২০১৪: মোদিকে যেভাবে মসনদে বসিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর
Prashant Kishore & Narendra Modi: ৩৩ বছর বয়সে প্রশান্ত কিশোর রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগে, উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ চাড-এ কাজ করতেন।
২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়ের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। জাতীয় রাজনীতিতে 'পিকে' নামেই পরিচিত তিনি। পিকেই যে ২০১৪ সালে বিজেপিকে বিপুল ভোটে জয়ী করিয়েছিলেন তা শিশুও জানে। ২০১৪ সালে বিজেপি ২৮২ টি আসনে এবং কংগ্রেস ৪৪ টি আসনে জয়লাভ করেছিল। ২০০৯ সালে, কংগ্রেস ২০৬ টি এবং বিজেপি ১১৬ টি আসনে জয় পেয়েছিল। ৫ বছরের মধ্যেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এক লাফে ১১৬ টি আসন থেকে ২৮২ টি আসনে জয় পাওয়া মামুলি ব্যাপার নয়। ২০১৪-র নির্বাচনে পিকের ভূমিকা ঠিক কী ছিল? কীভাবেই বা রাজনীতির ময়দানে এলেন তিনি?
৩৩ বছর বয়সে প্রশান্ত কিশোর রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগে, উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ চাড-এ কাজ করতেন। ২০১১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে, গুজরাত অপুষ্টির মাপকাঠিতে শীর্ষে রয়েছে। সেই রিপোর্টটির প্রণেতা ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। রিপোর্ট প্রকাশের পরই মোদির চোখে পড়েন প্রশান্ত। এরপরই মোদির টিমে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব পান পিকে। তার পরের বছরই গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনও ছিল। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে মোদির সঙ্গে কাজ করার সময় দেশবাসী প্রশান্ত কিশোরকে চিনেছিল। 'আনফিলটার্ড বাই সমদিশ' নামে ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পিকে বলেছেন, একটা সময় প্রধানমন্ত্রীর মোদির সঙ্গেই থাকতেন তিনি। গুজরাত বিজেপির এক প্রবীণ নেতা বলেন, ২০১১-তে মোদির সঙ্গে পিকের প্রথম দেখাতেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য খোলাখুলি বলেছিলেন। পিকে সেইদিনই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। মোদির জন্য ঠিক কী কী ক্যাম্পেন করেছিলেন পিকে?
আরও পড়ুন- সত্যিই বিজেপির পুতুল হয়েছেন প্রশান্ত কিশোর? ফলবে সব ভবিষ্যদ্বাণী?
চায় পে চর্চা
জনসভার পাশাপশি জনসংযোগ বাড়াতে ২০১৪-র লোকসভা ভোটে পিকের কৌশলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল এটি। দেশের ১০০০ টি চায়ের দোকানে লাগানো হয়েছিল জায়েন্ট স্ক্রিন। সেখান থেকেই নির্দিষ্ট সময় মোদি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বার্তা দিতেন। আসরগুলিতে মোদি জানাতেন, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কী কী কাজ করবেন। পশ্চিমবঙ্গে ৩৬ টি এবং কলকাতার ৩ টি চায়ের দোকানেও এই স্ক্রিনিং হয়েছিল। একজন 'চা-বিক্রেতা' প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে, চায়ের দোকান থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মন জয় করে নিয়েছিলেন দেশবাসীর। অনুষ্ঠানে কালো টাকা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি উন্নয়নের বার্তা দিতেন মোদি। কিন্তু ১০ বছর পরও পিএমও ফান্ড, ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো গুরুতর আর্থিক দুর্নীতিতে শীর্ষে নাম রয়েছে বিজেপি নেতাদেরই। অন্যদিকে, ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে ফের উন্নয়নের জন্যই ভোট চাইছে মোদি সরকার।
মন্থন ক্যাম্পেন
মন্থন ক্যাম্পেনর মূল উদ্দেশ্য ছিল, ২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। সিএজি তরফে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। মূলত অনলাইনেই মতামত আদানপ্রদানে এই ক্যাম্পেন চলত। ২ অক্টোবর ২০১৩, মোদি কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে দেখা করেছিলেন। সেইদিন ২০০ কলেজের ৭,০০০ ছাত্রছাত্রীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দাবি করা হয়, ২৫০টি শহর থেকে ৭০০ কলেজের, ২০,০০০ ছাত্র এই ক্যাম্পেনের সঙ্গে অনলাইন যুক্ত ছিলেন। 'মন্থন' নামে একটি ওয়েবসাইটও খোলা হয়েছিল। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রছাত্রীরা দেশের জন্য তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানাতেন। জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ক্যাম্পেনের ৮০% ছেলেমেয়েরাই বিজেপিতে ভোট দিয়েছিলেন। এই ক্যাম্পেন নাকি মূলত মতামত আদানপ্রদানকেই গুরুত্ব দিয়েছিল। এদিকে, ফ্রিডম হাউসের রির্পোট বলছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে এবং মানবধিকার কর্মী, বিরোধী দলনেতা এবং সাংবাদিকদের উপর সরকারের চাপ বেড়েছে। দিল্লির সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রোদ্রোহর মামলার প্রসঙ্গও রিপোর্টে উল্লেখ ছিল।
সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার
২০১৪ সালে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালানো হয়েছিল। আর তার বিশাল প্রভাবও পড়েছিল। নির্বাচন শেষে মোদির ফেসবুক পেজে ১৬ মিলিয়ানেরও বেশি লাইক ছিল, যা সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান। টুইটারে স্থান ছিল ষষ্ঠ। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্লগ এবং কমেন্টের ভিত্তিতে, বিজেপি ২০১৪-র লোকসভা ভোটের ইস্তাহার বানিয়েছিল। বিজেপির আইটি প্রধান বলেছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের প্রচার বাড়াতে 'অর্গানাইজ অনলাইন টু অ্যাসিস্ট অফলাইন' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজেপি ২.২ মিলিয়ন ভলান্টিয়ার বানিয়েছিল। ভারতে ২০১৩ সালের জুন মাস অব্দি ৭৮ মিলিয়ন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৯১ মিলিয়ন। বিজেপির আইটি প্রধান বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সোশ্যাল মিডিয়া দলের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 'ফেসবুক : মুখ ও মুখোশ' বইটির তথ্য বলছে, "২০১৪ সালে নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে ২ কোটি ৯০ লক্ষ ভারতীয় ২২ কোটি ৭০ লক্ষ বাদানুবাদে জড়িয়েছে, অর্থাৎ পোস্ট, কমেন্ট, শেয়ার, লাইক করেছেন ভারতীয় নির্বাচন নিয়ে। ভারতে ফেসবুকে মোট বাদানুবাদ সাপেক্ষে দুই তৃতীয়াংশ ছিল এই বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষপিছু ১০টি কথাবার্তা হতো এই নিয়েই। ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সেই সময় নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে ৭ কোটি ৫০ লক্ষ কথাবার্তায় জড়িয়েছেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে।" অর্থনীতিবিদ তথা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার প্রবীণ চক্রবর্তী, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়কে 'ব্ল্যাক সোয়ান মোমেন্ট' বলে ব্যাখা করেছিলেন।
আরও পড়ুন- কেন ‘৪০০ পার’ বলছে বিজেপি? ফাঁস করলেন প্রশান্ত কিশোর
পিকের ক্যাম্পেন গ্রুপ- 'সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্স (CAG) ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির জন্য কাজ করেছিল। নির্বাচনের কিছু মাস পর সিএজি-র পরিবর্তে আই প্যাক প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর। কিন্তু 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিকের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি দাবি করেছিলেন, ২০১৫ সালে রেজিস্টার করা আই প্যাক সংস্থায় কিশোরের নাম নেই। ওই প্রতিবেদনেই এক ব্যক্তি দাবি করেন, প্রশান্ত কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি গডসে এবং গান্ধির মধ্যে তফাৎ করতে পারেন না। অন্যদিকে আবার কিছুজন বলেন, পিকে যেমন আরএসএসের সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন, তেমনই আম আদমি পার্টি (আপ), কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্যও কাজ করেছেন। তবে, রাজনৈতিক মহলে এও চর্চা হয় যে, যে দলগুলির জেতার সম্ভাবনা থাকে, তাদের সঙ্গেই জোট বাধেন তিনি। শোনা গিয়েছিল, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি এবং আরও কিছু ক্ষমতাসীন বিজেপি বিরোধী দলনেতার সঙ্গে মিলিত হয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি গোদি মিডিয়াগুলিতে, কংগ্রেসের হার এবং বিজেপির জয় হবে বলেই ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছেন পিকে। বিজেপির দুর্নীতি, ইলেক্টোরাল বন্ড, পিএমও ফান্ড এবং বিজেপির অবহেলা, লাদাখের আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, মণিপুর হিংসা নিয়ে কোনও কথাই বলছেন না তিনি। ওয়াকিবহাল মহল প্রশ্ন তুলছে, ২০১৪ সালে প্রকাশ্যে হাত মেলালেও, এবারে কি তবে তলায় তলায় মিলে রয়েছে পিকে আর পদ্মশিবির? ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, আবারও ভোটে জয় পেতে পিকের হাত প্রকাশ্যে ধরতে কি লজ্জাই পাচ্ছে ক্ষমতাসীন কেন্দ্র সরকার বিজেপি? পিকের কৌশলই কি তবে বিজেপির '৪০০ পার' করার ইচ্ছে পূরণ করবে? জল্পনা আবার জিইয়ে রাখলেন ভোটকৌশলী পিকে।