ক্ষুদ্র হিন্দুত্ব ও ক্ষুদ্র সেকুলারের বিতর্কে বিবেকানন্দকে ফেলা যাবে না

Swami Vivekananda: যেহেতু বাগ্মী সন্ন্যাসী হিসেবে নানা সময় নানা নিদান দিতে হয় সেহেতু কখনও একথা, কখনও ওকথা। যেন নিরুপায় হয়েই পথ অনুসন্ধান করছেন।

হ্যাঁ ঊনচল্লিশ বছরে প্রয়াত যুবক-সন্ন্যাসীর কথা পাশাপাশি রাখলে স্ববিরোধ খুঁজে পাওয়া যাবে। যাঁরা বিবেকানন্দের লেখা মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা জানেন, তাঁর লেখার মধ্যে ভীষণ ছটফটে-টগবগে প্রাণবন্ত ভাব। মানুষটি বাগ্মী। বাগ্মী মানুষটি ইংরেজি চমৎকার বলেন, এছাড়া হিন্দি-সংস্কৃত-বাংলা তো আছেই। উর্দুও জানেন খানিক আর ফরাসিও কিছু রপ্ত করেছিলেন। এই টগবগে মানুষটি ধর্মের বস্ত্র ধারণ করেছিলেন, সন্ন্যাস নামক মার্গটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছিলেন। সন্ন্যাস তাঁর কাছে কাজ করার উপায়, নিজের জন্য নয় দেশের জন্য কাজ। আর বিপত্তি সেখানেই। দেশের রূপ কেমন হবে? সংসার-পরিবার এসবের চেহারাই বা হবে কেমন? উনিশ শতকে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে কী তাঁর মতামত? মেয়েদের কেমন করে দেখতে চান তিনি? এসব নানা বিষয়ে নানা সময়ে নানা ভাবনা – বলেছেন, লিখেছেন। লিখেছেন বাংলায়, বলেছেন ইংরেজিতে। ইংরেজি বলাগুলির লেখরূপ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া আছে বাংলার মতো ইংরেজিতে লেখা চিঠিপত্র। তাঁকে বুঝতে গেলে এই যাবতীয় লেখাপত্র কালানুক্রমে সাজিয়ে নেওয়া উচিত। তারপর চিন্তাসূত্র বিচার করা জরুরি। অর্থাৎ আগে যা বলছেন পরে তা শুধরে নিচ্ছেন কি? রবীন্দ্রনাথ যেমন দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন বলে আগের অনেক বলা পরে শুধরে নিয়েছেন। নিজের অনেক কাজ পরে সংশোধনে সচেষ্ট হয়েছেন। গান্ধী বলতেন তিনি আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদী। তাঁর আগের বলা কথা নয় পরের বলা কথাই গ্রহণ করতে হবে। তাঁর অন্তরের অনুভূতিই তাঁর পথ প্রদর্শক।

বিবেকানন্দের বাজার-চলতি যে লেখাপত্র পাওয়া যায় তা কালানুক্রমে সাজানো নয়। এই কাজটি তাঁকে অনুসরণ করার জন্য সবার আগে করা চাই। তারপরেও দেখা যাবে একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার যেন দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তখনও তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় উপনীত হননি। চিঠিতে লিখছেন, "তুমি দাসী কেন লিখিয়াছ? বৈশ্য ও শূদ্রেরা দাস ও দাসী লিখিবে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় দেব ও দেবী লিখিবে। ... কে কাহার দাস? সকলেই হরির দাস।" শোলাপুর প্রবাসিনী জনৈক বাঙালিনী শিষ্যাকে লেখা এই চিঠির বয়ান যদি খেয়াল করা যায়, তার মধ্যে কি একরকম স্ববিরোধিতা নেই! আছে তো! বর্ণাশ্রমের বিচারে কারা দাসী আর কারা দেবী লিখবেন তা নির্দেশ করছেন। পরক্ষণেই লিখছেন সকলেই হরির দাস। চৈতন্যদেব হরিভক্তিপরায়ণ চণ্ডালকে ব্রাহ্মণের থেকে শ্রেষ্ঠ বলে নির্দেশ করেছিলেন। এখানে বিবেকানন্দ হরির দাস কথাটি বলেছেন। গান্ধী পরে ব্যবহার করবেন হরিজন শব্দটি। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দ যখন প্রয়াত হলেন তখন রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রম সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও রবীন্দ্রনাথ বর্ণব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার মতো বিপ্লব তখন ঘটাতে পারেননি। ক্রমে শান্তিনিকেতনের ব্যবস্থা উদার হয়েছে। বিবেকানন্দ কায়স্থ সন্ন্যাসী, এ-বিষয়ে তাঁকে নানা কটুকথা শুনতে হয়েছে। তার উপরে আবার কালাপানি অতিক্রম করেছেন। ফলে ভারতবর্ষের সমস্ত মন্দিরে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল না। যে বিবেকানন্দ নিজেই বর্ণভেদের শিকার তিনি তাহলে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য-শূদ্র ইত্যাদি ভাগ করছেন কেন? যিনি, মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখার সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন জাতির হুঁকোয় মুখ দিয়ে জাত-বিচার আছে কি নেই কিম্বা জাত যায় কি না তা বুঝতে চাইছেন তাঁর কেন এমন পত্র!

আরও পড়ুন- বাংলায় রেনেসাঁসের ধারাকে আটকে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ | মুখোমুখি আশীষ লাহিড়ী

বিবেকানন্দের স্ববিরোধ সেই সময়ের ও এই সময়ের অনেকের মতোই সমাজ নামক সংগঠনটিকে কতটা ভাঙা যায় বা যায় না এই প্রশ্নের উপরে দাঁড়িয়ে। যেহেতু বাগ্মী সন্ন্যাসী হিসেবে নানা সময় নানা নিদান দিতে হয় সেহেতু কখনও একথা, কখনও ওকথা। যেন নিরুপায় হয়েই পথ অনুসন্ধান করছেন। এর মধ্যে মতলববাজি নেই, সময়ের নিরুপায়ত্ব আছে। আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে তাঁকে আমরা পুজো করি এবং আধ্যাত্মিক গুরুর কাছ থেকে আপ্তবাক্য শুনতে চাই বলে তাঁর চিত্তের টানাপড়েনটিকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁকে ভণ্ড সাধু বলে চিহ্নিত করার নানা অপপ্রয়াস। কথা ও কাজের মধ্যে মিল নেই বলে দাগিয়ে দেওয়া।

এর বাইরে গিয়ে বিবেকানন্দের কথা বলা ও লেখা যদি কালানুক্রমে পড়ি তাহলে টের পাওয়া যাবে, মানুষটি হৃদয়বান। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে এমন অনেক নারীর পরিচয় পাওয়া যায় যাঁরা এক অর্থে উদার-মানবিক, অন্যদিকে আবার রক্ষণশীল। শরৎচন্দ্র সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে চাননি, তার মধ্যে থেকেই কাঠামোটিকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। সে ভূমিকা বিবেকানন্দও গ্রহণ করেছিলেন। উৎসাহের এই আতিশয্য ও তীব্রতা নজরুলের মানবিকতার মধ্যেও দেখা যায়। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, বিবেকানন্দ কোনও হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। বরং তাঁর কথার মধ্যে এমন অনেক উপাদান আছে যা মানবিকতার সত্যকে তুলে ধরে। বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সেই বিষয়গুলি খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমচন্দ্রকে এখনকার উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অংশীদাররা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে চাইবেন। তাঁদের সেই কাজে আমরা সুবিধে করে দেওয়ার জন্য বিবেকানন্দকে ছেড়ে দেব না। বরং আরও মন দিয়ে তাঁর লেখা পড়া উচিত। কোনও প্রতিষ্ঠানের সূত্রে নয় – বিবেকানন্দের লেখার শর্তেই তাঁকে তাঁর যাবতীয় স্ববিরোধ ও মানবিক আবেগ নিয়ে পড়তে হবে। কুয়োর ব্যাঙের হিন্দুত্ব ও কুয়োর ব্যাঙের ধর্মনিরপেক্ষতার বাইরে গিয়ে তাঁর চিন্তার ইঙ্গিত ও ইশারা পড়া দরকার। ১৯০২। তাঁর প্রয়াণ বছর। ভারতীয় চিন্তকদের চিন্তাপ্রণালী লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই মানুষটি পাশ্চাত্যে ভারতবর্ষের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছেন – দেশ-কালের সূত্রে বিদেশে নিজের দেশকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু কৌশলের সাহায্যও নিয়েছিলেন। ধর্মজীবন তাঁর অঙ্গাঙ্গী হয়ে উঠেছিল বলেই বোঝাপড়া কঠিনতর হয়ে পড়ে।

সবচেয়ে বড় কথা এই হৃদয়বান, উদ্যমশীল মানুষটি সেই সময় স্বাদেশিক আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন। ক্ষুদ্র হিন্দুত্ব ও ক্ষুদ্র সেকুলারের বিতর্কে তাঁকে ফেলে সাধারণ সামাজিক মানুষের ক্ষতি হবে। বিশেষত তাঁর শেষ জীবনের যাপনদৃশ্য যা চিঠিতে ধরা পড়েছে তা পড়লে বোঝা যায় তিনি যেন নিজেই নিজের কাজের পুনর্বিচার করছেন। তখন তো সময় ফুরিয়ে গেল। প্রিয় হাঁস আর ছাগল, মঠের শ্রমিকদের সঙ্গ ফেলে চলে গেলেন। নিবেদিতার কেঁদে কেঁদে চোখ লাল হয়ে গেল। এ দেশেই থেকে গেলেন। এদেশের স্বাদেশিক মর্যাদাবোধের জাগরণে আত্মনিয়োগ করলেন।

More Articles