ন্যায় যাত্রায় মানুষের মন জিতলেন রাহুল? ভোট পাবে কংগ্রেস?
Rahul Gandhi Bharat Jodo Nyay Yatra : রাহুলের ফেসভ্যালু ব্যবহার করে তৃণমূলের আস্থা অর্জন করতে পারবে হাত-শিবির? নাকি অধীর-মমতা দ্বৈরথের সৌজন্য তৈরি হওয়া সাপে-নেউলে সম্পর্কই অব্যাহত থাকবে?
ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা নিয়ে বাংলায় এসেছে কংগ্রেস। বৃহস্পতিবারই ন্যায় যাত্রা নিয়ে রাহুল গান্ধি বাংলায় আসেন। তবে জরুরি ডাকে রাহুলকে ওইদিন ফিরে যেতে হয়েছিল দিল্লিতে। আংশিক বিরতির পর ফের রবিবার বাংলায় যাত্রা শুরু করে কংগ্রেস। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। কার্যত উত্তরবঙ্গের মাটিতে ঝড় তুলেছেন কংগ্রেস নেতা। 'ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা' শুরু হয় জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউজ থেকে। সেখান থেকে বেরিয়ে একটি হুডখোলা কালো গাড়িতে চেপে বসেন রাহুল। উত্তরবঙ্গে ঠান্ডাও পড়েছে জাঁকিয়ে। সেই তীব্র ঠান্ডাতেও তাঁকে দেখা গেল সাদা হাফহাতা টি-শার্টেই। পাশে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। রাহুল পথে নামতে না নামতেই আবেগে ভাসেন জলপাইগুড়ির মানুষ।
চলার পথে কখনও বাচ্চাদের গাড়িতে তুলে নেন রাহুল। ভিড়ের মধ্যে থেকে উপহার হিসেবে কেউ এগিয়ে দিল প্রিয় নেতার হাতে আঁকা ছবি। সেই উপহার হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন রাহুল। কিছুতা এগিয়ে এসে রাহুল হুডখোলা গাড়ি থেকে নেমে উঠে পড়েন বাসে। বাসে করেই রওনা দেন শিলিগুড়ির দিকে। শিলিগুড়িতে গিয়ে ফের সেই হুডখোলা গাড়ি। বারবার নিজের বক্তৃতায় রাহুল তুলে ধরেন কংগ্রেস এবং তাঁর আদর্শের কথা। ২০২৪ সালের 'ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা'-য় রাহুলের স্লোগান 'নফরত কি বাজার মে মহব্বত কি দুকান'। দেশের দুর্দিনে বাঙালিদের দায়িত্বের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন।
এখন রাহুল বিহারে। পল্টুরাম নীতীশ ঠিক বিহারে ন্যায় যাত্রা ঢোকার একদিন আগেই পাল্টি খেয়ে চলে গেছেন বিজেপির শিবিরে। জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার ইন্ডিয়া জোট ভেঙে ফের হাত মিলিয়েছেন এনডিএ-র সঙ্গে। রবিবার সকাল থেকে ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতারা। তারা বলছেন, পলটুরামের এই কীর্তি সকলেই আঁচ করেই রেখেছিলেন। কংগ্রেস যতই বলুক নীতীশের জোট ভঙ্গ কোনও প্রভাব ফেলবে না, কিন্তু বাংলাতেও তো মমতা বলেছেন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আসন ভাগাভাগি নেই। রাহুল ন্যায় যাত্রা নিয়ে বাংলায় এলেন ঠিকই কিন্তু জনতার এই উচ্ছ্বাসের প্রভাব কি ভোটবাক্সে আদৌ পড়বে? মুর্শিদাবাদ, মালদহ পেরিয়ে জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুরে কি আসন পাবে কংগ্রেস? রাহুলের ফেসভ্যালু ব্যবহার করে তৃণমূলের আস্থা অর্জন করতে পারবে হাত-শিবির? নাকি অধীর-মমতা দ্বৈরথের সৌজন্য তৈরি হওয়া সাপে-নেউলে সম্পর্কই অব্যাহত থাকবে? বাংলা যা ভাবছে-র আলোচনায় যা বলছেন সাংবাদিক-আলোচকরা।
আরও পড়ুন-নীতীশ ডিগবাজি খেতেই তেজস্বীকে ইডির তলব! ন্যায় যাত্রায় ইন্ডিয়া নিয়ে নীরব কেন রাহুল?
সুমন ভট্টাচার্য
রাহুল যখন বেরিয়েছেন মানুষের মাঝে তখন রাহুলের পাশে অধীর ছাড়া কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শিলিগুড়িতে শঙ্কর মালাকার ছিলেন। গুলাম আহমেদ বীরও ছিলেন। কংগ্রেসের এই ন্যায় যাত্রায় রাহুল এখনও মোটামুটি তিনটি আসন কভার করেছেন। রায়গঞ্জ, জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি গতবার বিজেপির রাজু বিস্তা জেতেন। যদি রাহুলের এই জনজোয়রের প্রভাব সত্যিই পড়ে, যদি বামেদের সঙ্গে জোট হয়, তাহলে যে মূল ভোটটা উঠে আসবে তাতে বিজেপির বিপদই আছে। বিশেষ করে জলপাইগুড়ি ও রায়গঞ্জে। রায়গঞ্জে বাম ও কংগ্রেসের জোট হলে কিন্তু বিজেপির পক্ষে আসন ধরে রাখা বিপুল চাপ। তবে রাহুল এখনও এমন কোনও আসনে ঢোকেননি যা তৃণমূলের দখলে। বিজেপির জেতা কেন্দ্রগুলিকে সম্ভবত এই জন্যই বেছে নিয়েছেন রাহুল। তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণবঙ্গ। সেখানের সমীকরণ সম্ভবত রাহুল ঘাঁটতে চাইছেন না। ২-১৯ সালে ২০ শতাংশ ভোট বিজেপিতে চলে গেছি।; তাঁর ৫ শতাংশও যদি বাম ফের্ৎ পায় তাহলে বিজেপির ক্ষতি। কংগ্রেস কি তাহলে এই আসনগুলি জিতবে? না হয়তো, কিন্তু ভোট কাটাকাটিতেও ইন্ডিয়া জোটের উপকার হবে।
সংখ্যালঘু ভোট গুরুত্বপূর্ণ। কিষাণগঞ্জ আসনে কংগ্রেস জিতেছিল। সেখানে সংখ্যালঘু মানুষের ঢল নেমেছিল। কংগ্রেস এই ভোটকে টানতে পারলে খুবই উপকার হবে। নীতীশের এই দলবদলে কিন্তু বিহারের ক্ষতি হয়নি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কিছু বলার নেই। নীতীশের কুর্মি ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরেছে। লালু প্রসাদ যদব ও মুসলিম ভোট টেনে রেখেছিলেন। কংগ্রেসও কিষাণগঞ্জে মুসলিম ভোট টেনে রেখেছেন। ইন্ডিয়া জোটের এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত বিজেপির আসন কমানো। রাহুল গান্ধির এই যাত্রা দেখে মনে হলো, তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর বিবাদ নেই। পৃথক লড়তে হলে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই-ই হবে। কোনও বিরোধিতায় যাবেন না, তাতে ইন্ডিয়া জোটেরই লাভ। এই যাত্রাতে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা আছেই। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বাংলায় কংগ্রেসের আসন পাওয়ার কি সম্ভাবনা তাহলে তৈরি হলো? আমার মতে রায়গঞ্জ, মালদহের দু'টি ও মুর্শিদাবাদের তিনটি আসনে কংগ্রেসের ভোট বাড়বে, আর দার্জিলিংয়ে অজয় এডওয়ার্ড লড়তে পারলে কিছুটা লাভ হবে।
শাহনাওয়াজ আখতার
ভারত জোড়ো এবং ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার খুবই দরকার ছিল এই দেশে। কংগ্রেসে বেশ কিছুকাল ঝিমিয়ে ছিল। রাহুলের এই যাত্রায় নিজের দলের কর্মী সমর্থকরা নড়েচড়ে বসেছে। মানুষের এই ভিড় ভোটে পরিবর্তিত হবে কিনা এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই আগ্রহকে রাহুল ধরে রাখতে পারবেন কিনা, স্থানীয় কংগ্রেস এই বিষয়টিকে ধরে রাখতে পারবে কিনা। না পারলে, আবার ঝিমিয়ে পড়লে কিছুই করার নেই। সাধারণ মানুষের কাছে যে ঢেউ তোলা গিয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রার্থী বাছাইয়ে স্থানীয় কংগ্রেসের ভূমিকা থাকে। তাই নির্বাচনে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে। প্রার্থী মনোনয়ন হলে তার বিপরীত লবি তৈরি করে দলের সর্বনাশ ঠেকাতে হবে।
রাহুলের এই যাত্রার লক্ষ্য হচ্ছে, বিজেপি যে যে ইস্যুগুলিকে ধামাচাপা দিচ্ছে, সেগুলি তুলে আনা। বিজেপি সাধারণ মানুষের কথা বলছে না। কংগ্রেস এই ন্যায় যাত্রায় অগ্নিবীর ইস্যুটি তুলে এনেছে। চাকরির কথা, বেকারত্বের কথা বলছে। অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদা, অধিকারের কথা সামনে আনছে যা বিজেপি সুচারুভাবে সরিয়ে রাখছে, ভুলিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। রাহুল নিজের কাজ করছেন, চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাকিরা কি আদৌ সিরিয়াস? রাহুলও সংখ্যালঘু ভোটের কথা ভাবছেন। বিষয়টি তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটের অঙ্ক ঘাঁটবে নিশ্চয়ই। যেখানে জনসংখ্যা কম, সেখানে মানুষ ভয়ে, আশ্রয় পেতে ক্ষমতাসীন দলের কাছেই যাবে। যেখানে সংখ্যালঘু সংখ্যা বেশি সেখানে কিন্তু কংগ্রেস আর তৃণমূল দুই দলই এই ভোট পাবে। আমি যা দেখছি, মুসলিম সম্প্রদায় এবার বেশি সতর্ক হয়েই ভোট দেবে। ফলে কংগ্রেসকে অনেক বেশি সময় দিতে হবেই।
আরও পড়ুন- যে কারণে মালদহ মুর্শিদাবাদ রাহুলের ‘কাঁটো কা সফর’
সুমন সেনগুপ্ত
রাহুলকে দেখে মনে হলো, নিজেকে অনেকখানি পাল্টে ফেলেছেন। রাহুল একজন ধৈর্যশীল শ্রোতা। রাহুল মানুষের কথা শোনার জন্য মানুষেরই কাছে যাচ্ছেন। মহব্বতের দোকান খুলতে তো মানুষকেই লাগে। সাংবাদিকরা যা প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি তিনি মানুষের কথা শুনছেন। হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে ঘৃণার প্রচার রোখার জন্য আমরা তাঁর কাছে অনুরোধ করি। বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বললেই ইউএপিএ দিয়ে জব্দ করা এসব ঠেকানো যাবে কীভাবে? বিরোধীদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভয়। তাই আইনি সাহায্য দরকার। রাহুল যদি কংগ্রেসের লিগাল সেলকেই এই মানুষদের সাহায্য করতে ব্যবহার করতে পারেন আমার মনে হয় আরও অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। রাহুল সবটা শুনেছেন, সহকর্মীদের নোট নিতে বলছেন। রাহুল মানুষের মধ্যে থেকেই বিকল্প খুঁজতে চাইছেন। কিন্তু এই ন্যায় যাত্রা একদিনে যত মানুষকে টেনে এনেছেন তত মানুষ কি ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে? অন্যান্য বছরের থেকে কি কংগ্রেসের পক্ষে ফল এবার ভালো হবে? প্রদেশ কংগ্রেসকে বুঝতে হবে এই কাজটা, এই ন্যায় যাত্রাটা কেন করা হচ্ছে। লড়াইটা তো একটি আদর্শের বিরুদ্ধে। সত্যি কথা বলতে তৃণমূলের তো কোনও আদর্শ নেই। আরএসএসের আছে। আবার অন্যদিকে তৃণমূলের মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাও একটি সংগঠন আছে প্রদেশ কংগ্রেসের কিন্তু সংগঠনই নড়বড়ে। এই বিষয়টি প্রদেশ কংগ্রেসকেই দেখতে হবে। তৃণমূল স্তরে কংগ্রেসকে কাজ করতে হবে। সেই জায়গাটা নিয়ে মোটেও আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। শুধু আবেগ দিয়ে তো ভোট হয় না।
রাহুল সেদিন একটা দামী কথা বলেছেন। শঙ্করাচার্যরা যে মোদির বিরোধিতা করছেন তার কারণ কী? হিন্দুধর্মের বেশ কিছু ভেদ আছে। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি। মোদি বলছেন একটাই ধর্ম আছে, বৈষ্ণব না, শাক্ত না, শৈব না, কেবল অযোধ্যা, রাম ও মোদি। শঙ্করাচার্যরা এই বিষয়টিরই বিরোধিতা করছেন। রাহুল আমাদের বললেন, "আমরা যে নীতিতে বিশ্বাস করি তা চার্বাকের দর্শন। মার্ক্স, লেনিন, এঙ্গেলসদের বিদেশি আইডিওলজির কথা আমরা বলি কিন্তু আসলে আপনারা চার্বাকের দর্শনকেই, নাস্তিক চার্বাকের দর্শনকেই মানেন। দেশের মানুষের মধ্যে থেকেই চার্বাকের দর্শন উঠে আসে। দেশে বৌদ্ধরা হয়তো ১ বা ২ শতাংশ আছেন অথচ আমাদের যাপনে বুদ্ধের দর্শন মিশে আছে আমরা জানিই না"। রাহুল আমাদের এই জায়গাগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের আগ্রহ বাড়াচ্ছেন। কলকাতায় কংগ্রেস সম্ভবত রাহুলকে নিয়ে আসতে চায়নি। কলকাতায় যদি এই উন্মাদনা দেখে যদি শাসক তৃণমুলের সঙ্গে সংঘাত আরও বাড়ে?-রিস্ক নিতে চায়নি কংগ্রেস। কম বয়সি ছেলে মেয়েদের আগ্রহ বাড়ছে কংগ্রেসের প্রতি। এটা যথেষ্ট আশার।