নজরুলের পত্রিকায় সেদিন লেখেননি রবীন্দ্রনাথ
Kazi Nazrul Rabindranath Letters: "আমার শীর্ণ শক্তি আর জীর্ণ দেহের পরে তোমার দরদ নেই। কোনো মন্ত্রবলে বয়স বদল করতে পারলে তোমার শিক্ষা হতো।"
সে কালে রবীন্দ্রনাথও নজরুলের পত্রিকায় লেখেননি। ঘুরিয়ে বলেছিলেন, এখন 'বড়' লেখকরা যা বলেন। তফাৎ হলো কীভাবে তিনি বলেছিলেন, লিখতে পারবেন না। নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের চিঠির উত্তরে কেমনভাবে কী বলেছিলেন, তাও লক্ষ্য করার মতো। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের প্রথম দেখা ১৯২০ সালে। যেটুকু জানা যায়, ওই সাক্ষাতে নজরুল তাঁর নতুন কবিতা 'আগমনী' রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের দ্বিতীয়বার দেখা এর ঠিক বছর দুয়েক পরে, ১৯২২-এর ১১ জুলাই। এর ঠিক এক মাস পরেই প্রকাশিত হয় নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’। মুজফফর আহমেদ আর নজরুল মিলে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশের আগে তিনি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী চেয়ে পাঠান। রবীন্দ্রনাথও একটি কবিতা লিখে পাঠান নজরুলকে। এরপর বসন্ত নাটিকাটি নজরুলকে উৎসর্গ, নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ, সেই সবই ঘটেছে। ১৯৩১ সালের জুন মাসে নজরুল দার্জিলিং গেলেন, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সেখানেই। সাক্ষাৎ হলো যথারীতি। এর বছর চারেক পর, ধূমকেতুর সময়ের মতোই রবীন্দ্রনাথের কাছে নয়া পত্রিকার জন্য লেখা চাইলেন নজরুল। ইনস্ক্রিপ্টে রবিবারের রোয়াকে এই সংখ্যায় আমরা দু'জনেরই দু'টি ঐতিহাসিক চিঠি তুলে ধরলাম পাঠকদের সামনে।
শ্রীচরণারবিন্দেষু,
গুরুদেব! বহুদিন শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষ্মী হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন বহুদিন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি। আপনার তপস্যায় আমি কখনো উৎপাত করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই অবকাশ সত্ত্বেও আমি আপনার দূরে দূরেই থেকেছি। তবু জানি, আমার শ্রদ্ধার শতদল আপনার চরণস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি।
আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ সাহিত্যিক ও কবি বন্ধু ‘নাগরিক’ পরিচালনা করছেন। গতবার পূজায় আপনার কিরণস্পর্শে ‘নাগরিক’ আলোকিত হয়ে উঠেছিল, এবারও আমরা সেই সাহসে আপনার দ্বারস্থ হচ্ছি। আপনার যে কোনো লেখা পেলেই ধন্য হব। ভাদ্রের শেষেই পূজা সংখ্যা নাগরিক প্রকাশিত হবে। তার আগেই আপনার লেখনী-প্রসাদ আমরা পাব, আশা রাখি।
আপনার স্বাস্থ্যের কথা আর জিজ্ঞাসা করলাম না। ইতি –
প্রণত
নজরুল ইসলাম।
আরও পড়ুন- যৌন জটিলতাও হয়ে উঠেছিল স্নিগ্ধ! নজরুলের যে গল্পের হদিশ আজও জানেন না পাঠক
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে নজরুলকে লেখেন,
কল্যাণীয়েষু,
অনেকদিন পর তোমার সাড়া পেয়ে মন খুব খুশি হোল। কিছু দাবী করেছো – তোমার দাবী অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন। আমার মুস্কিল এই, পচাঁত্তরে পড়তে তোমার এখনো অনেক দেরি আছে এইজন্য আমার শীর্ণ শক্তি আর জীর্ণ দেহের পরে তোমার দরদ নেই। কোনো মন্ত্রবলে বয়স বদল করতে পারলে তোমার শিক্ষা হতো। কিন্তু মহাভারতের যুগ অনেক দূরে চলে গেছে, এখন দেহে মনে মানবসমাজকে চলতে হয় সায়েন্সের সীমানা বাঁচিয়ে।
অনেকদিন থেকে আমার আয়ুর ক্ষেত্রে ক্লান্তির ছায়া ঘনিয়ে আসছিল, কিছুদিন থেকে তার উপরেও দেহযন্ত্রের বিকলন দেখা দিয়েছে। এখন মূলধন ভেঙে দেহযাত্রা নির্বাহ করতে হচ্ছে – যা ব্যয় হচ্ছে তার আর পূরণ হবার উপায় নেই। তোমার বয়সে লেখা সম্বন্ধে প্রায় দাতাকর্ণ ছিলুম, ছোটোবড়ো সকলকেই অন্তত মুষ্টি ভিক্ষাও দিয়েছি। কলম এখন কৃপণ, স্বভাবদোষে নয়, অভাববশত। ছোটবড় নানা আয়তনের কাগজের পত্রপুট নিয়ে নানা প্রার্থী আমার অঙ্গনে এসে ভিড় করে – তাদের সকলকেই ফেরাতে হলো। অনাবৃষ্টির কুয়োর শেষতলায় অল্প যেটুকু জল জমে ছিল সেটুকু নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি কৃপণের অখ্যাতি শেষ বয়সে স্বীকার করে নিয়ে রিক্ত দানপাত্র হাতে বিদায় নেব। যারা ফিরে যাবে তারা দুয়ো দিয়ে যাবে কিন্তু বৈতরণীর মাঝদরিয়ায় সে ধ্বনি কানে উঠবে না।
আজকাল দেখতে পাই ছোটো ছোটো বিস্তর কাগজের অকস্মাৎ উদ্গম হচ্ছে – ফুল ফসলের চেয়ে তাদের কাঁটার প্রাধান্যই বেশি। আমি সেকেলে লোক, বয়সও হয়েছে। সাহিত্যে পরস্পর খোঁচাখুঁচির প্রাদুর্ভাব কেবল দুঃখজনক নয়, আমার কাছে লজ্জাজনক বোধ হয়। এইজন্যে এখনকার ক্ষণসাহিত্যের কাঁচা রাস্তায় যেখানে সেখানে পা বাড়াতে আমার ভয় লাগে। সাবধানে বাছাই করে চলবার সময় নেই, নজর ক্ষীণ হয়েছে; এইজন্যে এইসকল গলিপথ একেবারে এড়িয়ে চলাই আমার পক্ষে নিরাপদ। তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক করুণা দাবী করতে পারে। নিষ্কিঞ্চনের কাছে প্রার্থনা করে তাকে লজ্জা দিও না। এই নতুন যুগে যে সব যাত্রী সাহিত্যতীর্থে যাত্রা করবে পাথেয় তাদের নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে।
শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জিলায় – কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হবো। স্বচক্ষে আমার অবস্থাও দেখে যেতে পারবে।
ইতি
১৫ ভাদ্র, ১৩৪২
স্নেহরত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও পড়ুন- বিশ্বভারতীর আপত্তি, রবীন্দ্রনাথ সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন নজরুলের পাশে
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি পেয়ে ‘নাগরিক’-এর ওই বার্ষিক সংখ্যাতেই (২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৪২ সন) ‘তীর্থপথিক’ নামে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখেন নজরুল ইসলাম। সেই কবিতার শেষের লাইনগুলো পুরোটা উদ্ধৃত করলাম –
বিজ্ঞান বলে, বলুক, রবির কমিয়া আসিছে আয়ু;
রবি রবে যতদিন এই ক্ষিতি-অপ-তেজ-বায়ু।
মহাশূন্যের বক্ষ জুড়িয়া বিরাজে যে ভাস্কর,
তার আছে ক্ষয়, এত প্রত্যয় করিবে কোন্ সে নর?
চন্দ্র-ও আছে, আছে অসংখ্য তারকা রাতের তরে
তবু দিবসের রবি বিনা মহাশূন্য নাহি সে ভরে।
তুমি রবি, তুমি বহু ঊর্ধ্বের, তোমার সে কাছাকাছি
যাবে কোন্ জন? তোমার কিরণ-প্রসাদ পাইয়া বাঁচি।
তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,
তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তেরে তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।
কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!
তথ্যঋণ- অরুণকুমার বসুর নজরুল জীবনী