ঠাকুমার কাছেই আজীবন কৃতজ্ঞ রতন টাটা! টাটা সন্সের প্রথম মহিলা পরিচালক আজও আড়ালেই
Lady Navajbai Ratan Tata: মাত্র ৪১ বছর বয়সেই স্বামীকে হারান লেডি নভাজবাই আর স্বামীর এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁরই ঘাড়ে।
টাটা সন্স। সাধারণত 'সন'দেরই নাম জ্বলজ্বল করে এই জাতীয় সম্পত্তি ও মালিকানার দায়িত্বভারের উপর। বিশেষ করে টাটার মতো শিল্পগোষ্ঠী, তার মুখ হয়েছেন পুরুষরাই। অনেকেরই অজানা, ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত একজন মহিলাই সামলেছিলেন টাটা সন্সের গুরুদায়িত্ব। রতন টাটার ঠাকুমা, নভাজবাই ছিলেন টাটা সন্সের প্রথম মহিলা পরিচালক। টাটা গ্রুপের হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্সের পরিচালনার দায়িত্ব তিনি পান ১৯২৫ সালে। ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন এই টাটা সন্সের সর্বেসর্বা। ১৯৩২ সালে নভাজবাই টাটা হন স্যার রতন টাটা ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন।
নভাজবাই সেটের জন্ম ১৮৭৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, জামশেদপুরে। আরদেশির মেরওয়ানজি সেটের ছোট মেয়ে নভাজবাইয়ের সঙ্গে ১৮৯২ সালে বিয়ে হয় স্যার রতন টাটার। স্যার রতন টাটা জামশেদজি টাটার ছেলে এবং স্যার দোরাবজি টাটার ছোট ভাই। বিয়ের পরপরই ইংল্যান্ডে চলে যান স্যার রতন টাটা এবং নভাজবাই। দেশের অন্যতম খ্যাতিমান এবং বিত্তবান পরিবারের পুত্র আর পুত্রবধূর জীবন যেমন হওয়ার, তেমনই হয়। ইংল্যান্ডে রঙিন সময় কাটিয়েছেন দু’জনেই। টুইকেনহ্যামে ডিউক অব অরল্যান্সের অপূর্ব বাসভবন ইয়র্ক হাউস কিনে নেন তাঁরা। রাজা পঞ্চম জর্জ এবং কুইন মেরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন স্যার রতন টাটা এবং নভাজবাই। ফলে ব্রিটিশ সমাজ ও অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে সখ্যতা ছিল বেশ প্রবল।
স্যার রতন টাটা এবং লেডি নভাজবাই ছিলেন চারুকলার বিশেষ অনুরাগী। দেশে বিদেশে যেখানেই ঘুরতে যেতেন নানা শৌখিন শিল্পকর্ম কিনে বাড়িতে তুলতেন। কোনও বিশেষ চিত্রশিল্প হোক বা অন্য কোনও ভাস্কর্য- নিজেদের বাড়ি সাজানোর জন্য বিশ্বের নানা জায়গা থেকে এই শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন দু'জনেই। ইয়র্ক হাউসকে ছোটখাটো সংগ্রহশালা বললেও ভুল বলা হতো না। তবে ইয়র্ক হাউস সাজানো নয়, তাঁদের এই মূল্যবান শিল্পকর্ম সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের নতুন বাড়িটি সাজানো। স্যার রতন ভার্সাইয়ের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের আদলে বম্বেতে এই নতুন বাড়িটি তৈরি করছিলেন।
আরও পড়ুন- প্রেমে পড়েছিলেন তিনিও! কেন সারাজীবন বিয়ে করলেন না রতন টাটা?
তবে নিজের এই নতুন বাড়িটি আর সচক্ষে দেখে যেতে পারেননি স্যার রতন টাটা। মাত্র ৪১ বছর বয়সেই স্বামীকে হারান লেডি নভাজবাই আর স্বামীর এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁরই ঘাড়ে। বরাবরই বাস্তববাদী এবং পরোপকারী ছিলেন নভাজবাই। ইংল্যান্ডে এত সাধ করে কেনা ইয়র্ক হাউস (এখন এই বাড়িটিই টুইকেনহ্যাম আরবান ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের বাড়ি) বিক্রি করে দেন। ওই বাড়িতে মূল্যবান শিল্প সংগ্রহটিও বম্বের প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়ামে দান করে দেন। তবে বম্বেতে স্যার রতনের স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজটি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সম্পন্ন করেছিলেন নভাজবাই। আজ এই বিখ্যাত ভবনটিই টাটা হাউস হিসাবে পরিচিত। এই বাড়িটিতেই নিজের বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন নভাজবাই।
স্বামীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে যা যা পেয়েছিলেন, জীবদ্দশায় লেডি নভাজবাই নানান দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে সেইসব বাড়ি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। বয়স্ক এবং দরিদ্র পার্সি মহিলাদের দুর্দশা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন নভাজবাই। অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পার্সি সম্প্রদায়ের দরিদ্র মহিলাদের জীবিকা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯২৬ সালে স্যার রতন টাটার স্মরণে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মুম্বইয়ের সবচেয়ে সুপরিচিত প্যাটিস-কেকের কেন্দ্র এই বিখ্যাত রতন টাটা ইনস্টিটিউট (আরটিআই)। ১৩৩২ সালে, নভাজবাই স্যার রতন টাটা ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন হন। টাটা সন্স বোর্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন তিনি। ট্রাস্টের সম্পদ ব্যবহার করে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন নভাজবাই। জীবিকা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করা থেকে শুরু করে চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহ- নিজ উদ্যোগে সামলেছেন নভাজবাই টাটা। শোনা যায়, একবার একজন সমাজকর্মী নভাজবাইকে একটি আরোগ্যভবন প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। নভাজবাই মাথেরানে একটি জমি দান করেছিলেন, সেইসঙ্গে ৩ লক্ষ টাকাও অনুদান দিয়েছিলেন। টাকার পরিমাণ সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ছিল বিশাল।
তবে সবটা সামলালেও নিজে থাকতেন নিভৃতে। নিজের ব্যক্তিগত তহবিল কত কত টাকা যে দান করেছেন সেই বিশাল অঙ্কের টাকা সম্পর্কে খুব মানুষই জানতেন। স্যার রতন টাটা ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন হিসেবে গোটা টাটা গোষ্ঠীকে যেভাবে সামলেছেন নভাজবাই তা বারেবারে আলোচনায় উঠে আসা দরকার। কিন্তু তিনি নিজেই থেকে গিয়েছেন আড়ালে। যেসময়ে একজন মহিলা এই গুরুদায়িত্ব সামলাচ্ছেন, সহজ ছিল না চারপাশটা। নভাজবাইয়ের শান্ত নেতৃত্ব আজও টাটা গোষ্ঠীকে পৃথক করে রেখেছে ভিড়ের থেকে। নভাজবাই ছিলেন বলেই, আজও রতন টাটার সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে যাপন সবটাই দেশের মানুষের কল্যাণার্থে বলেই ভাবেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ। রতন টাটা একবার বলেছিলেন, পুরনো যুগের এমন একজন বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন নভাজবাই যাঁর কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন৷ ঠাকুমা যা করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে রতন, সারা জীবন।