বিবেকানন্দকে সমালোচনায় রক্তাক্ত করেছিল বাঙালিরাই
Swami Vivekananda: বহু লোক এখনও বলেন যে, স্বামীজি 'কনট্রাডিক্টরি'। আসলে তারা কনটেক্সটকে পড়েন না। কনটেক্সট মাথায় রেখে যদি পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে তিনি একেবারেই কন্ট্রাডিক্টরি নন।
স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরেও তাঁর বিরুদ্ধে যে তীব্র সমালচনা বাঙালিরা করেছিল, সেটি শেষ হয়নি। অমৃতবাজার কাগজ তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিল, 'দ্য মিট ইটিং স্বামীজি অফ বেলুড় ইজ ডেড'। যেন, আর কিছু কাজ তাঁর ছিল না, মাংস ভক্ষণ ছাড়া। স্বামীজির প্রথম সমালোচনা শুরু হয় আমেরিকাতে শিকাগো ধর্ম মহাসভার পরে। শিকাগো ধর্ম মহাসভার ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিতে পারেননি প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। স্বামীজি চিঠিতে সেটি লিখেছেন, "সেবার ছিল মজুমদারের পালা এবার আমার। আমি কী করতে পারি?” হিংসার ডুবে গিয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতা। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন, স্বামীজিকে ছাত্রজীবন থেকেই চিনতেন কিন্তু ওইভাবে শিকাগোয় তিনি জনপ্রিয় হবেন, সেটি প্রতাপ মজুমদার ভাবেননি। তিনি নানা কুৎসা শুরু করেন। এমনকী স্বামীজির মাকে নিয়েও নানা কুৎসা করতে থাকেন। বেশ কিছুদিন সেই কুৎসা চলেছিল তবে বেশিদিন তা এগোতে পারেনি কারণ স্বামীজির সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা দেখেছিলেন, প্রতাপ মজুমদার যা যা বলেছিলেন তা সর্বৈব মিথ্যা।
পরিব্রাজক নরেন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন প্রমদাদাস মিত্রকে। তিনি কাশীতে থাকতেন। বেদান্তের মহাপণ্ডিত ছিলেন এবং স্বামীজিকে নানাভাবে তিনি দিশা দেখিয়েছিলেন। প্রমদাদাস মিত্র, স্বামীজি যখন প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরলেন, তখন বিরূপ হলেন স্বামীজির প্রতি। তিনি বলতে শুরু করলেন, স্বামীজি শাস্ত্রের ভুল ব্যখ্যা দেন। বললেন, "কালাপানি পার হয়েছে কী অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েছে কে জানে!” আর বলতে লাগলেন, "নিজেই সন্ন্যাস নিয়েছে। কায়স্থের ছেলে। ওর সন্ন্যাসের কোনও অধিকার নেই"। স্বামীজি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। একটি চিঠিতে স্বামীজি লিখেছিলেন, "আপনি বলছেন ঠিক আছে কিন্তু আমি কোনওরকমের ভণ্ডামি পছন্দ করি না। কারণ এই সব মানুষেরা মুখে যদিও সর্বদা 'সবই ব্রহ্মের প্রকাশ' বলতেন কিন্তু মন থেকে সব মানুষকে মেনে নিতে পারতেন না।"
বিবেকানন্দ যেভাবে শরবিদ্ধ, রক্তাক্ত হয়েছেন তা কল্পনা করা যায় না। যখন স্বামীজি ফিরেছিলেন, ঠাকুরের তিথি বুঝে তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাঁর কাছে বিরাট শিক্ষাক্ষেত্র। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে সেখানেই জীবন দেখিয়েছেন। তিনি কিছুক্ষণ থাকেন এবং তারপর চলে আসেন। তারপর মথুরবাবুর পরিবারের ত্রৈলক্যনাথ বিশ্বাস স্টেটসম্যান কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেন, “আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাইনি। তিনি নিজেই এসেছিলেন এবং নিজেই কিছুক্ষণ পরে চলে যান।" স্বামীজির দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। ঠাকুরের জন্মোৎসব আর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পালিত হতো না। সেটি পালিত হতো অন্যত্র, দাঁ-দের বাড়িতে। এর অনেকদিন পরে দক্ষিণেশ্বরে স্বামীজির স্ট্যাচু বসল কারণ বর্তমান প্রজন্মের যাঁরা আছেন, তাঁরা সেই পাপস্খলন করতে চেয়েছেন। যে অপমান বিবেকানন্দকে সহ্য করতে হয়েছিল সেটি আর কহতব্য নয়। মাত্র ৩৯ বছর বেঁচেছিলেন। এই দেশের মানুষকে বোঝাতেই তাঁর অসুবিধা হয়েছিল যে, তিনি বিদেশে বিলাসিতার জন্য যাননি। গিয়েছিলেন দেশের দর্শন, দেশের মানুষ, দেশের ইতিহাসের কথা প্রচার করতে। হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে তিনি ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে লিখেছিলেন, “আমি কিন্তু এখানে কোনও মৌজ করতে আসিনি। এসেছি ভারতবর্ষের কথা প্রচার করতে কারণ ভারতবর্ষের কথা প্রচার করা দরকার বলে আমার মনে হয়।"
আরও পড়ুন- বাংলায় রেনেসাঁসের ধারাকে আটকে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ | মুখোমুখি আশীষ লাহিড়ী
নানাভাবে স্বামীজিকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। নিজেই রসিকতা করে লিখেছিলেন, “বিশেষত কায়স্থকুলে পয়দা হওয়ায় আমি এখন চোর দায়ে ধরা পড়েছি।" বিবেকানন্দের সবচেয়ে বড় সমস্যা যে তিনি কায়স্থকুলে জন্মেচ্ছিলেন এবং কায়স্থকুলে জন্ম হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণরা কিছুতেই তাঁকে মেনে নিতে পারতেন না। স্বামীজি স্নান করতে যাচ্ছেন দক্ষিণেশ্বরে, বেলুড় মঠে। তখনকার দিনের ব্রাহ্মণরা বলছেন, “পরমহংসের চ্যালা প্যাঁকপ্যাঁক করে চান করতে যাচ্ছে"। এই যে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন স্বামীজি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমরা বাঙালি! বাঙালিরা কোনও মানুষের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। এ এক অদ্ভুত ব্যাধি আমাদের। স্বামীজি কী প্রচার করলেন, ভারতবর্ষকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন, তিনি যে সর্বজনীন ধর্মের কথা বলনে তা কি পাশ্চাত্যজগত মানল? স্বামীজিকে শিকাগো মাথায় তুলে রাখল! বলল, মানবভাষণের এই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অবস্থা। হিউম্যান এলোকোয়েন্ট ইন হায়েস্ট স্পিচ! খবরের কাগজ লিখল, তিনি আমাদেরই একজন 'আওয়ার ম্যান'! অথচ আমরা তা সত্ত্বেও সেটি মানলাম না। একজন বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক লিখলেন, “কলম্বাস ডিসকভারড দ্য সয়েল অফ আমেরিকা অ্যান্ড বিবেকানন্দ ডিসকভারড সোল।" বোঝাই যায়, কী চূড়ান্ত সম্মান তিনি পেয়েছিলেন। এদেশে যখনই এসছেন, তখন সবাই প্রশ্ন করেছে, “স্বামীজি আপনি তো ওই দেশে এতদিন রইলেন, আপনি কী খেতেন? স্বামীজি উত্তর দিতেন, “যা পেতাম, তাই খেতাম।" মজার কথা হচ্ছে, এতদিন পরেও কিন্তু সেই সমালোচনা থামানো যায়নি।
সত্তরের দশকে স্বামীজিকে 'গুজ্জা' বলতে শুরু করে একটি রাজনৈতিক দল এবং তারা সম্পূর্ণ না জেনেই এটি বলে। স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি ইয়াঙ্কিদের ভালোবাসি।" এই দলটি বলতে শুরু করে, স্বামীজি হচ্ছেন আমেরিকান বুর্জোয়াদের সমর্থক। আমরা কোনও কনটেক্সটে পড়ি না। স্বামীজি কেন বলেছিলেন ইয়াঙ্কিদের ভালোবাসার কথা? কারণ, আমেরিকানরা নতুন নতুন জিনিসকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারে যে গুণটি আর কারও মধ্যে দেখা যায় না। এই 'ওপেননেস'-কে স্বামীজি সমর্থন করেছেন। তাই বলেছেন "ইয়াঙ্কিদের ভালোবাসি"। আর যেখানে সমালোচনা করার সেখানে তীব্র সমালোচনাও করেছেন। স্বামীজির গোটা লেখা কেউ পড়েন না। বহু লোক এখনও বলেন যে, স্বামীজি 'কনট্রাডিক্টরি'। আসলে তারা কনটেক্সটকে পড়েন না। কনটেক্সট মাথায় রেখে যদি পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে তিনি একেবারেই কন্ট্রাডিক্টরি নন। মনে রাখতে হবে, বিবেকানন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ। তিনি মানুষকে সম্মান দিয়েছিলেন, বিশেষ করে সাধারণ মানুষকে তা যেন আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। নতুন ভারত বেরোক চাষার কুটির থেকে, উনোনের পাশ থেকে, ঝোপ-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত থেকে— এটা মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। কারণ আমরা মনে করি, একশ্রেণির মানুষই রাজ্য বা দেশকে চালাবেন। তাঁরাই মন্ত্রী হবেন, তাঁরাই আমলা হবে, তাঁরাই শীক্ষক হবেন, তাঁরাই সমাজ থেকে নানাবিধ উপায়ে সুযোগসুবিধা পাবেন। সাধারণ মানুষের দিকে কেউ তাকাইও না। এই চিন্তাভাবনা এখনও বর্তমান, আমরা যে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে বিশেষ উন্নতি করতে পেরেছি তা নয়। আমরা যেহেতু সাধারণ মানুষকে ধারাবাহিকভাবে অবজ্ঞা করি, তাই সাধারণ মানুষের কথা যিনি বলেছিলেন তাঁকেও যে অবজ্ঞা করব, সেটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন- গৃহী রবিঠাকুর ও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ; প্রেমের অলিন্দে অচেনাই রয়ে গেলেন স্বামীজি
দ্বিতীয়বার যখন স্বামীজি বিদেশে যাচ্ছেন, তখন ইংল্যান্ডের লোকেরা নানা প্রশ্ন করতে শুরু করে। তারা বলল, ‘প্রফেটের কখনও ডায়াবেটিস হয় না'। এই বিষয়টি কিন্তু অন্য কারও সম্বন্ধে তারা তোলেনি। পাশ্চাত্যের মানুষই কিন্তু বলত, মানুষের অসুখ নিয়ে কোনও কথা বলতে নেই। তারাই কাগজে লিখতে শুরু করল, প্রফেটের ডায়াবেটিস কী করে হয়? তারাই বলতে শুরু করল, স্বামীজির সভায় যে হাততলি তিনি পান সেই হাততালি পুরুষদের নয়, ‘চুড়িপরা হাতের হাততালি'! এদেশের খবরের কাগজ লিখল, তিনি বিবেকানন্দ নন, 'তিনি বিবি কা আনন্দ'! এই যে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন, তাতে অবশ্য তাঁর কিছু এসে যায়নি। মারি লুই, স্বামী অভয়ানন্দ যাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি একজন ফরাসি মহিলা ছিলেন। তিনি বৈষ্ণবদের সঙ্গে মিলে নানাভাবে স্বামীজির সমালোচনা শুরু করলেন। ঢাকাতে বিস্তর সমালোচনা করলেন। কিন্তু স্বামীজি মারা যাওয়ার পর তাঁর সমালোচনা কেউ গ্রহণই করল না এবং তাঁকে যারা মাথায় তুলে নেচেছিল তারা একদিনে তাঁকে জুতোর তলায় ফেলে দিল।
ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা দেবী চৌধুরানীকে স্বামীজি দ্বিতীয়বার বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ওই দেশকে দেখানোর জন্য যে, আমাদের দেশের নারীরা কত শিক্ষিত! সরলা দেবী প্রথমে একটি লেখা লেখেন 'আশা’ নামে। লেখেন, স্বামীজি দেশের নানারকম উপকার করবেন, সেবা করবেন। সেখানে তিনি রামকৃষ্ণের পুজো বন্ধ করার কথা বলেন। বলেন, "রামকৃষ্ণের পুজো বন্ধ করলেই আমরা আপনার সঙ্গে আছি"। স্বামীজি সেই চিঠির উত্তরে লেখেন, “শুধু রামকৃষ্ণের পুজো বন্ধ করা নয়, দেশের যদি উন্নতি হয় এমন কোনও পাপকাজ নেই যা আমরা করতে পারি না। কিন্তু পুজো বন্ধ করলেই আপনারা সমাজের সেবায় আসবেন, না হলে আসবেন না! আপনারা কাচের ঘরেই থাকুন, বাইরে আসার কোনও দরকার নেই। এতে বেদম চটলেন সরলা দেবী চৌধুরানী। তিনি 'নিরাশা' বলে একটি লেখা লিখলেন। সেখানে তিনি বললেন, বেলুড় মঠের চূড়াগুলি যদি ভেঙে পড়ে তাহলে দেশের কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু সরলা দেবী পরে তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে লেখা আছে, বিদেশে তো তিনি গেলেন না, অথচ যাঁর তিনি এত সমালোচনা করেছেন, সেই বিবেকানন্দ তাঁর জন্য নানারকম খাবার জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। রান্না করে খাইয়েছিলেন বেলুড় মঠে। সরলা দেবী লিখছেন, “তাঁর মনে আমি দেবী হলেও, আমি তো জানি আমি কীরকম।" তিনি মায়াবতীতে একবার গেছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন স্বামী স্বরূপানন্দ সকালবেলায় চাল শুকোতে দিচ্ছেন। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় অতিথিদের তদারকি করছেন। সন্ধেবেলা গীতাপাঠ করছেন। সরলাদেবী লিখলেন, এদের সংসারতুল্য কাজের মধ্যে সংসারী স্বার্থপরবশতা নেই। শুধু কর্তব্যের তাগিদ আছে। তারপরে তাঁর সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পর্ক ভালো হয়। কিন্তু যে মানুষটি সরলা দেবীকে বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েও, সরলা অরাজি হওয়াতে নিয়ে যেতে পারলেন না, যে মানুষটি বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর জন্য নানা রকম খাদ্যবস্তু নিয়ে এসেছিলেন, রান্না করে খাইয়েছেন আমরা কিন্তু তাঁকেও ছাড়িনি।
আমাদের ধর্মই হচ্ছে, যে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে তাঁকে নানাভাবে কী করে টেনে নামানো যায় তার ব্যবস্থা করা। আমরা বিদ্যাসাগরকেও তাই করেছিলাম। তিনি কার্মাটাঁড়ে গিয়েছিলেন। যখনই কেউ নিন্দা করত, বিদ্যাসাগর বলতেন, “আমি তো তাঁর কোনও উপকার করিনি।" রবীন্দ্রনাথকেও আমরা কল্পনাতীত সমালোচনা করেছিলাম। একটি কাগজ লিখেছিল, টেগোর ক্যান বি বেস্ট ডেস্ক্রাইবড অ্যাজ দ্য চ্যাম্পিয়ন অফ লেডিজ ড্রয়িং রুম। যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তখন রবীন্দ্রনাথকে লিখতে বাধ্য করা হয়েছিল "এ মণিহার আমায় নাহি সাজে"। কিন্তু এঁরা কেউই মানুষের কথায় আটকে থাকেননি। তরতরিয়ে এগিয়ে গেছেন। যারা সমালোচনা করেছিলেন, ইতিহাসের বইতে সমালোচনাকারী হিসেবেই তাঁদের নাম পাওয়া যায়, নাহলে উল্লেখও থাকত না। ধরা যাক, হেনরিয়েটা মুলার। স্বামীজির অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন। তিনিও তুমুল সমালোচনা শুরু করেন ইংল্যান্ডে গিয়ে। আসলে সকলে ভেবেছিলেন, স্বামীজিকে কব্জা করে রাখবেন। তিনি যে নিজের মতো করে জীবনটা কাটাবেন, নিজের মতো কথা বলবেন, এই মনোপোলাইজেশন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাধি।
আরও পড়ুন- বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ সম্পর্কের ভিয়েন, আজও অটুট রহস্য
স্বামীজি ছোটবয়স থেকেই বেপরোয়া ছিলেন। যাঁরা বয়স্ক তাঁদের সামনেই তামাক সেবন করতে করতে যাচ্ছেন, তখন সবাই বলতেন এই ছেলেটির কিছু হবে না। বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে বখাটে, আর সঙ্গে জুড়েছে রামকৃষ্ণদেবের প্রশ্রয়। তাই মাথা ঘুরে গেছে। কলকাতার মানুষ কোনওদিন ভাবেননি যে বিবেকনন্দ এমন বিপুল হয়ে উঠবেন। তিনিই তো প্রথম কায়স্থ সমাজের শিক্ষিত ছেলে যিনি সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। তার আগে বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষ খুব একটা সন্ন্যাসী হতেন না। সেই যুগে বিবেকানন্দ ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক! সেই কলেজের অধ্যক্ষ অত্যন্ত ভালোবাসতেন স্বামীজিকে। বেলুড়মঠে যখন ইউরোপিয়ান, আমেরিকানরা স্বামীজির কাছে আসছেন, থাকছেন তখন নানাভাবে মহিলাদের সঙ্গে জড়িয়েও বিবেকানন্দকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সমালোনাকারীরা বুঝলেন না, সেই সময় যারা ভারতে এসেছেন বিদেশ থেকে তারা এই পরাধীন দেশকে ভালোবেসে এসেছেন। নিবেদিতা যেভাবে আমাদের দেশে চরম প্রতিকূল আবহাওয়াতেও কাজ করেছিলেন রোগ-বালাইয়ের মধ্যে, স্কুল তৈরি করে এখনও তা করেন না অনেকে। অথচ সমালোচকরা বলেন স্বামীজির সঙ্গে নিবেদিতার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আসলে বাঙালির মনটা বড় অবৈধ জিনিসে বিশ্বাস করে। নিজেদের মনের ভিতর জটিলত আছে বলেই প্রত্যেকটি সম্পর্ককে বাঙালি জটিলই ভাবে।
বিবেকানন্দকে অবশ্য এই ধারাবাহিক সমালোচনা আটকে রাখতে পারেনি। ২০২৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা রুথ হ্যারিস 'গুরু টু দ্য ওয়ার্ল্ড: লাইফ অ্যান্ড লিগাসি অফ বিবেকানন্দ' বইয়ে দেখিয়েছেন বিবেকনন্দের অবদান ঠিক কোথায়। আমরা দেখব, পাশ্চাত্যে নতুন করে বেদান্তের চর্চ শুরু হয়েছে। তরুণ তরুণীরা সেই চর্চায় অংশ নিচ্ছেন। রম্যা র্যঁলা বিবেকানন্দকে নিয়ে লিখছেন বিবেকানন্দস ওয়ার্ডস আর গ্রেট মিউজিক! নানাভাবে তিনি মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন, তাঁর কাজের সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে এবং জগত বুঝেছে নিষ্কাম কর্মের কথাই বলেছেন স্বামীজি। মানুষের আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন। সেটিকে অনুসরণ না করলে পৃথিবী এগোবে না। এমন কোনও বিপ্লবী নেই, তা সশস্ত্র আন্দোলনই হোক বা নিরস্ত্র - বিবেকানন্দ যাঁর গুরু নন। কারণ তাঁরা জানেন, এই মানুষটি দেশের কথা বলেন। বিবেকানন্দ প্রথমবার বিদেশ থেকে এসে বলেছিলেন, "আগামী ৫০ বছর দেশমাতা তোমার একমাত্র আরাধ্য দেবী। বাকি সব অকেজো দেবতাদের ফেলে রাখলেও চলবে। সব দেবতা ঘুমোচ্ছেন। একটি দেবতা জেগে আছেন। তিনি হচ্ছেন স্বদেশ, তার হাত এবং কান সর্বত্র বিস্তৃত"। এই বিবেকানন্দকে আমরা কোনওদিন ফেলে দিতে পারব না যিনি দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন ভারত আবার জাগ্রত হবে, জড়ের শক্তিতে নয় চৈতন্যের শক্তিতে, বিনাশের ধ্বংস পতাকা নিয়ে নয় প্রেমের পতাকা নিয়ে।