মাথায় গুরুতর চোট তাঁকে বানিয়ে দিল দ্রুততম 'ক‍্যালকুলেটর'! ভানু প্রকাশ আজ দেশের বিস্ময়

Human Calculator: কেন নীলকন্ঠ ভানু প্রকাশ দ্রুততম হিউম্যান ক্যালকুলেটরের তকমা পেয়েছেন?

'হিউম্যান ক্যালকুলেটর'- শব্দদু'টি শুনলেই বহু মানুষের শকুন্তলা দেবীর নাম মনে পড়ে। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটিকে ঘিরে অসংখ্য কাহিনি রয়েছে। তাঁর বৈচিত্র‍্যপূর্ণ জীবন নিয়ে একটি হিন্দি সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে। শকুন্তলা দেবী আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তাঁর অভাব পূরণ করতে শুরু করেছেন অপর এক ভারতীয়। বিবিসি তাঁকে গণিতের উসেইন বোল্ট আখ্যা দিয়েছে। পৃথিবীর দ্রুততম এই হিউম্যান ক্যালকুলেটরের নাম নীলকন্ঠ ভানু প্রকাশ। ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে একটি দুই অঙ্কের সংখ্যাকে নিজেদের মধ্যে সর্বাধিকবার যোগ করার রেকর্ড শকুন্তলা দেবীর নামেই ছিল। সেই রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার কারণেই নীলকন্ঠ ভানু প্রকাশ দ্রুততম হিউম্যান ক্যালকুলেটরের তকমা পেয়েছেন। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, হয়তো আজ তাঁর জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকম হতে পারত।

নীলকন্ঠ ভানু প্রকাশের জন্ম ১৯৯৯ সালের ১৩ অক্টোবর। পাঁচ বছর বয়সে একটি পথ-দুর্ঘটনায় তিনি মাথায় চোট পেয়েছিলেন। ভানু প্রকাশের পরিবার সেই সময়ে বাড়িতে তাঁর আশপাশের প্রায় সব আয়না লুকিয়ে ফেলেছিল। তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে অবসন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে এই কাজ করা হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে সেই দুর্ঘটনার ভয়াবহতার কিছুটা আন্দাজ করা যায়। মাথায় চোট পাওয়ার ফলে তাকে প্রায় এক বছর ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। সেই সময় ঘরের মধ্যে খেলার জন্য নীলকণ্ঠর পিতা শ্রীনিবাস তাঁকে বহু পাজল কিনে দিয়েছিলেন। এই বিভিন্ন রকমের পাজল নিয়ে খেলা করতে করতে তাঁর গণিতের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। সাধারণ পাজল থেকে অ্যাবাকাস এবং তারপর পাটিগণিত- নানা শাখায় নিজেকে মেলতে থাকেন তিনি।

আরও পড়ুন: বলা হত ‘হিউম্যান কম্পিউটার’, লিখেছিলেন সমকামিতা নিয়ে বই || আজও বিস্ময় এই মহিলা গণিতজ্ঞ

গণিত-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন ভানু প্রকাশ। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক হওয়ার আগেই তাঁর ঝুলিতে বহু স্বর্ণপদক এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার জমা হয়েছিল। গণিতে স্নাতক এবং অন্যান্য কৃতিত্বর কারণেই ভানু প্রকাশ বহু চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মাথায় তখন অন্য চিন্তা শুরু হয়েছিল। সেই চিন্তা ছিল মানুষের মধ্যে থেকে গণিতের ভয় দূর করা।

'পাই দিবস' পালিত হয় মার্চ মাসের ১৪ তারিখ। এই দিন এক সাক্ষাৎকারে ভানু প্রকাশ বলেছিলেন, গণিতের ভয় কাটানোর কিছু উপায়ের মধ্যে প্রথম উপায় হলো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা। গণিতের বিভিন্ন ধারণা কেন তৈরি হয়েছে, সেই সম্পর্কে জানতে পারলে গণিত বোঝা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। তাঁর মতে গণিতের অভ্যাস, বিশেষত, বিভিন্ন রকমের হিসেবের অভ্যাস শরীরচর্চার মতোই করা সম্ভব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বহু ক্ষেত্রে করা ছোট ছোট হিসাব যদি আমরা রোজ অভ্যাস করি, তাহলে গণিতের হিসেবের ভয় কিছুটা দূর হবে। এই অভ্যাস যে কোনও বয়সের মানুষ আয়ত্ত করতে পারে এবং এইভাবেই তাঁর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। তাঁর মতে, কোনও মানুষ তার আশপাশের মানুষের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাকে সে কখনও ভয় পায় না। মানুষ তার মাতৃভাষায় কথা বলার সময় আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করে না। এর একমাত্র কারণ হলো, প্রতিদিনের অভ্যাস। গণিত এবং হিসেবের ক্ষেত্রেও সেই একই পন্থা অবলম্বন করে মানুষ গণিত এবং হিসেবের ভয়কে জয় করতে পারবে। তাঁর মতে, গণিতের ভয় কাটানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। বহু চিন্তাভাবনার পর এবং নানা লোভনীয় চাকরি প্রত্যাখ্যান করে ভানু প্রকাশ ২০২০ সালে তৈরি করেছিলেন 'ভানজু'। ভানু প্রকাশের লক্ষ্য অনুযায়ী তৈরি হওয়া এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে নেটমাধ্যমে সহজে অঙ্ক শেখার একটি ঠিকানা হলো ভানজু।

ভানু প্রকাশের জীবনের তেইশ বছর পূর্ণ করার আগেই বহু মানুষ তাকে 'ম্যাথলিট' বলে অভিহিত করতে শুরু করেছে। তাঁর ঝুলিতে অসংখ্য স্বর্ণপদক ছাড়াও রয়েছে চারটি বিশ্ব রেকর্ড এবং পঞ্চাশটি লিমকা রেকর্ড। ২০২০ সালে লন্ডনে আয়োজিত গণিতের মানসিক গণনার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভানু প্রকাশ স্বর্ণপদক অর্জন করেছিলেন। 'ফোর্বস' ম্যাগাজিন তাদের থার্টি আন্ডার থার্টি-র তালিকায় তাঁর নাম রেখেছে। এই সবকিছুর মধ্যেই ভানু প্রকাশ তাঁর পুরনো এবং একটি নতুন লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন- মানুষের মধ্যে থেকে গণিতের ভীতি দূর করা ও ভবিষ্যতে বিপুল সংখ্যক গণিতে আত্মবিশ্বাসী মানুষ তৈরি করা।

তথ্য ঋণ: দ‍্য টেলিগ্রাফ, দ্য উইক, দ‍্য হিন্দু।

More Articles