শতবর্ষে বোসন: তাঁর আবিষ্কারেই বিশ্বজয় বিজ্ঞানীদের! কেন নোবেল পেলেন না সত্যেন্দ্রনাথ?

Centenary of Boson Particle: অজানা, অচেনা এক বিজ্ঞানীর কাছ থেকে পত্র পেয়ে আইনস্টাইন বিব্রত হননি, বরং অভিভূত হয়েছিলেন সত্যেন বোসের চিন্তা করার ধরন দেখে

পৃথিবীবিখ্যাত এক রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানীর পাগলামির কথা দিয়ে শুরু করা যাক। পদার্থবিদ, লেভ ল্যান্ডাও নাকি পকেটে একটা বিজ্ঞানীদের তালিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তৎকালীন বিজ্ঞানীমহল খুবই আগ্রহী, কার কার নাম আছে সেখানে? পরে জানা যায়, আইনস্টাইন, নিউটনের নাম আছে একদম প্রথম দিকে, তারপরে আছে বোর, প্লাঙ্ক, পাওলি, হাইজেনবার্গ, প্রমুখ দিকপালদের সঙ্গে সত্যেন বোসের নাম। নোবেলজয়ী ল্যান্ডাও তাঁর নিজের নামও রেখেছেন সেই তালিকায়, কিন্তু সত্যেন বোসের বেশ কয়েক ধাপ নীচে।
পরাধীন ভারতে, দেশজুড়ে যখন প্রবল অস্থিরতা, এক বাঙালি যুবক তখন ডুবে আছেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার অসীম সাগরে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, নিত্য নতুন আবিষ্কার প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে পদার্থবিদ্যার বোঝাপড়া। আইনস্টাইন তাঁর কালজয়ী সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করে ফেলেছেন ১৯১৫ সালে। অদ্ভুত, অথচ নির্ভূল এ তত্ত্বের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীরা, এরই মধ্যে আলোর দ্বৈত প্রকৃতি তখন ব্যস্ত করে তুলেছে পৃথিবীসেরা মাথাদের। তরঙ্গ সত্তার পাশাপাশি, আলোর কণা সত্তাও ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের, তরুণ সত্যেন্দ্রনাথও ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছেন এই মায়ায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, পদার্থবিদ্যা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। বিশেষত ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ আবিষ্কারের পর থেকে আর কোনও বিশেষ কাজ বাকি নেই। শুধু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। বিশেষত বিজ্ঞানী কির্চফের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সম্পর্কিত প্রশ্ন। কী সেই কৃষ্ণবস্তু? এ এক অবাক বস্তু! বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো এর উপর এসে পড়লে সেটা নির্বিকারে শুষে নেয়, আবার পর্যাপ্ত উত্তপ্ত হলে ওইসব আলো বিকিরণ করে। কির্চফ তাত্ত্বিকভাবে দেখালেন যে, এই কৃষ্ণবস্তু থেকে নির্গত বিকিরণের শক্তির ঘনত্ব কেবলমাত্র তার কম্পাঙ্ক ও কৃষ্ণবস্তুটির উষ্ণতার উপর নির্ভর করে, সেটি কী দিয়ে তৈরি বা কত বড়, তার উপর নির্ভর করে না। তা না হলে অবিরাম গতিশীল যন্ত্র তৈরি করা যেত, কিন্তু তাপগতি বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে সেটা কখনই সম্ভব নয়। এবার আসি কির্চফ সাহেবের প্রশ্নে — এই যে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ, তার গাণিতিক প্রকাশ ঠিক কেমন হবে? তৎকালীন সময়ে এই উত্তর দেওয়া সোজা ছিল না কারণ আদর্শ কৃষ্ণবস্তু তৈরির ঝামেলা ছিল, বিকিরণ মাপার যন্ত্রও তখন বিরল, আর এই বিভিন্ন কম্পাঙ্কের রশ্মি নিয়ে কাজ করার মতো সূক্ষ যন্ত্রপাতি তখনকার দিনে পাওয়াও দুষ্কর। তাই অনেকেই চেষ্টা করলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া তাত্ত্বিকভাবে যদি কির্চফের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। অবশেষে ভিন ও লর্ড র‍্যালে আবিষ্কার করলেন দু'টি সূত্র, স্বাধীনভাবে। প্রথমটি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বিকিরণের বেলায় খাটে, পরেরটি তৈরি হয়েছে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যর কথা মাথায় রেখে। এই দুই সূত্রের ভিতরে সমন্বয় সাধন করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী প্ল্যাঙ্ক।

এই কাজে প্ল্যাঙ্ক সনাতনী পদার্থবিদ্যাকে পাশ কাটিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে দাবি করেন যে, বিকিরণের সময় শক্তির পরিবর্তন কখনও নিরবিচ্ছিন্ন হয় না, হয় প্যাকেট-প্যাকেট আকারে, যার পারিভাষিক নাম, 'কোয়ান্টা'; শক্তির নতুন একক। অর্থাৎ কৃষ্ণবস্তু এক নাগাড়ে আলো বিকিরণ করবে না, করবে থেমে থেমে, অনেকটা বিদ্যুতের ঝলকের মতো। এই সময় বিকিরণ কণার মতো আচরণ করে, বিজ্ঞানীরা যার নাম দিলেন 'ফোটন'। এই নতুন ধারণা জন্ম দেয় কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার। শক্তির বেলায় এই রকম খাপছাড়া ধারণা আবার সনাতনী পদার্থবিদ্যায় বেসুরো ঠেকে। তাই প্ল্যাঙ্ক ধরে নিলেন, এই শক্তি কণাদের বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, এরা শক্তির শোষণ ও নিঃসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মাত্র।

আরও পড়ুন- নোবেলের জন্য চার বার মনোনয়ন! বাংলাতেই তবু জাতের লড়াইয়ে কোণঠাসা ছিলেন মেঘনাদ সাহা

কিন্ত সেই সময়কার বেশ কিছু দিকপাল প্লাঙ্কের ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারলেন না। কোথাও যেন একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। কয়েক বছর পর, আইনস্টাইন দেখলেন, ধাতুর ওপর পর্যাপ্ত শক্তির আলো ফেললে ইলেক্ট্রন বেরিয়ে আসে (আলোকতড়িৎ ক্রিয়া)। আইনস্টাইনের এই আবিষ্কার, আলোর কণা ধর্মের পায়াকেই ভারী করে। সহজে এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি তৎকালীন বিজ্ঞানমহল দেয়নি। বিশেষত বেঁকে বসেন বোর, মিলিকান, নার্নস্ট প্রমুখ বিখ্যাত দিকপালরা, কারণ এই তত্ত্ব আলোর ব্যতিচারের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। দীর্ঘ প্রায় দু'দশক পরে, কম্পটনের পরীক্ষাতে আবার আলোর কণা সত্তারই প্রমাণ মিলল। ওদিকে ডিবাইও ততদিনে এই কণাবাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য যুক্তি খাড়া করে ফেলেছেন। বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃতি পেল কণাবাদ তথা আইনস্টাইনের অলোক তড়িৎক্রিয়া। সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু গণ্ডগোল বাঁধল কণার মধ্যে শক্তি বন্টন নিয়ে, কারণ একই উষ্ণতায় অনেক অণু থাকলেও তারা সমগতির হবে, সে দিব্যি কেউ দেয়নি। সত্যেন্দ্রনাথও জড়িয়ে পড়লেন সেই অদৃশ্য ভ্রমজালে। উষ্ণতা ভেদে গতির তারতম্য কেমন হয়, তার একটা হিসেব বোলৎসমান পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে সত্যেন্দ্রনাথ চেষ্টা করলেন ফোটনের ধারণা বিবেচনা না করে প্ল্যাঙ্কের সূত্র প্রমাণ করা যায় কিনা? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়াতে গিয়ে একটা খটকা লাগে তাঁর কাছে। এ বিষয়ে বন্ধু মেঘনাদই ব্যাপারটা প্রথম তাঁর নজরে এনেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি সফল হয়েছিলেন সনাতনী পদার্থবিদ্যার আলোক কণিকার ধারণা থেকেই প্ল্যাঙ্কের সূত্র প্রমাণ করতে। তিনি কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের ফোটনগুলির সম্ভাব্য বিভিন্ন মানের শক্তিকে ছোট ছোট শক্তিস্তরে ভাগ করলেন। ফোটনের দশা-দেশকে (অবস্থান ও ভরবেগ গঠন কাঠামো) অনেক ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিলেন। প্রত্যেক ভাগের নাম দিলেন 'কোষ' বা 'সেল', যাদের আয়তন h3 (h যেখানে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক)। এভাবে প্রাপ্ত কোষের সংখ্যাকে দু'গুণ করলেন তিনি, কারণ ফোটনের সমাবর্তন। প্রতিটি কোষকেই এক একটি অবস্থা বা স্টেট ধরেন সত্যেন্দ্রনাথ। আগে পদার্থবিজ্ঞানীরা এই অবস্থার সংখ্যা গণনা করতেন তড়িৎ গতিবিদ্যার সাহায্যে, আর বিকিরণকে তরঙ্গ হিসেবে ধরে গণনা করতেন তাঁরা। সত্যেন্দ্রনাথই প্রথম কণাবাদের সাহায্যে এই গণনা করতে সক্ষম হন। মোদ্দা কথা, প্ল্যাঙ্ক ফোটনকে ভেবেছিলেন অখণ্ড শক্তিকণা হিসাবে। বোস সেটাকেই কল্পনা করলেন বস্তুকণা রূপে। প্রকাশের জন্য সেটারই একটা নির্যাস পাঠান তৎকালীন বিখ্যাত 'ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিন'-এ। অনামি লেখকের প্রবন্ধ অনেক সময় নজরে পড়ে না জার্নাল কর্তৃপক্ষদের, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হলো না। সত্যেন্দ্রনাথ অবশেষে বন্ধু জ্ঞানচন্দ্রকে জানালেন ঘটনাটা। প্রবন্ধ দেখে জ্ঞানচন্দ্রই প্রস্তাব দিলেন প্রবন্ধটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠাতে। সত্যেন্দ্রনাথ অনুলিপি হিসাবে এক কপি পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। সঙ্গে জুড়ে দিলেন একটি চিঠি -

" Respected Sir
...I have tried to deduce the coefficient of planck's law independent of classical electrodynamics..I do not know sufficient German, to translate the paper. If you think the paper worth publication O shall be grateful if you arrange for its publication in zeitchrift fur Physik..."

অজানা, অচেনা এক বিজ্ঞানীর কাছ থেকে পত্র পেয়ে আইনস্টাইন বিব্রত হননি, বরং অভিভূত হয়েছিলেন সত্যেন বোসের চিন্তা করার ধরন দেখে। তড়িঘড়ি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠিয়ে দেন zeitchrift fur physic পত্রিকায় ও একটি পোস্ট কার্ড পাঠান বোসকে। অবশেষে ছেপে বেরোল বোসের কাজ 'প্ল্যাঙ্কস সেটজ অ্যান্ড লিচকন্টেন হাইপোথিস' নামে। তৈরি হলো বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স, যা সারা দুনিয়ায় 'বি. ই. স্ট্যাট' নামেই খ্যাত। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সত্যেন্দ্রনাথ।

প্রতিটি পরমাণুর ভিতরে এক মজ্জাগত ঘূর্ণি বিদ্যমান থাকে, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন 'ইনট্রিনজিক স্পিন'। বৃত্তাকার পথে ঘোরার পাশাপাশি, কণাগুলি নিজের অক্ষের চারপাশেও ঘুরপাক খায়, সেটাই ঘূর্ণি বা 'স্পিন'। অঙ্ক কষে সেই ঘূর্ণির পরিমাপ করা যায়। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর গণনায় কণার স্পিন নিয়ে কিছু ভাবেননি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে কণার স্পিন এক বিশেষ ধর্ম। ডিরাক দেখিয়েছিলেন, যাদের ঘূর্ণন কোয়ান্টাম নম্বর শূন্য বা পূর্ণ সংখ্যার সরল গুণিতক, তারা বোসের পরিসংখ্যান মেনে চলে, আর যাদের বিজোড় সংখ্যার গুণিতক তারা সকলে ফার্মির সংখ্যায়ন মেনে চলে। লাজুক বিজ্ঞানী ডিরাক প্রথম জাতের কণাদের নাম দেন 'বোসন', আর পরের গুলোকে 'ফার্মিয়ন' (প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মির নাম অনুসারে)। যেমন, ইলেকট্রনগুলি হলো ফার্মিয়ন, আর ফোটন-বোসন। জগৎ এই দুই জাতের কণা দিয়ে গড়া। অনেকগুলো বোসন একজায়গায় মিলে মিশে থাকতে পারে কিন্ত ফার্মিয়ন কাউকে সহ্য করে না, ওর একার জন্যই একটি ঘর চাই। এমনি কোয়ান্টাম তত্ত্বে শক্তির ধারণা নিরবিচ্ছিন্ন নয়। মানে স্তর ভেদে শক্তির মান পাল্টায়। ধরা যাক, কোনও একটি স্তরে (বোঝার সুবিধার্থে আমরা বহুতল বাড়ির কোনও একটি তল ভাবতে পারি) অনেকগুলো ফোটন থাকতে পারে কিন্ত ইলেকট্রন একটিই থাকবে, তারা যেহেতু পাওলির অপবর্জন নীতি মেনে চলে। খুবই নিম্ন তাপমাত্রায় (চরম শূন্যের কাছাকাছি) বোসনগুলো সর্ব নিম্নস্তরে নেমে আসে, তখনই পদার্থের পঞ্চম অবস্থা, 'বোস- আইনস্টাইন ঘনীভূত দশার' সন্ধান মেলে। এই ঘটনার নামই 'বোস আইনস্টাইন ঘনীভবন'। পরে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যায়, হিলিয়াম-৪ এর অতি তারল্য ও কিছু ধাতুর অতিপরিবাহিতার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই বোস-সংখ্যায়ন।

আরও পড়ুন- মহাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত পদার্থ! কী দিয়ে তৈরি এই ডার্ক ম্যাটার?

কেবল বোস সংখ্যায়নই নয়, পরবর্তীতে সত্যেন্দ্রনাথ কাজ করেছেন বিভিন্ন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান, জৈব পদার্থবিজ্ঞান ও কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। চল্লিশের দশকে, তিনি কাজ করেছেন আয়নমণ্ডল, ক্লেইন-গর্ডন সমীকরণ ও ডিরাক সমীকরণ নিয়ে। দেশভাগের পরে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে এলেন, তখন ক্লাসের গঠন নিয়ে কাজ করেছেন ছাত্রদের সঙ্গে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বমানের গবেষণা করার পরেও পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময় তাঁর আগ্রহের বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। তাঁরই উৎসাহে এবং উদ্দীপনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম এক্স-রে ক্যামেরা সহযোগে কেলাসের গঠন সম্পর্কিত কাজ হয়। শেষ জীবনেও চিন্তা করে গেছেন গ্র্যান্ড ইউনিফাইড থিওরি বা ক্ষেত্র একত্রীভূত তত্ত্ব নিয়ে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আইনস্টাইনও কাজ করে গেছেন এই তত্ত্ব নিয়ে।

শুধু বিজ্ঞান গবেষণায় নয়, বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। জীবনের শেষ দিন অবধি চেষ্টা করে গেছেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রচার ও প্রসারে। শেষ বয়সে, শরীরে না কুলোলেও মনের জোরেই ছুটে যেতেন বাংলা তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জনমানসে বিজ্ঞান সচেতনতা গড়তে বছর, বছর আয়োজনের চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞান মেলার। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান গবেষণার খবরাখবর ছড়িয়ে দিতে 'জ্ঞান-বিজ্ঞান' পত্রিকা প্রকাশ তাঁর জীবনের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ কাজ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কথা শুনলে, অনেকেই যখন নাক শিঁটকান, তখন কানে ভাসে তাঁর সেই বিখ্যাত কথা— "যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তাঁরা হয় বিজ্ঞান জানেন না, না হয় বাংলা জানেন না"। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। 

১৯৭৪ সালে দেশজুড়ে যখন বোস সংখ্যায়নের ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে তোড়জোড় চলছে, সত্যেন্দ্রনাথ সেই সময় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। সেই থেকে আজও বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত দশা বা বোসন কণা নিয়ে যখনই পদার্থবিদরা কোনও কাজ করেন, তখনই সত্যেন্দ্রনাথ জীবিত হয়ে ওঠেন। ১৯৯৬ সালে তিন মার্কিন পদার্থবিদ— লি, রিচার্ডসন, এবং ওসারফ হিলিয়াম-৩ আইসোটপের অতিতারল্য আবিষ্কারের জন্য নোবেল পান, যেটি আসে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন থেকেই। পরের বছরই আবার তিনজন (চু, ফিলিপস ও কোহেন তানোজি) নোবেল পান, লেজার আলো দিয়ে পরমাণিকে ঠান্ডা করার মতো এক যুগান্তকরী কাজের জন্য, যেটি বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনকে পুরোপুরি সমর্থন করে। কয়েক বছর পর, কেটারলির সঙ্গে কর্নেল ও ওয়াইনম্যান পরীক্ষাগারে খুবই নিম্ন তাপমাত্রায় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত দশার সন্ধান পান। নোবেল কমিটি ২০০১ সালে তাঁদের এই যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। আবার ২০১২ সালে, 'হিগ্‌স বোসন' আবিষ্কারের জন্য ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী পিটার হিগ্‌স ও বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ইংলার্টের ঝুলিতেও আসে নোবেল। শুধু কি তাই? কণাদের পরিসংখ্যান বলবিদ্যা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভিত্তি যাঁদের হাতে গড়ে উঠেছিল, যেমন প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন, ডিরাক, ফার্মি সকলেই নোবেল পেলেন, কেবল সত্যেন বোস ছাড়া। একে দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে! যদিও কণা জগতের অর্ধেকই তো 'বোসন'!

More Articles