কোটি কোটি টাকা বন্ডের নামে রাজনৈতিক দলের বেইমানি এখনও সহ্য করে যাবেন?
Electoral Bond Donation: যারা শাসক দলকে টাকা দিচ্ছে তারাই যে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা বুঝতে পারছেন কি? বুঝতে পারছেন আপনি আমি আসলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় গৌণ?
কত হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে চারিদিকে কথা হচ্ছে। কোন কোম্পানি কোটি কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে কোন রাজনৈতিক দলকে সাহায্য করেছে তা নিয়ে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে। কিন্তু তা নিয়ে আপনার কোনও হেলদোল নেই। একের পরে কতগুলো শূন্য বসলে এত হাজার কোটি টাকা হতে পারে, তা নিয়ে একটু কল্পনা হয়তো করলেও করতে পারেন। কিন্তু তাতে আমার কী এসে গেল বলে রচনা ব্যানার্জি ও লকেট চ্য়াটার্জির মিমে গলে গেলে আসলে আপনি নিজেকেই নিজে প্রতারণা করছেন।
জানি, কতই তো রাজনৈতিক চুরির ঘটনা শুনেছেন, দেখেছেন! কয়লা খনি বিক্রি থেকে শুরু করে চিটফান্ড হয়ে চাকরি বিক্রি এবং আরও কত! তাতে আপনার জীবনে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। কারণ আমাদের জীবনে দুর্নীতি আর বড় ব্যাপারই নয়। আর রাজনীতিকরা একটু আধটু বা কেউ একটু বেশি চুরি করে থাকেন এ তো আমাদের কাছে সাধারণ বিষয়। নতুন কী!
নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যে লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছে সেটাও আপনার কাছে হয় অন্য গ্রহের মনে হচ্ছে বা সাধারণ ব্যাপার মনে হচ্ছে। নির্বাচনের আগে কোনও রাজনৈতিক দলই আপনার কাছে এই নিয়ে প্রচার করতে আসবে না। কারণ, সবাই কম বেশি নির্বাচনী বন্ড থেকে টাকা সংগ্রহ করেছে দলের ফান্ড বাড়াতে। যে বামেরা তাও নৈতিকভাবে আপনাদের কাছে গিয়ে বলতে পারে, তারা নির্বাচনী বন্ড থেকে কোনও টাকা নেয়নি এবং অন্যরা কীভাবে নিয়েছে, তাদের কথা আপনার শোনার দায় নেই। কারণ এই রাজ্যে তারা এমনিতেই প্রান্তিক শক্তি।
আপনি আবারও প্রশ্ন করতে পারেন, নির্বাচনী বন্ডের সঙ্গে আমার রোজকার জীবনের তো কোনও সম্পর্ক নেই। আপনি আসলে বুঝতে পারছেন না, কীভাবে আপনি প্রতারিত হচ্ছেন। আপনি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করেন বলে ভাবছেন কিন্তু গণতন্ত্র আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুন- দেশজুড়ে ভয়াবহ দুর্নীতি! বন্ডের বিনিময়ে কাদের কী কী সুবিধা দিয়েছে বিজেপি?
কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পরে একটি সুন্দর বন্দোবস্ত করেছিল পার্টি ফান্ডে টাকা তোলার। ওই কৌটো নেড়ে, স্লিপ কেটে বা স্যুটকেসে টাকা নেওয়া নয়। ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলগুলিকে দাও। তারা সেই বন্ড ভাঙিয়ে টাকা নিজেদের ফান্ডে নিয়ে নেবে। বলা হয়েছিল, এটি চমৎকার একটি ব্যবস্থা। পুরোটাই ডিজিটাল মাধ্যমে হবে। কোনও নগদ লেনদেনের ব্যাপার নেই। যে রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দিতে চাও তাকে বন্ড দিয়ে দাও। ব্যাস! স্যুটকেসে করে টাকা নিয়ে যাওয়া বা দেওয়ার ঝুট ঝামেলা নেই। কেউ জানতেও পারবে না কে কাকে টাকা দিচ্ছে। কারণ পুরোটাই গোপন রাখা হবে। আইন করেই এই গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যবস্থা।
কিন্তু বাধ সাধল কয়েকজন আবেদনকারী ও সুপ্রিম কোর্ট। এ কেমন ব্যবস্থা যে কোন কোম্পানি বা ব্যক্তি কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দিচ্ছে তা জানা যাবে না! সুপ্রিম কোর্ট ঘ্যাচাং ফু করে দিল। আইনটাই বাতিল করে সরকারি ব্যাঙ্ককে বলল কারা কত টাকার বন্ড কিনেছে এবং কোন দল কত টাকার বন্ড ভাঙিয়েছে সবটা জনগণকে জানিয়ে দাও।
ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে পড়তেই দেখা গেল হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে লেনদেন হয়েছে 'গোপনে'। কোনও পরিচিত কোম্পানি বন্ড কিনেছে। যেমন, সুনীল মিত্তলের ভারতী এয়ারটেল, সঞ্জীব গোয়েঙ্কার কোম্পানি। কোনও অপরিচিত বা কম পরিচিত কোম্পানিও বন্ড কেনায় সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। যেমন ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস। তারা সবচেয়ে বেশি টাকার বন্ড কিনেছে। এরা লটারির ব্যবসা করে এবং রাজনৈতিক দলকে টাকাও দেয়।
আবার ব্যক্তি হিসেবে এস এন মোহান্তি সবচেয়ে বেশি টাকার (৪৫ কোটি টাকার) বন্ড কিনেছেন। তাঁর কোম্পানি খনিজ পদার্থ নিয়ে কাজ করে। তারপরেই রয়েছেন শিল্পপতি লক্ষ্মী মিত্তল। তিনি ৩৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছেন।
কোনও কোম্পানির মোট ব্যবসার পরিমাণের থেকেও বেশি টাকার বন্ড কিনেছে। যেমন, মদনলাল লিমিটেড ও এমকেজে এন্টারপ্রাইজেসের কোনও আয় বা লাভও হয়নি, অথচ তারা নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। ডিএলএফ কমার্শিয়াল ডেভলপারস এখনও পর্যন্ত ২০২২ ও ২০২৩ সালের আয় ব্যায়ের রিপোর্ট পেশ করেনি, কিন্তু ১০৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে।
কোনও কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড কেনার পরে কোনও সরকারি কাজের বরাত পেয়েছে। যেমন, মহারাষ্ট্রে সরকারি কাজের বরাত পাওয়ার এক মাস আগে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং ১৪০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল।
আবার কোনও কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড কেনার পরে সেই কোম্পানিতে আয়কর দফতর বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট হানা দিয়েছে। যেমন এই ফিউচার গেমিং-এর দফতরে ও এর মালিক স্যান্টিয়াগো মার্টিনের বাড়িতেও ইডি হানা দিয়েছে।
কোন দল নির্বাচনী বন্ড থেকে কত টাকা পেয়েছে তা তো আগেই জনসমক্ষে ছিল। এবার সেই তথ্য আরও পোক্ত হল। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি সবচেয়ে বেশি টাকা তুলেছে নির্বাচনী বন্ড থেকে। তারপরে আমাদের রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস রয়েছে। কংগ্রেস কম টাকা পেলেও নির্বাচনী বন্ড থেকে টাকা পেয়েছে।
আপনি ভাবছেন, এ আর নতুন কী ব্যাপার। নির্বাচন লড়তে গেলে টাকা লাগে। খুব ভাল কথা। কিন্তু এই গোলযোগে যারা শাসক দলকে টাকা দিচ্ছে তারাই যে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা বুঝতে পারছেন কি? বুঝতে পারছেন আপনি আমি আসলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় গৌণ?
আরও পড়ুন- নির্বাচনী বন্ডের নামে কীভাবে তোলাবাজি চক্র চালাচ্ছিল মোদি-শাহের বিজেপি?
যে দলের কাছে যত টাকা সে তত বেশি প্রচারের ঢক্কানিনাদ করতে পারে। আপনার কাছে নিজেদের প্রতীক ও প্রার্থীর মুখ পৌঁছে দিতে পারে। যার কাছে টাকা নেই সে আপনার কাছে ভোট চাইতে পৌঁছতেই পারে না। এসব ক্ষেত্রে সব সময় শাসক দল এগিয়ে থাকে। কারণ তাদের টাকার জোগান অনেক বেশি।
নির্বাচনী বন্ড প্রমাণ করে দিয়েছে অনেক কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড কিনে শাসক দলের কাছ থেকে কোনও বরাত পেয়েছে বা সস্তায় জমি পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ঠিক এই কথাটিই বলছে সুপ্রিম কোর্টও। পুরো নির্বাচনী বন্ডের ব্যবস্থাতে কর্পোরেট সংস্থা ও সরকারি দলের দেওয়া-নেওয়ার ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। হয়েছেও তাই।
আপনারা অনেকে বিশ্বাস করেন না যে, এই কর্পোরেট সংস্থাগুলিই আসলে সরকার চালায়। তারাই ঠিক করে কাকে টাকা দেবে এবং কাকে সরকারে রাখলে তাদের সুবিধা। আমরা নিজেদের আদার ব্যাপারী বলে জাহাজের খবর রাখতে চাই না। আমরা ভোটটা দিই ঠিকই। কিন্তু দিনের শেষে আমার-আপনার ভোট 'কেনা' হয়। রাজনৈতিক দলগুলির বকলমে কর্পোরেট সংস্থাগুলি টাকা দিয়ে সেই ভোট 'কিনে' নেয়।
কর ছাড় থেকে শুরু করে সস্তায় জমি, দুর্নীতি করেও মাফ, ব্যঙ্কের ঋণের টাকা শোধ না করে চম্পট বা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান, টাকা দিয়ে খালাস হয়ে যায় কর্পোরেট সংস্থাগুলি ও তাদের মালিকেরা। আর আমরা উচ্ছিষ্ট ভোগ করি। কখনও এই সরকারি অনুদান তো কখনও ওই অনুদান।
আসলে আমাদের সহ্যশক্তি অপরিসীম। হয় আমাদের এসব দুর্নীতি একেবারেই গায়ে লাগে না অথবা আমরা জেনেও চোখ বন্ধ করে থাকি। এবার চোখ খোলার সময় এসেছে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল আপনার সঙ্গে যে বেইমানি করে চলেছে, তার যোগ্য জবাব আপনি দিতেই পারেন। আপনার একটি ভোটের দাম অন্যকে কেন চোকাতে দেবেন। নিজের ভোটের দাম নিজের কাছেই রাখুন। আর কতদিন সহ্যশক্তির পরীক্ষা দেবেন?