বর্ধমানের রাঁধুনির গোপন রেসিপি কীভাবে জন্ম দিয়েছিল সকলের প্রিয় মোগলাই পরোটার?

আপনি যদি কলকাতায় থেকে আজ অবধি এই ঐতিহাসিক পরোটা-সফরের অংশীদার না হয়ে থাকেন, তবে আর দেরি না করে একদিন সন্ধেবেলা চিরাচরিত জলখাবারের ছন্দপতন ঘটিয়ে দিনের শুরু করুন মোগলাই পরোটা দিয়ে।

বাঙালিরা তাদের রুচি, শিক্ষা, সংস্কৃতি অথবা পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি পরিচিত তাদের ভোজনরসিকতার জন্যও। তাই তো ইদানীংকালে ভারত কিংবা বিশ্বের নানা দেশের তামাম ফুড ভ্লগাররা কলকাতার খাবারের স্বাদ আস্বাদন করার জন্য একবার করে হলেও ঢুঁ মেরে যান। অন্যদিকে আবার বাইরের দেশগুলোতে বাঙালি খাবারের অসংখ্য দোকান প্রতিনিয়ত মাথা চাড়া দিয়ে গজিয়ে উঠছে। কলকাতার অসংখ্য বিখ্যাত সব খাবারের তালিকায় একটি জনপ্রিয় খাবার হল মোগলাই পরোটা। বাইরে ময়দার পাতলা আস্তরণ, ভেতরে মাংস বা ডিমের পুর আর সঙ্গে পিঁয়াজ এবং শসার স্যালাড আর আলুর তরকারি- ভোজনরসিক বাঙালিমাত্রই এই স্বয়ংসম্পূর্ণ পরোটার সঙ্গে তারা কমবেশি সকলেই পরিচিত। কিন্তু দিল্লি থেকে এই পরোটা খাস কলকাতায় এল কীভাবে তা কখনও ভেবে দেখেছেন? যদি না ভেবে থাকেন তাহলে ঋত্বিক ঘটকের সেই ভাবা প্র‍্যাকটিস করার বিখ্যাত উক্তির অবতারণা না করে বরং সরাসরি বলেই ফেলি পরোটা-যাত্রার কথা।

মুঘল খাবার বা মোগলাই খাবার

এককথায় বলতে গেলে বলাই যায়, ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে যে-সমস্ত খাবারের নাম জড়িয়ে আছে, তাই মোগলাই খাবার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আর একটু বিশদে বলতে গেলে, মুঘল সাম্রাজ্যের যে খাবারগুলো আজকের মোগলাই খাবার হিসাবে পরিচিত, তা মূলত মধ্যযুগীয় ইন্দো-পার্সিয়ান সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। মোগলাইকে একটি আদর্শ ফিউশন খাবার বলা যেতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া এবং ইসলামিক খাদ্যগুলোর একটি সুস্বাদু সংমিশ্রণ হলো এই মোগলাই খাবার। মধ্য এশিয়ার তুরস্ক থেকে যেহেতু এই মুঘলদের উদ্ভব, তাই তুর্কি খাবারের এক বৃহৎ প্রভাব এই মোগলাই খাবারে দেখা যায়। এই খাবারগুলি বর্তমানে মূলত উত্তর ভারতের খাবার হিসেবে অধিক প্রচলিত।বিভিন্ন মশলা, বাদাম, শুকনো ফল, দুধ কিংবা কখনও কখনও আবার মালাই সহযোগে এই খাবারগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। ছোট্ট একটি কথা এখানে না বললেই নয়, ১৮৫৭ সালে দিল্লির সিংহাসন অধিগ্রহণের পরে ইংরেজরা সর্বপ্রথম এই খাবারগুলোকে ‘মোগলাই খাবার’ হিসেবে নামকরণ করেছিল।

পরোটার ইতিহাস

সব বিখ্যাত জিনিস গড়ে ওঠার পিছনেই দেখা যায় কোনও না কোনও মজার গল্প থাকে, ঠিক সেইভাবেই এই পরোটার গড়ে ওঠার পিছনেও একটি গল্প রয়েছে। মুঘল মসনদে তখন চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গির বিরাজমান। মুঘল ইতিহাসের কিছু পাতা ঘাঁটলে বোঝা যায়, সম্রাট জাহাঙ্গির খানিক শিল্পী মনের মানুষ ছিলেন। প্রতিদিনের মতোই খাওয়ার সময় রাঁধুনি কিংবা বলা ভালো, বাবুর্চি তাঁকে মাংস এবং পরোটা পরিবেশন করলে তিনি হঠাৎ-ই সেদিন রেগে যান। আর রাগ করবেনই বা না কেন? ভারতের সম্রাটের ভাগ্যে যদি নিতান্তই বর্তমানের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই একই খাবার রোজ জোটে সে কি মানা যায়! তাই তিনি তাঁর রাঁধুনিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই এই পরোটা আর মাংসের বদলে নতুন কিছু খাবার আবিষ্কার করতেই হবে। সেই সময় সম্রাটের রাঁধুনি ছিলেন বর্ধমানের আদিল হাফিজ উসমান। তা তিনিও কম বুদ্ধিমান ছিলেন না। ন'দিনের মাথায় তিনি জাহাঙ্গিরের সামনে হাজির হলেন আজকের মোগলাই পরোটা নিয়ে। সম্রাট জাহাঙ্গির তো নতুন খাবার পেয়ে ভীষণ আপ্লুত। তিনি সেদিন এতই খুশি হয়েছিলেন যে, আদিল হাফিজ উসমানকে এক হাজারএকটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েও ক্ষান্ত হলেন না, সঙ্গে আবার তাঁকে দিলেন একটি জায়গির।

আরও পড়ুন: পরমহংস রামকৃষ্ণ থেকে নেতাজি: সকলের প্রিয় তেলেভাজার দোকান ছড়িয়ে এই শহরেই

আদিল উসমান কিন্তু নিজের জীবদ্দশায় এই পরোটার রেসিপি কাউকে বলেননি, এমনকী, তিনি তাঁর ছেলেদেরকেও এই রেসিপিটি গোপন রাখতে বলেছিলেন। সেইমতো উসমানের পরবর্তী বহু প্রজন্ম এই রেসিপিটি তাঁদের কাছে মূল্যবান ধনসম্পদের ন্যায় গোপন করেই রেখেছিলেন। তারপর একদিন মুঘল যুগের অবসান ঘটল, ভারতের শাসনভার পেল ব্রিটিশরা। উসমানের উত্তরসূরিরা বুঝলেন, এই মোক্ষম সময়– আর তার পরেই পরোটার রেসিপি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কলকাতা পেল তার বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় মোগলাই পরোটা।

মোগলাই পরোটার পূর্বসূরি

আগেই বলা হয়েছে মোগলাই খাবারে তুরস্কের প্রচুর প্রভাব রয়েছে। বাংলার হিন্দু রাজাদের শাসনের পর, আনুমানিক ১২০০ থেকে ১২০২ অব্দে বাংলায় তুর্কি আক্রমণ হয় এবং বাংলার শাসনভার চলে যায় তাদের হাতেই। খিলজি রাজবংশ প্রথমে ভারতে এবং পরে দিল্লিতেও বেশ কয়েকশো বছর তাদের শাসন কায়েম রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এই সময় তুর্কিদের ‘গোজলেমে’ বলে একটি খাবারের সন্ধান পাওয়া যায়, যা খানিকটা আজকের মোগলাই পরোটার মতোই ছিল। তবে এই খাবারে বিভিন্ন স্বাদের মশলার সঙ্গে মূলত ভেড়া কিংবা গরুর মাংস পুর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বলে রাখা ভালো, এই ‘গোজলেমে’ ছিল তুর্কির ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

মহারাষ্ট্রীয় মোগলাই পরোটা

‘বাইদা রোটি’ নামে মাংস, ডিম এবং মশলার সংমিশ্রণে বানানো অন্য এক ধরনের একটি পরোটা আবার মহারাষ্ট্রে পাওয়া যেত। এটি ছিল মূলত দুপুরের খাবার।একথা আমরা সবাই জানি যে, শ্রীলঙ্কা এবং বর্মা (বর্তমানের মায়ানমার)– এই দুই দেশ দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। বর্মার, ‘পালটাস’ নামের একটি পরোটার থেকে মহারাষ্ট্রের এই ‘বাইদা রোটি’-র আগমন বলে অনেকে মনে করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, বর্মা থেকে যখন সেখানকার লোকজনরা ভারতে আসতেন, তাঁদের সঙ্গেই ভারতীয় উপকূলে ‘পালটাস’ পরোটার রেসিপি ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সেখান থেকেই এই পরোটা ‘বাইদা রোটি’ নাম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহারাষ্ট্রের উপকূলে এবং পরবর্তী সময়ে গোটা রাজ্যেই।

ভিন্ন মত

সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বেশ নিবিড় হয়েছিল। ১৬০৮ সালে সুবেদার ইসলাম খান বাংলাদেশের বর্তমান ঢাকা শহরকে মুঘল বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গিরনগর। পরবর্তীকালে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে 'ঢাকা' নামটির আবির্ভাব হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই মোগলাই পরোটার জন্ম হয়েছিল ঢাকাতেই। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে দেশভাগের ফলে সেখানকার মানুষের হাত ধরেই সেই রেসিপি কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এই তথ্যটি সত্য নয়, কারণ ১৯২৫ সালে কলকাতার অনাদি কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা বলরাম জেনা, তাঁর ছেলের স্মরণে দোকানটি স্থাপন করেন। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতার এই দোকান সগৌরবে অসংখ্য ভোজনরসিক বাঙালির কাছে একই স্বাদের মোগলাই পরোটা পরিবেশন করে চলেছে। আলুর তরকারি, স্যালাড এবং কাসুন্দি-সহযোগে গরম গরম ছোট আকারে কাটা মোগলাই পরোটা খেতে আজও ভিড় লেগে থাকে অনাদি কেবিনে। আপনি যদি কলকাতায় থেকে আজ অবধি এই ঐতিহাসিক পরোটা-সফরের অংশীদার না হয়ে থাকেন, তবে আর দেরি না করে একদিন সন্ধেবেলা চিরাচরিত জলখাবারের ছন্দপতন ঘটিয়ে দিনের শুরু করুন মোগলাই পরোটা দিয়ে।

 

 

 

More Articles