বছর শেষে যা শিখিয়ে গেলেন চ্যাম্পিয়ন গুকেশ

Gukesh Dommaraju: গুকেশ, কেমন যেন মনে হয়, আপন অন্তরের এক সীমাহীন ‘আননোন’-কে খুঁজে চলেন। একটা লাগাতার ডিসকভারি চলে তাঁর মধ্যে, চরম ডিসিপ্লিনের চৌহদ্দিতে থেকেই।

এবছরের এপ্রিল, টরোন্টোয় চলছে ক্যান্ডিডেটস, অর্থাৎ বাছাই ৮ জনকে নিয়ে সেই ট্যুর্নামেন্ট, যার বিজয়ী হবেন তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ডিং লিরেন-এর চ্যালেঞ্জার, বিশ্ব খেতাবের জন্য। গুকেশ রয়েছেন, তবে ফর্ম ও রেটিং অনুযায়ী, মোটেও কারও নজর তাঁর দিকে ছিল না। ২০২৩ সালের বিশ্ব খেতাবের রানার্স-আপ ইয়ান নেপমনিশ রয়েছেন ফেভারিট রূপে, ফাবিয়ানো কারুয়ানা রয়েছেন— ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং ২, নাকামুরা রয়েছেন— র‍্যাঙ্কিং ৩, ভারত থেকেই তো প্রজ্ঞানন্দ রয়েছেন, বিদিত গুজরাতি রয়েছেন। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন যে, নেপমনিশ বা কারুয়ানা বা নাকামুরা-র মধ্যে কেউ এক ডিন লিরেন-এর সঙ্গে লড়বেন, নিদেনপক্ষে আপসেট হতেই যদি হয়, প্রজ্ঞা খেল দেখাবেন। ম্যাগনাস কার্লসেন (যিনি এ লড়াইয়ে নামেননি, জাস্ট ইচ্ছে করছে না বলে) তো বলেই দিয়েছিলেন, মনে হচ্ছে যথেষ্ট দুঃখজনক পারফরম্যান্স করবেন গুকেশ।

গুকেশ বেশ খেললেন প্রতিযোগিতায়, এবং সদ্য সমাপ্ত লিরেন-এর সঙ্গে বিশ্ব খেতাবি লড়াইয়েও যেমন দেখা গেল, কিছু সহজ পরিস্থিতিতেও তিনি মাঝেমাঝেই খেলা বের করতে পারছেন না, ঠিক তেমনটা এই ক্যান্ডিডেটস-এও দেখা গিয়েছিল। তবুও শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, ফিনিশিং লাইনের মুখে তিনি দাঁড়িয়ে। ভাগ্য নির্ভর করছিল অন্য আর একটি খেলার ওপর যদিও। শেষমেশ নেপমনিশ ও কারুয়ানার মধ্যের সেই ম্যাচ ড্র হওয়ায়, গুকেশের শিকে ছিঁড়ল।

এ লেখা অবশ্যই এই সব জানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা নয়। চাইব, এই প্রতিযোগিতার একটি বিশেষ খেলার ওপর ফোকাস করতে। ইরানিয়ান-ফ্রেঞ্চ গ্র্যান্ডমাস্টার আলিরেজ়া ফিরুজ়জা-র বিরুদ্ধে পঞ্চম রাউন্ডের খেলায় গুকেশ হেসেখেলে জিতছিলেন। তারপর যাকে বলে ‘স্ন্যাচিং ডিফিট ফ্রম দ্য জ’জ় অফ ভিকট্রি’, তেমনটাই ঘটিয়ে গুকেশ হেরে বসলেন। কিন্তু তারপর কী করলেন তিনি? এইটাই বিশেষভাবে লক্ষ্য করার। ক্যান্ডিডেটস জেতার পর তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কখন প্রথম মনে হলো তিনি জিততে পারেন, গুকেশ এই আলিরেজ়া-র সঙ্গে ভয়াবহ হারের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন, "ওই হার মেনে নিতে নিঃসন্দেহেই খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু তারপর বাকি দিনটা ঝরঝরে লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি সেরা ফর্মে আছি, খুব মোটিভেটেড লাগছিল আমার।"

আরও পড়ুন- আগামী দশ বছরে বিশ্ব দাবার রাশ ভারতের হাতেই, নিশ্চিত!

এ বার একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন, অনেক ক্ষেত্রেই, অনেকের ক্ষেত্রেই আমরা শুনেছি, একটি হার আরও চোয়াল শক্ত করে দিয়েছে তাঁদের, কিন্তু গুকেশের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে না, এটি তার চেয়েও বেশি কিছু? অন্তত আমার তো মনে হয়েছে। একটি খেলায়, অন্যের ব্রিলিয়ান্সের কাছে নতি স্বীকার করে, মনোবল বাড়িয়ে ফেরত আসা এক ব্যাপার আর অমন হাই-প্রেশার অবস্থায়, নিজের ভুলে বেকায়দায় পড়ে, হেরে, গোটা দিন ফুরফুরে মেজাজে কাটিয়ে পরের দানের আগে চনমনে থাকা, অ্যাবসোলিউটলি ভিন্ন ব্যাপার। নয় কি? আমার কাছে এটি তীব্রভাবে শিক্ষণীয়।

মানে, গুকেশ এবং তাঁর টিম বসে যখন অ্যানালাইজ় করছেন ভুলভ্রান্তি, সেটি তো জলের মতো স্পষ্ট, সে সব শুধরে নেওয়াটাও কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু টেম্পারেমেন্ট? অর্থাৎ প্রেশার সিচুয়েশনে গুকেশ কী করবেন, তা কী করে ঠিক করবে টিম? তা তো সামলাতে হবে এক মাত্র গুকেশকেই। এ সব জেনেও কিন্তু গুকেশ বলছেন, "আমার বেশ ফুরফুরে লাগছিল!" এই যে নিজের ভুল-ভ্রান্তি ভালোভাবে জেনেও, তিনি নিজের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখতে পারছেন, একবারের জন্যেও ম্যাগনাস কার্লসেন-সম ‘সুপারম্যান’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেনও না, এখানেই গুকেশ এক রক্তমাংসের চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠছেন।

দেখুন, যাঁরা জীবনটাকে বড় ক্যাজ়ুয়াল রূপে নেন, 'জো হোগা দেখা জায়েগা', অমুক তমুক, তাঁদের পক্ষে এমন স্ট্যান্ড নেওয়াটা যতটা স্বাভাবিক, গুকেশের (যিনি বোধ করি অমনটা নন) পক্ষে দ্বিগুণ কঠিন। কিন্তু গুকেশ তেমনটা ভাবছেন, থাকছেন। এমনকী, তাঁকে এই ট্যুর্নামেন্টের সময় যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে, কোন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে ভয় করছে, তাঁর সটান জবাব, "কেউ নয়।" এটা ওভারকনফিডেন্স বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ককি অ্যাটিটিউড’, আদপেই তার চিহ্ন নয়। দিস ইজ় গুকেশ। এই যে তিনি বললেন, কাউকে ভয় করে না, এ কিন্তু অন্যকে অসম্মান করা নয়, এ হলো নিজের প্রতি নীরব এক আস্থা। এ এক আশ্চর্য পরিপক্কতা।

আরও পড়ুন- নেশার খেলা থেকে স্নায়ুর যুদ্ধ, জীবনকে মাপছে দাবা

গুকেশ, কেমন যেন মনে হয়, আপন অন্তরের এক সীমাহীন ‘আননোন’-কে খুঁজে চলেন। একটা লাগাতার ডিসকভারি চলে তাঁর মধ্যে, চরম ডিসিপ্লিনের চৌহদ্দিতে থেকেই। তাই তো তিনি এমন সব মুভ খেলেন, যেগুলো বড়ই আন-অর্থডক্স, অপ্রচলিত। ক্যান্ডিডেটস-এ নাকামুরার সঙ্গে ফাইনাল গেমেও গুকেশ মাত্র পঞ্চম দানটিই তেমন এক চাল দিয়েছিলেন। খেয়াল করবেন, এই ম্যাচটি তাঁকে জিততেই হতো কিন্তু। নাকামুরাও তখন বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে ৩। আবার বলছি, গুকেশ 'জো হোগা দেখা জায়েগা' গত্রের মানুষ নন। তবুও, গুকেশ এ কাণ্ড করছেন। তাঁর সেকেন্ড, অর্থাৎ ট্যুর্নামেন্টে বিশেষ সহকারী গাজুস্কি, এমন সব দানে বিশেষ পটু। ফলে প্র্যাক্টিসে আইডিয়া পাওয়াটা হয়তো সহজ কিন্তু অ্যাকচুয়াল ম্যাচ কন্ডিশনে সেটির প্রয়োগ, হাতের মোয়া? অন্তত গুকেশের কাছে তো তা-ই, বোধ হচ্ছে। এবং এজন্যই কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে, গুকেশ হিসেব কষে শিখরের দিকে হেঁটে যাওয়ার মধ্যেই ওই ভিতরমহলের অপার অজানাকেও হাতড়ে নিচ্ছেন। শখের জন্য নয়, হয়তো তাঁর কল্পিত গুকেশ-রূপে পৌঁছনোর জন্য। গুকেশ ভবিষ্যতে যাই করুন না কেন, অন্তত আমায় তিনি আরও একবার আশ্বস্ত করে গেলেন যে, সুনামির মতো ধেয়ে আসা এআই-যুগেও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকবে রক্ত-মাংসের, ভুলে ভরা এক হিউম্যান যে কার্লসেনসম সুপারম্যান নয়, বয় নেক্সট ডোর এক বান্দা, যে কখনও-সখনও তাক লাগিয়ে দেওয়া এমন সব ইনিংস খেলে, যে সুপারম্যান কার্লসেনকেও বলতে হয় — গুকেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ (নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধরছেন বোধ করি!) প্লেয়ার হওয়ার যোগ্যতা রাখে, হয়তো কোনওদিন শ্রেষ্ঠও হয়ে যেতে পারে!

গুকেশও লিরেনকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নির্দ্বিধায় বলেন — "আমি জিতলাম বলে আমিই শ্রেষ্ঠ এমনটা নয়, ম্যাগনাস রয়েছেন।" কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, গুকেশ ম্যাগনাসের তাচ্ছিল্যকেও যেমন খুব একটা গুরুত্ব দেবেন না, প্রশংসাকেও নয়, বরং তিনি নিশ্চিতভাবে ম্যাগনাসের সঙ্গে কোনও এক লড়াইয়ে সবাইকে ফের স্তম্ভিত করে কোনও অপ্রত্যাশিত দান দিয়ে ভেতর ভেতর আবার সেই ‘আননোন’-কে খুঁজতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়বেন। লক্ষ্য নিঃসন্দেহেই শিখর, প্লেয়িং ওনলি ফর দ্য সেক অফ লাভ নয়, কিন্তু গুকেশ মনে হয় বিশ্বাস করেন না ‘এরর-ফ্রি’ এক অবস্থানে, এটিই গুকেশ আমায় শিখিয়ে যান। সেই দ্রাবিড় বলেছিলেন না — ব্যর্থতাকে ভয় পেলেই বিপদ, ব্যর্থ হতে হবে আমাদের, বড় নিপুণভাবে ব্যর্থ হতে হবে, নইলে কাজের কাজটিই যে হবে না! গুকেশও সেই একই ইশারা করে যান বোধহয়।

More Articles