি (fire kites) ব্যবহার করেছিলেন। এই ঘুড়িগুলো একদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, অন্যদিকে প্রতীকীভাবে দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তাও বহন করেছিল। তাইওয়ানের হোয়াইট টেরর যুগে রাজনৈতিক বিরোধীরা সেন্সরশিপ এড়িয়ে, ঘুড়ির সঙ্গে লেখা বার্তা বা পোস্টার বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দিতেন, যাতে পাহাড়ি বা দুর্গম অঞ্চলের মানুষ সেগুলো পড়তে পারেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনেও ঘুড়ি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। সেখানে আকাশে উড়ে বেড়ানো রঙিন ঘুড়িতে আঁকা স্লোগান স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার এক তীব্র প্রতীক হয়ে উঠেছে। এমনকি কোরিয়ান উপদ্বীপেও এই একই দৃশ্য দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মীরা বড়-সড় বেলুন-ঘুড়ির মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় রাজনৈতিক প্রচারপত্র পাঠান, যা সীমান্ত পেরিয়ে অন্যত্র নিজের মত প্রকাশের এক সাহসী উপায়। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, ঘুড়ি শুধু খেলার বস্তু নয়, ঘুড়ি মানুষের কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের প্রতীক, আকাশে লেখা এক নীরব ঘোষণা।
বিশ্বজুড়ে ঘুড়ি শুধু একটি খেলা নয়, বরং এটি বহু মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিক সময়ে ঘুড়ি ও কাইটস্পোর্টসের বাজার দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী এই শিল্পের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২.৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং বর্তমানে তা ২১ কোটিরও বেশি ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কাইটবোর্ডিং ও ঘুড়ি উৎসবের জন্য সরঞ্জাম, নকশা ও কারিগরি সেবা নিয়ে গড়ে উঠেছে বহুমুখী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ভারতের গুজরাট ঘুড়ি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এবং সেখানে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। উৎসবের সময় ঘুড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি হলেও উৎপাদনের কাজ চলে সারাবছর। একটি ঘুড়ি তৈরির ধাপে-ধাপে কাজের জন্য প্রায় সাতটি পরিবারের শ্রম যুক্ত থাকে। খম্ভত, জামালপুর ও আহমেদাবাদের মতো অঞ্চলে হাজার-হাজার কারিগর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘুড়ি তৈরিতে নিয়োজিত। তবে এই শিল্পে বড় চ্যালেঞ্জ হল কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, কম মজুরি, এবং সংগঠনের অভাব, যার ফলে বহু শ্রমিক ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চিন, থাইল্যান্ড ও জাপানের মতো দেশেও ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। ফলে, ঘুড়ি আজ কেবল আকাশের রঙিন আনন্দের প্রতীক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিফলন।
Whatsapp
